Close

World Chess Championship 2023: ডিং লিরেনের বিশ্বজয়ঃ কার্লসেন যুগের বিরতিতে চৈনিক দাবাসম্রাটের উত্থান

পিছিয়ে পড়লেন তিন বার। নেপোমনিয়াশি তখন চালকের আসনে। ডিং অপ্রত্যাশিত ভুল করলেন। হারলেন। ড্র করলেন। জিতলেন। এশিয়ার দ্বিতীয় বিশ্বচ্যাম্পিয়ান ডিং।

Source: FIDE

ডিং লিরেনের এই বিশ্বখেতাবী লড়াইয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করারই কথা ছিল না।


সের্গেই কারিয়াকিন, রাশিয়ার একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের সেরা দাবাড়ু, ২০১৬ সালে কার্লসেনের প্রতিদ্বন্দ্বী, যিনি বিশ্বখেতাবী ম্যাচের ধ্রুপদী গেমে কার্লসেনকে হারিয়েছিলেন, তাঁর খেলার কথা ছিল ক্যান্ডিডেটসে। দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে তিনি যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। কিন্তু, ২০২২-এর ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরে কারিয়াকিন রুশী আভিজাত্য দেখিয়ে রাশিয়ার সমর্থনে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করলেন! FIDE-র নীতিরক্ষা কমিটি তাঁকে ৬ মাসের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করল। আর, ওই ৬ মাসের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল ক্যান্ডিদেটস দাবা। সুযোগ ছিল ক্ষমাপ্রার্থনার, কিন্তু কারিয়াকিন অটল রইলেন নিজের সিদ্ধান্তে। বললেন, “প্রথমত আমি একজন দেশপ্রেমিক। তারপর আমি একজন অ্যাথলিট। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ও সৈন্যদের সমর্থন ক’রে আমি কোনও ভুল করিনি। আমার কোনও অনুতাপ নেই।” উল্লেখ্য, কারিয়াকিনের জন্ম ইউক্রেনে। দীর্ঘদিন সবচেয়ে কমবয়সী গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার বিশ্বরেকর্ড তাঁর দখলে ছিল। ২০০৯ সালে ক্রিমিয়া থেকে এসে পাকাপাকিভাবে রুশ নাগরিকত্ব নেন তিনি। ক্যান্ডিডেটস দাবার বিজয়ী বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে প্রত্যাহ্বান করার সুযোগ পান। কারিয়াকিন সেসবের তোয়াক্কা করলেন না।


কিন্তু, কারিয়াকিনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পরে ফিডে (FIDE)-র নিয়মাবলী অনুযায়ী সেই সময়ের সবচেয়ে বেশি এলো রেটিং সম্পন্ন দাবাড়ুর প্রতিযোগিতায় সুযোগ পাওয়ার কথা। সুযোগ পেলেন চিনের ডিং লিরেন। এলো রেটিং অনুযায়ী সেই সময় বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোত্তম দাবাড়ু। অপ্রত্যাশিত সুযোগ। যদিও, বাধার পাহাড় ছিলই। নিয়মানুযায়ী তাঁকে কমপক্ষে ৩০টি ধ্রুপদী গেম খেলতে হত ওই সময়ের মধ্যে। যদিও কোভিডের সময়ে ভিসা-সংক্রান্ত সমস্যায় ডিং অত ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি। সেই সমস্যা মিটল। কিন্তু, ক্যান্ডিডেটসের শুরুটা খুব ভাল হল না তাঁর। নেপোমনিয়াশির কাছেই হেরেছিলেন। পরপর ড্র করলেন। কিন্তু, ধীরে ধীরে ছন্দে ফিরে দ্বিতীয় হলেন। ক্যান্ডিডেটসের বিজয়ী ইয়ান নেপোমনিয়াশি। নেপোমনিয়াশি ফের ম্যাগনাস কার্লসেনের প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন, এমনটাই কথা ছিল। ডিং লিরেনের বিশ্বখেতাবী লড়াইয়ে অংশগ্রহণের আকাঙ্খা স্বপ্ন হয়েই রয়ে যেত, যদি না কার্লসেন ঘোষণা করতেন নিজের অনিচ্ছের কথা। কার্লসেন বললেন যে, তিনি আর বিশ্বখেতাবী লড়াইয়ে অংশ নিতে চান না! হঠাৎ করেই সুযোগ পেয়ে গেলেন বিশ্বখেতাবী লড়াইয়ে। নতুন প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহ তৈরি হল- নেপোমনিয়াশি বনাম ডিং।


বিশ্বখেতাবী লড়াইয়েও তো ডিং পিছিয়ে পড়লেন তিন বার। শুরুটা ভাল হল না। নেপোমনিয়াশি তখন চালকের আসনে। ডিং অপ্রত্যাশিত ভুল করলেন। হারলেন। ড্র করলেন। জিতলেনও বটে। কিন্তু, ডিং লিরেনের ফর্মে কোথায় যেন খামতি থাকছিল। ১১ রাউন্ড অবধি পিছিয়ে থেকে অবশেষে সমতা ফেরালেন দ্বাদশ রাউন্ডে। নেপোমনিয়াশির অদ্ভুত একটি ব্লান্ডারে ডিং পয়েন্ট সমান করলেন। ড্যানিইল ডুবভ, তরুণ তুর্কি তথা কার্লসেনের প্রিয়তম সহযোগী, তথা আধুনিক যুগের তাল, বলে দিয়েছিলেন যে, “ডিং যদি নিজের সেরা ফর্মে থাকে, তাহলে তা ইয়ানের থেকে ভয়ঙ্কর। কিন্তু, নিজের খারাপ ফর্মে ডিং ততটাই খারাপ। ডিং আর ইয়ান দু’জনেই যদি খারাপ ফর্মে থাকেন, তাহলে ইয়ান জিতে যাবে।” যদিও, প্রতিযোগিতার প্রথম থেকেই নেপোমনিয়াশির স্বদেশীয় ডুবভ বাজি ধরেছিলেন ডিংয়ের পক্ষে। ডিং যে প্রথমদিকে ছন্দে থাকেন না, পরে ধীরে ধীরে ছন্দে ফেরেন এবং সঠিক সময়ে জ্বলে ওঠেন, রুশী ড্যানিইল ডুবভ তা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। ম্যাগনাস কার্লসেন গত বছরই বলেছিলেন যে, ডিং লিরেনের খেলা তাঁর বেশ লাগে, কারণ তিনি আউট অব দ্য বক্স ভাবতে পারেন। প্রতিদ্বন্দ্বীকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারেন। সেটাই হল টাইব্রেকার গেমে


চারটি র‍্যাপিড গেম হওয়ার কথা ছিল। দু’জনেই ২৫ মিনিট ক’রে সময় পাবেন এবং প্রথম দান থেকেই ১০ সেকেন্ড ক’রে সময় যোগ হবে ঘড়িতে। প্রথম ও তৃতীয় গেমে ডিংয়ের সাদা। দ্বিতীয় ও চতুর্থ গেমে নেপোমনিয়াশির সাদা। প্রথম তিনটি গেম ড্র। দ্বিতীয় গেমে স্প্যানিশ ওপেনিং বা রুই লোপেজ দিয়ে শুরু করেছিলেন নেপোমনিয়াশি। বিশ্বখতাবী লরাইতে প্রায়ই এই ওপেনিং বেছে নেন সেরার সেরা দাবাড়ুরা। ববি ফিশার থেকে গ্যারি কাসপারভ, বশ্বনাথন আনন্দ বা ম্যাগনাস কার্লসেন আগে বিশ্বখেতাবী লড়াইয়ের মঞ্চে এই ওপেনিং বেছে নিয়েছেন। যদিও, এক্সচেঞ্জ শাখা বা বার্লিন প্রতিরক্ষা বা মরফি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা না, নেপোমনিয়াশি বেছে নিলেন মার্তিনেজ শাখা। সাদা শুরুর দিকে a4 পন বাড়িয়ে কালোর কুইনের-দিকের পনে আঘাত করে এবং কালোর পনকাঠামো দুর্বল ক’রে দিতে চায়। মিডলগেমে নেপোমনিয়াশি অ্যাডভান্টেজ পেয়েছিলেন। অনিশ্চয়ে ভরা, কিন্তু গভীর বিশ্লেষণে এগিয়ে থাকার দানপর্যায় খুঁজে পাওয়া অসম্ভব ছিল না। কিন্তু, নেপোমনিয়াশি দ্রুত পিস-পন বদলাবদলি ক’রে ড্রয়ের দিকে নিয়ে গেলেন। দাবার যুদ্ধনীতির অন্যতম শিক্ষণীয় বিশয় এটি- যত দ্রুত পিস-পন বদলাবদলি হবে এবং আক্রমণাত্মক পিস বোর্ড থেকে সরে যাবে, তত বেশি ড্রয়ের সম্ভাবনা বাড়বে। সেটাই হল। ডিং লিরেনও ওই নীতি বেছে নিলেন। দ্বৈত রুক+নাইট এন্ডগেমে নিশ্চিত ড্র হল।


চতুর্থ গেমেও নেপোমনিয়াশি স্প্যানিশ ওপেনিং খেললেন। স্প্যানিশ ওপেনিং-এর বদ্ধ মাঝছকের মার্তিনেজ শাখা। দ্বিতীয় রাউন্ডের মতোই দানপর্যায় চলতে লাগল। কিন্তু, ১৪ নম্বর দানের পর থেকে জটিল হতে শুরু করল যুদ্ধটা। নেপোমনিয়াশি বা ডিং কেউই খুব সহজ ড্রয়ের দিকে যেতে রাজি ছিলেন না, বোঝা যাচ্ছিল। ক্রমশঃ জটিলতর পজিশনে রূপান্তরিত হতে হতে কালোর a5 পনটি বিপজ্জনক অপ্রতিরোধ্য পন হয়ে উঠল। আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য- ২৬… Qg6 দান থেকে কালোর নীতিগত পরিকল্পনায় বদল। ডিং ওই সময় থেকেই সাদার দুর্বলতা খুঁজে আক্রমণাত্মক রণসজ্জা বেছে নিলেন। কালোর কালো-ঘরের বিশপ, অতিসক্রিয় কুইন এবং রুকের ফাইলভেদী অবস্থান সাদার যুদ্ধ-পরিকল্পনাকে ক্রমশ রক্ষণাত্মক হতে বাধ্য করল। এরপরেই গেমে দু’টি তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত তৈরি করলেন ডিং।


World Chess Championship 2023: ইয়ান নেপোমনিয়াশি বনাম ডিং লিরেন
1. e4 e5 2. Nf3 Nc6 3. Bb5 a6 4. Ba4 Nf6 5. O-O Be7 6. d3 b5 7. Bb3 d6 8. a4 Bd7 9. h3 O-O 10. Be3 Na5 11. Ba2 bxa4 12. Nc3 Rb8 13. Bb1 Qe8 14. b3 c5 15. Nxa4 Nc6 16. Nc3 a5 17. Nd2 Be6 18. Nc4 d5 19. exd5 Nxd5 20. Bd2 Nxc3 21. Bxc3 Bxc4 22. bxc4 Bd8 23. Bd2 Bc7 24. c3 f5 25. Re1 Rd8 26. Ra2 Qg6 27. Qe2 Qd6 28. g3 Rde8 29. Qf3 e4 30. dxe4 Ne5 31. Qg2 Nd3 32. Bxd3 Qxd3 33. exf5 Rxe1+ 34. Bxe1 Qxc4 35. Ra1 Rxf5 36. Bd2 h6 37. Qc6 Rf7 38. Re1 Kh7 39. Be3 Be5 40. Qe8 Bxc3 41. Rc1 Rf6 42. Qd7 Qe2 43. Qd5 Bb4 44. Qe4+ Kg8 45. Qd5+ Kh7 46. Qe4+ Rg6 47. Qf5 c4 48. h4 Qd3 49. Qf3 Rf6 50. Qg4 c3 51. Rd1 Qg6 52. Qc8 Rc6 53. Qa8 Rd6 54. Rxd6 Qxd6 55. Qe4+ Qg6 56. Qc4 Qb1+ 57. Kh2 a4 58. Bd4 a3 59. Qc7 Qg6 60. Qc4 c2 61. Be3 Bd6 62. Kg2 h5 63. Kf1 Be5 64. g4 hxg4 65. h5 Qf5 66. Qd5 g3 67. f4 a2 68. Qxa2 Bxf4 0-1


প্রথমে Qe2 দান (৪২ নম্বর দান)!! টাইমপ্রেসারে ওইরকম ব্রিলিয়ান্ট দান খুঁজে নেওয়া অবিশ্বাস্য। দাবাঘড়িতে তখন দু’মিনিটেরও কম সময়। সমান-সমান একটা গেমে ডিং জেতার উদ্যোগ নিতে শুরু করছেন। সামান্য সুবিধাজনক অবস্থানকে আরও পরিণত ক’রে তোলার নীতি। ডিংয়ের ক্লান্তিহীন অদম্য মানসিকতাই পার্থক্য গড়ে দিল। তারপরে অবধারিত ড্র ম্যাচকে ঠেলতে ঠেলতে জেতার দিকে নিয়ে যাওয়ার মুহূর্ত!! যে নেপোমনিয়াশি সারা টুর্নামেন্টে টাইমে এগিয়ে রইলেন, ডিং লিরেন বারবার টাইমপ্রেসারে পড়লেন। সেই নেপোমনিয়াশি আজ টাইব্রেকের শেষ ম্যাচে ছটফট করলেন টাইমপ্রেসারে। ডিং ততক্ষণে রক্তের স্বাদ, জেতার গন্ধ পেয়ে গেছেন। তাঁর হিমশীতল মস্তিষ্কে খেলোয়াড়ি খুনে মানসিকতা জেগে উঠছে।


ডিংয়ের খেতাবজয়ী মানসিকতার সেরা ঝলক Rg6 দান! Rg6 দান দিয়ে থ্রি-ফোল্ড রিপিটেশন বন্ধ করা! কুর্নিশ ডিং লিরেন!! ইঞ্জিন দেখাচ্ছে তখনও ইক্যুয়াল পজিশন। দাবা-ইঞ্জিন আর বিশেষজ্ঞরা বোর্ডের বাইরে বসে ম্যাচ ড্র ক’রে দিয়েছিলেন! তাবড় ধারাভাষ্যকার গেমটি ড্র মনে ক’রে ব্লিৎজ টাইব্রেকের প্রস্তুতি নিতে বলছেন। তাঁরা কেউই বোঝেননি যে, বোর্ডের মধ্যে শান্ত স্থিতধী ডিং অবিশ্বাস্য ব্যূহ সাজানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন! ডিং লিরেন ততক্ষণে ছকে নিয়েছেন বাকি যুদ্ধের সম্ভাব্য রূপরেখা। কারণ, দাবাটা বোর্ডে বসে খেলতে হয়! আর, দাবা খেলছেন দু’জন মানুষ। তাঁরা এই সময়ের সেরার সেরা দাবাড়ু, কিন্তু তাঁরা যন্ত্র নন। ডিং খুব স্বাভাবিক এক দাবাজ্ঞান কাজে লাগালেন। কালোর দু’টি অপ্রতিরোধ্য পন কালোর জেতার আশা। যতই দাবা-ইঞ্জিন নিখুঁত গণনায় সমান-সমান দেখাক, কালো যদি ওই দু’টি পনকে বাড়ানোর চেষ্টা করেন এবং সাদার সম্ভাব্য চেকের পথ বন্ধ ক’রে দেন, তাহলে জেতার অবস্থানে পৌঁছানো যাবে। দ্বিতীয়তঃ, টাইমপ্রেসারে যেকোনও দাবাড়ুর সামান্য ভুল করার প্রবণতা বেড়ে যায়- এটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার। ডিং সেই অমোঘ সময়েই চাপ বাড়ালেন নেপোমনিয়াশির ওপরে। অন্তিম মুহূর্তে অমোঘ ব্লান্ডার করলেন নেপোমনিয়াশি।


বিশেষজ্ঞ আর দাবা-ইঞ্জিনের মতামতকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে Rg6 দান দিয়েছিলেন ডিং! কার্লসেন যেটাকে বলছেন অমরত্বের প্রত্যাশায় পিনের ফাঁদে ধরা দেওয়া!!


ডিং লিরেন আসল ডিং লিরেন হয়ে উঠলেন টাই ব্রেকারের শেষ ম্যাচে। আর, নেপোমনিয়াশি?! সেই করশনয়ের মতো, দু’বার বিশ্বখেতাবী লড়াইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েও হেরে গেলেন। বিশ্বখেতাব অধরা রয়ে গেল। এশিয়ার দ্বিতীয় বিশ্বজয়ী হলেন ডিং লিরেন (প্রথমজন ভারতের বিশ্বনাথন আনন্দ)। চিনের দাবা-অস্তিত্বের প্রথম দাবাড়ু। আর, দাবা কেন রাজনৈতিক? নেপোর উত্তর শুনলেই বুঝবেন- “I Still communicate with Ukrainian chess players who I was in touch with before.” দেশের পতাকায় খেলা হল না তাঁর। যে দুরন্ত প্রত্যাবর্তনে ক্যান্ডিডেটস জিতেছিলেন, দুর্দম জেদ আর মানসিক জোরে বিশ্বখেতাবী লড়াইয়ের মঞ্চে ফিরে এসেছিলেন, সেই সব হুড়মুড়িয়ে ভেঙে গেল এই একটিমাত্র ম্যাচে এসে। ট্র্যাজিক নায়কের নতুন সংজ্ঞায়ন করলেন ইয়ান নেপোমনিয়াশি। দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে, অনেক ভাল দাবাড়ুবন্ধুর সঙ্গে বিচ্ছেদ, দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে না-পারার যন্ত্রণা… এসব কি কোনওই প্রভাব ফেলেনি তাঁর ওপর? বহুবছর রাশিয়া বিশ্বখেতাব জেতেনি। ইয়ান পারতেন। ইয়ানের সেই প্রতিভা, অনুশীলন, দক্ষতা ছিল। কিন্তু, শেষ মুহূর্তের স্নায়ুদৌর্বল্য। হাত থেকে প্রায় বেরিয়ে যাওয়া গেমের ওপরে নিয়ন্ত্রণ হারাতে হারাতে ছটকে যাওয়া। সারাটা প্রতিযোগিতায় ভাল খেলে শেষের একটি ভুল। পারলেন না ইয়ান নেপোমনিয়াশি। সাংবাদিক সম্মেলনে স্বাভাবিক থাকার প্রাণপণ চেষ্টাটা ধরা পড়ে যাচ্ছিল।


আর, ডিং লিরেনের অভিব্যক্তি? ম্যাচ শেষ। নেপোমনিয়াশি হ্যান্ডশেক ক’রে বেরিয়ে গেছেন। ডিং তখনও মাথায় হাত দিয়ে বসে। উচ্ছ্বাস? চিৎকার? আনন্দ? নাঃ! ডিং মাথায় হাত দিয়ে বসে। ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতার মতো শান্ত অথচ অন্তর-ঘাতী। বিশ্বাস করতে পারেননি হয়ত যে, ইতিহাসের পাতায় ১৭তম বিশ্বজয়ী হিসেবে নাম লিখিয়ে ফেলেছেন। তারপর উঠলেন। সাংবাদিক সম্মেলন। ধন্যবাদ দিলেন সহযোগীদের। নিজের পরিবারকে। আর, নিজের ঠাকুর্দাকে। দাবাখেলায় তাঁর হাতেখড়ি ঠাকুর্দার হাতেই। ছবিতে ধরা রইল রিচার্ড র‍্যাপোর সঙ্গে হাস্যোচ্ছ্বল মুহূর্ত। রিচার্ড র‍্যাপো ডিংয়ের সেকেন্ডস দলের মুখ্য সদস্য- অসাধ্য সাধন করেছেন। ডিংকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া, প্রস্তুতি নেওয়ানো এবং প্রথাগত দানকৌশলের বাইরের দানপর্যায় রপ্ত করানোয় র‍্যাপোর ভূমিকা অনস্বীকার্য।

Source: FIDE


ম্যাগনাসহীন দাবা আপাততঃ ডিংপ্রবণ! প্রায় দু’লাখ দর্শক এই টাইব্রেকারের সরাসরি সম্প্রচার দেখলেন। নতুন রেকর্ড তৈরি হল। এই বিশ্বখেতাবী লড়াই বহুদিন ক্রীড়াপ্রেমীদের মনে থেকে যাবে। শেষ মুহূর্ত অবধি জেতার আশা ছাড়তে নেই। পিছিয়ে পড়েও লড়ে ফিরে আসা যায়। যতক্ষণ না জয় হাসিল হচ্ছে, ততক্ষণ লড়ে যাওয়া জরুরি। দাবা ভাগ্যের খেলা না। অলৌকিক বিশেষত্ব নেই এতে। নিরন্তর শ্রমে নিজের সর্বোচ্চ দক্ষতার স্ফূরণ ঘটানো যায় এবং স্নায়ুকে নিয়ন্ত্রণে রেখে বাধার পাহাড় টপকানো যায়- ডিং প্রমাণ করলেন। জীবনদর্শনের পাঠ। শুধু এটুকু মনে রাখলেই যথেষ্ট যে, জিতে যাওয়ার জন্য একটু সাহস প্রয়োজন- ঝুঁকি নেওয়ার সাহস আর অদম্য জেদকে সাফল্যে বদলে নেওয়ার সাহস।

প্রবুদ্ধ ঘোষ, জাতীয় স্তরের দাবাড়ু ছিলেন, বর্তমানে বেঙ্গল চেস অ্যাসোশিয়েশনের আধিকারিক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের গবেষক, কবি, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক।

Leave a comment
scroll to top