সৌদির চিঠি: রূপকথার দেশের ইতিকথা জানালো সাবির(পর্ব ১০)
রীতিমত অশান্তি শুরু হয়ে গেছে। জুলাই মাস শেষ হতে চললো, আমরা এখনও জুন মাসের মাইনে পাইনি! কোম্পানির টপ বস নাকি দুবাই পালিয়েছে, পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে, মানে মাইনের টাকা জোগাড় হলে ফিরবে, এমন কথা রটে বেড়াচ্ছে। কিন্তু বেশ অস্বাভাবিক ভাবেই, এইবার যেন সবাই বেশ শান্ত। সবাই শান্ত থেকে অশান্তি ছড়ানোর কথা ভাবছে। কীভাবে? আমাদের এখানে কাজের কন্ট্র্যাক্ট শেষ হতে আর চার মাসেরও কম সময় বাকি। তার আগেই চাকরি ছাড়তে হলে মোটা এক জরিমানা ভরে বেড়োতে হবে। তাই সবাই এখন চুপচাপ ভাবছে যাতে নির্ঝঞ্ঝাটে তাড়াতাড়ি কাজ ছাড়া যায়, কন্ট্র্যাক্ট শেষ হতেই। মাইনে দেরি হচ্ছে, প্রচুর ওভার ডিউটি হচ্ছে, তবুও সবাই শান্ত হয়ে ধৈর্য ধরে শেষ রাতের কোপ টা দেওয়ার অপেক্ষা করছে।
সবাই জানে যে এইরকম সময়ে কোম্পানি-র অবস্থা মোটেই ভালো না, যতই নতুন নতুন শাখা খোলার গল্প শোনাক। যারা রোজ কাজে আসছেন, তারা তো বুঝতে সক্ষম যে আসলে কি পরিস্থিতি। সেই কারণে সবাই এটাও জানে যে এখন যদি তারা কাজ ছাড়তে চায় তাহলে একদিক দিয়ে কোম্পানি কোনঠাসা হতে বাধ্য। এখনও অবধি যা মনে হচ্ছে, যতজন মিলে কাজ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তা যদি সত্যিই বাস্তবায়িত হয়, তাহলে জেড্ডাহ শহরে কোম্পানির ব্যবসার কোমর ভেঙে যাবে। আমরা রোজ প্রতি মূহুর্তে পরস্পরের সাথে দেখা হলেই শুধু এই নিয়েই আলোচনা করছি যে কবে কখন কাজ ছাড়ার নোটিশ দেওয়া উচিত। সবাই একসাথে দেবো, নাকি আলাদা আলাদা করে দেওয়া শ্রেয় হবে? ৩ মাস আগে নোটিশ দিলে সেটা গ্রহণ হবে তো? যদি না হয় তখন কি করা যেতে পারে, এবং কি পদ্ধতিতে কোম্পানি কে তাড়া দেওয়া যেতে পারে যাতে তাড়াতাড়ি আমাদের সব হিসেব মিটিয়ে আমাদের দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করে।
সবাই অন্তত এইটুকু বুঝতে পারছে যে এখন করপোরেট সবরকম চেষ্টা করবে যাতে আমাদের ধরে রাখতে পারে। মাইনে বাড়ানোর গল্প, প্রোমোশনের লোভ, এজেন্সির হাত থেকে নিষ্কৃতি, এমন অনেক প্রস্তাব ইতিমধ্যেই পেয়ে গেছি গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই। এই ক্ষেত্রে আমার একটু অহংকার আছে বলে মনে হতে পারে পাঠকের, কারন আমার গুরুত্ব একটু আলাদা সেটা উল্লেখ করে রাখতে চাই, দয়া করে ভুল ভাবে নেবেন না! আমি শিক্ষিত, ম্যানেজমেন্ট গ্র্যাজুয়েট। কিচেনের সমস্ত খাতায় কলমের কাজের দায়িত্ব নিতে পারি সহজেই এবং একই সাথে, রেস্টুরেন্টের কিছু বিশেষ কাজ, যেমন পিজা বানানো, ব্রেডের কাজ ইত্যাদি, মানে যেগুলো স্পেশালিস্টের কাজ হয়, সেগুলো আমি চেষ্টা করে কম সময়ে শিখে নিয়ে দায়িত্ব নিতে পারি। এইটার জন্য বিশেষ ভাবে ধন্যবাদ জানাতেই হয় আমার বাকি সিনিয়র শেফদের যারা আগ্রহ এবং অনেক ধৈর্য নিয়ে আমায় এইসব কাজ শিখিয়েছিলেন এবং এখনও শেখাচ্ছেন। হয়তো তাদের দরকার মেটানোর জন্য আমাকে শিখিয়ে রাখেন কিন্তু সেই শিক্ষার গুরুত্ব আমার কাছে সাংঘাতিক। তাদের প্রয়োজনীয়তার থেকে অনেক বেশি দরকার আমার নিজের জন্য, তাই এই শিক্ষা আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমার পরবর্তী চাকরি জীবনের জন্য।
এই কারনে, এমন অনেক কাজ আমি রেস্টুরেন্টে করতে পারি যা চট করে এখনই বাকিরা হয়তো পারবেন না, কারন তারা নিজেদের দায়িত্ব নিয়েই এতটা ক্লান্ত। সেই কারণে, আমাকে যে ম্যানেজমেন্ট একটু আলাদা নজরে দেখে, তা সবসময়ই টের পেতে থাকি। আমার এই সপ্তাহে রিয়াধ যাওয়ার কথা ছিল, সেটা পিছিয়ে গেছে। আমার শেফ আপ্লুত একেবারে, তিনি কিছুতেই আমাকে যেতে দিতে চান না। ওপরমহল অবধি বারবার আবেদন জানাচ্ছেন যাতে আমাকে ওনার কিচেন থেকে না সরানো হয়, তাতে অনেক অসুবিধা হয়ে যেতে পারে, ইত্যাদি। এবার অন্যদিকে রিয়াধে যেই শেফ আমার সিনিয়র হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন, তিনি বারবার আমাকে ফোন করছেন আমি কবে আসছি জানার জন্য। শুধুমাত্র আমার কাজের জন্য এত আগ্রহ তা মোটেই নয়, আরেকটা বিশেষ কারন হচ্ছে যে রিয়াধে আমাদের কর্পোরেট বসরা বসে আছে এবং তারা নাকি একেবারেই লেবার দের ভালো ভাবেন না। এই কারনে তাদের সাথে যাতে চোখে চোখ রেখে অন্তত নিজেদের বক্তব্য রাখা যায়, সেটার জন্যেও আমি তার সাথি হতে পারি। সে আমার সাথে একসাথে যেন এক ইউনাইটেড ফ্রন্ট গড়বে কর্পোরেটের বিরুদ্ধে!
কিন্তু যতই এই ধরনের রোমাঞ্চকর পরিকল্পনা করা হোক, আমাদের এখন ধৈর্য ধরে রাখতেই হবে। মাথা গরম করে কোনো লাভ হবে না আগেরবারের মতো, সেবার সবার বেশ শিক্ষা হয় গেছে। সবাই ভালোই বুঝছি যে কোম্পানির পিঠ ঠেকে যাচ্ছে দেওয়ালে। সেই কারণেই, এই পরিস্থিতির ফায়দা তুলতে হবে শ্রমিকদের পক্ষের কথা ভেবে। তাড়াহুড়ো করে মাথা গরম করলে শুধু ঝামেলা বাড়বে, আমাদেরই বিপদ বাড়বে, কারণ কোম্পানি-মালিকপক্ষের যতই ক্ষতি হোক, তাদের ক্ষমতা আর ধন সম্পদের দৌলতে তাদের কখনোই বিশেষ খুব একটা অসুবিধা হবে না। কিন্তু আমরা শ্রমিকদের এক মাসও বিনা মাইনেতে বসিয়ে রাখলে এই দুর বিদেশে রোজকার খাওয়াটা জোটাতেও অসুবিধা হবে।
সৌদির চিঠি: এলাম মরুর দেশে; রিয়াধ যাওয়ার অভিজ্ঞতা (পর্ব ১২)