Close

সৌদির চিঠি: এলাম মরুর দেশে; রিয়াধ যাওয়ার অভিজ্ঞতা (পর্ব ১২)

যাত্রাপথেই বুঝতে পারলাম এবার মরুর দেশে এসেছি। কিন্তু রিয়াধ পৌঁছেই নতুন অভিজ্ঞতা। নিয়মের একশেষ! পড়তে হচ্ছে বাঙালির গ্যাঁড়াকলে‌।

যাত্রাপথেই বুঝতে পারলাম এবার মরুর দেশে এসেছি। কিন্তু রিয়াধ পৌঁছেই নতুন অভিজ্ঞতা। নিয়মের একশেষ! পড়তে হচ্ছে বাঙালির গ্যাঁড়াকলে‌।

সৌদির চিঠি: কোম্পানি ছেড়ে দুবাই পালালো বস! (পর্ব ১১)

রিয়াধ শহরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই এক বিরাট পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা হচ্ছে। মানুষও যেন বদলে গেছে। বাস টার্মিনাস থেকে বেড়োনোর আগেই তা টের পেলাম যখন বাংলাদেশি কর্মচারীরা হুট করে ১০ রিয়াল(২০০ ভারতীয় টাকা) দাবি করে বসলো আমাদের লাগেজের “গেট পাস” হিসেবে। আমরা এটার কারণ জানতে চাইলে বলে দেওয়া হলো এটাই নাকি নিয়ম। কিসের নিয়ম, বুঝলাম না, যখন আমরা নিজেরাই নিজেদের সমস্ত বাক্স-প্যাঁটরা বাস থেকে নামিয়ে বাইরে অবধি নিয়ে যাচ্ছি! লাগেজের ট্রলির ভাড়া নাকি জানতে চাওয়াতে সাফ বলে দিল, ট্রলি না নিলেও টাকা দিতেই হবে! আমার সাথে আসা মুরশিদ প্রথমেই চটে গিয়ে একটু কড়া ভাষায় প্রতিবাদ করে উঠতে সঙ্গে সঙ্গে টাকা দাবি করা বাংলাদেশি কর্মচারীরা একেবারে ঝাঁঝিয়ে উঠলো, আর একজন সৌদি কর্মচারী কে ডেকে আনলো ওদের দল ভারি করার জন্য। ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই বুঝে ট্যাঁক থেকে খোসাতে বাধ্য হলাম।

টার্মিনাস থেকে বেড়িয়ে আবার আরেক দুর্দশা। ট্যাক্সি ড্রাইভাররা রীতিমত হাত পা ধরে টানাটানি শুরু করে দিল। আমরা ঘাবড়ে গিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িটির সাথে ভাড়া চুক্তি করাতেই নতুন বিপদ দেখা দিল – ওই গাড়ি নাকি টার্মিনাসের দলের নয়, তাই ওর জন্য ওখান থেকে সওয়ারি তোলা নিষিদ্ধ। আমরা ওই গাড়ি টার্মিনাসের গাড়ি গুলোর অর্ধেক ভাড়ায় পাচ্ছিলাম, সেই কারনে এই নিয়ে হালকা করে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করতেই সৌদি-বাঙালির মিলিত আক্রোশ দেখে ফেললাম! টার্মিনাসের সৌদি এবং বাংলাদেশি ট্যাক্সিচালকরা একসাথে মিলে পুলিশ ডেকে সেই বাইরের চালক কে ধরিয়ে দিয়ে টার্মিনাস থেকে বার করে দিল!

জেড্ডাহ থেকে রিয়াধ পৌঁছে যেন মনে হলো, হ্যাঁ এবার মরুভূমির দেশে এসেছি। যেমন সাংঘাতিক গরম, তেমনি চরম ঠান্ডা। কোম্পানি থেকে আমাদের বা যাত্রার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল, যা সত্যিই অত্যন্ত কষ্টের ছিল! প্রায় ১৩ ঘন্টার যাত্রা, আর তাতে যা খরচা হলো, তার একটু বেশি দিলেই ২ ঘন্টার ফ্লাইট টিকিট চলে আসতো। কি ভেবে যে কোম্পানি এই বুদ্ধি বার করলো আমরা হিসেব করে পেলাম না! পথে দুবার খাওয়ার জন্য এবং একবার ভোরের নামাজের জন্য দাঁড় করিয়ে ছিল। এখানে সৌদি বাসগুলোয় প্রথমবার একটা জিনিস দেখলাম, তা হলো বাসের মধ্যেই এক ছোট্ট খুপরি মতো তৈরি আছে টয়লেট হিসেবে।

রাস্তার দুই ধারে মরুভূমি আর বিক্ষিপ্ত ভাবে কাটা পাহাড় পুরো যাত্রা জুড়েই। রুক্ষ ঝোপ এবং খেজুর গাছ ছড়ানো এই হেজাজের দেশে ভ্রমণ করতে গিয়ে মনে পড়ে যায় এই মরুভূমি কতই না ইতিহাসের সাক্ষি। ছোটবেলায় কারবালার যুদ্ধ নিয়ে পড়েছিলাম, আজ পবিত্র মহরমের দিন আরও বিশেষ করে সেই সব গল্প মনে পড়ে। এখানে এসে শিখেছিলাম শিয়া-সুন্নির ভেদাভেদ, এবং ভারতে এত শোকের সাথে পালন হওয়া ‘শিয়া দের পরব’ মহরম ওয়াহাবি সুন্নি রাজতন্ত্র সৌদি আরবে পালন হয় না বললেই চলে। তবুও মহরমের আগের দিন এখানে অনেক মানুষ রোজা রাখেন, এই বিশ্বাসে যে এই দিনে আললাহ এই জগতের সৃষ্টি করেছিলেন এবং কয়ামত ও একই দিনে হবে।


এইসব চিন্তা নিয়েই মরুভূমির মধ্যে উটের চড়ে বেড়ানো দেখে বিভোর হয়ে আছি, তখন হঠাৎ আমার আরেক সহযাত্রী, কুষ্টিয়ার সেই জাহির আমাকে ডেকে নিয়ে গেল ওর সিটের জানলার ধারে কি একটা দেখাবে বলে। আমি ভাবলাম একই তো দৃশ্য দেখছি শুরু থেকে, আবার এর মধ্যে নতুন কি দেখলো? আমাকে ডেকে তখন জানালো, এর আগে আমাদের কিচেনে কাজ শুরু করার আগে সৌদি তে প্রথম এসে কন্সট্রাকশনের কাজে ওকে লাগানো হয়েছিল। সেই কাজের জন্য রিয়াধ, দাম্মাম অনেক জায়গাই ওকে অক্লান্ত ভাবে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কাজ করানো হয়েছিল বিশ্রামের সুযোগ না দিয়েই। তখন মাটিতে জলের জন্য বড়ো বড়ো সিমেন্টের পাইপ বসানোর কাজ করতে হতো ওকে। রাস্তার ধারে সেরকমই অনেক পাইপ পড়ে থাকতে দেখে উত্তেজিত হয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল, আমাকে দেখাতে চাইছিল। চার বছর আগে রিয়াধে থাকতে এই কাজই ওকে করতে হতো। এখন এতদিন পর সেই রাজধানী রিয়াধে ফিরে সেই পাইপ দেখে সেই দুঃসহ রোদে কাজের গল্প শোনাতে শুরু করলো। আমি তখন আর পাইপ কি দেখবো, সঠিক পরিচয়পত্র না থাকার কারণে ইরাকে জেল খাটা আমারি বয়সি ছেলেটার সেই পাইপ গুলোর দিকে ফ্যালফ্যাল ভাবে তাকিয়ে থাকাই দেখে গেলাম।

সৌদির চিঠি: বিচিত্র শহর রিয়াধ (পর্ব ১৩)

Leave a comment
scroll to top