Close

ইউক্রেন সংঘাত: পুতিন ফেডারেল অ্যাসেম্বলির ভাষণে পশ্চিমা শক্তিকে কাঠগড়ায় তুললেন

পুতিন ফেডারেল অ্যাসেম্বলির ভাষণে রাশিয়া কে ভাগ করার ও ধ্বংস করার অভিযগে পশ্চিমা শক্তিগুলোকে কাঠগড়ায় তুললেন, বললেন লড়াই জারি থাকবে। রাশিয়া যে এই সামরিক অভিযানে বিজয় অর্জন করবে সে কথাও জানালেন।

রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে শিশুদের 'ডিপোর্ট' করার অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করল আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত।

মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের ইউক্রেন সফরে এসে সে দেশের রাষ্ট্রপতি ভোলোদিমির জেলেনস্কির সাথে আলোচনা ও নানা ভঙ্গিতে ছবি তোলার ২৪ ঘন্টার মধ্যে রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার ফেডারেল অ্যাসেম্বলিকে সম্বোধিত করে দেওয়া ভাষণে বলেন যে “রাশিয়া-বিরোধী” চক্রান্ত পশ্চিমা শক্তিগুলো এখন করছে তা নতুন কিছু না বরং শতাব্দী প্রাচীন একটি ষড়যন্ত্র। পুতিন ফেডারেল অ্যাসেম্বলির ভাষণে বলেন যে রাশিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে আর নিজের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্যে লড়ছে।

পুতিন ফেডারেল অ্যাসেম্বলির ভাষণে বলেন, “আমি আবারও বলছি যে ১৯৩০-এর দশকে, পশ্চিমারা আসলে জার্মানিতে নাৎসিদের ক্ষমতায় আসার পথ তৈরি করেছিল এবং এখন তারা ইউক্রেনকে রাশিয়া বিরোধীতে পরিণত করতে শুরু করেছে। এই প্রকল্পটি আসলে নতুন নয়, যারা ইতিহাসের সামান্যতমও জানেন তারা পুরোপুরি জানেন, এই প্রকল্পটির উনবিংশ শতাব্দীতে সৃষ্ট।”

গত বছরের ২৪শে ফেব্রুয়ারি থেকে রাশিয়া ইউক্রেনে যে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরু করে নয়া-নাৎসিদের ক্ষমতাচ্যুত করতে, সেটার গুরুত্ব বোঝাতে বারবার পুতিন বলেন যে পশ্চিমা শক্তিগুলো চিরকাল নাৎসিদের রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে। তিনি আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেন যে রাশিয়া এই নয়া-নাৎসি বাহিনী কে নির্মূল করার যে সামরিক প্রকল্প নিয়েছে, তাতে ধাপে ধাপে, সাবধানে, বিজয় অর্জন করা হবে।

পুতিন বলেন, “এক বছর আগে, আমাদের ঐতিহাসিক ভূখণ্ডের জনগণকে রক্ষা করার জন্য, আমাদের দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং ২০১৪ সালের অভ্যুত্থানের পর ইউক্রেনে যে নয়া-নাৎসি শাসন ক্ষমতা দখল করেছিল তার থেকে আসা হুমকি দূর করার জন্য, বিশেষ সামরিক অভিযান শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে ছিল। আমরা ধাপে ধাপে, সাবধানে এবং ধারাবাহিকভাবে আমাদের হাতে থাকা কাজগুলি সম্পন্ন করব।” 

রাশিয়া-বিরোধী চক্রান্তের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পুতিন ফেডারেল অ্যাসেম্বলির ভাষণে বলেন, “এটি অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যে লালন পালন করা হয়ে ছিল, পোল্যান্ড এবং অন্যান্য দেশগুলি একটি লক্ষ্য নিয়ে [এটি লালন পালন করেছিল]: আমাদের দেশ থেকে এই ঐতিহাসিক অঞ্চলগুলিকে ছিন্ন করা, যাকে আজ ইউক্রেন বলা হয়। এই লক্ষ্যটিই এমন, এখানে নতুন কিছু নেই, কোনো নতুনত্ব নেই, সবাই জিনিসের পুনরাবৃত্তি করে চলেছে।” 

পুতিন ২০১৪ থেকে ইউক্রেন কৃতক দনবাস অঞ্চলে রুশ জনজাতির গণহত্যা ও তাঁদের উপর নিপীড়ণের ঘটনা কে তুলে বলেন যে এই ঘটনাবলীর সময় পশ্চিমা শক্তিগুলো চোখ বন্ধ করে ছিল, কিন্তু রাশিয়ার পক্ষে চুপ করে বসে থাকা সম্ভব ছিল না। তিনি বলেন যে রাশিয়া এই দ্বন্দ্বের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্যে অনেক প্রচেষ্টা চালিয়েছিল কিন্তু কিছুই কার্যকরী হয়নি। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি প্রদর্শনের ও দাপটেরও সমালোচনা করেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তির ইউক্রেন নিয়ে দ্বিচারিতা কে ছলচাতুরি বলে অভিযোগ করেন।  

পুতিন বলেন, “২০১৪ থেকে, ডনবাস তাঁদের দেশে বসবাস করার এবং তাঁদের মাতৃভাষা বলার অধিকারের জন্য লড়াই করছে। অবরোধ, ক্রমাগত গোলাবর্ষণ এবং কিয়েভ শাসনের তীব্র ঘৃণার মধ্যে তাঁরা লড়াই করেছিল এবং কখনও হাল ছাড়েনি। তাঁরা আশা করেছিল এবং অপেক্ষা করেছিল যে রাশিয়া সাহায্য করতে আসবে।” 

“ইতিমধ্যে, আপনারা ভাল করেই জানেন, আমরা শান্তিপূর্ণ উপায়ে এই সমস্যার সমাধান করার জন্য আমাদের ক্ষমতার সব কিছু করছিলাম, এবং ধৈর্য ধরে এই বিধ্বংসী সংঘর্ষের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য আলোচনা চালিয়েছি।” 

পশ্চিমা শক্তির দ্বিচারিতা কে সমালোচনা করে পুতিন ফেডারেল অ্যাসেম্বলির ভাষণে বলেন, “প্রতারণার এই ভয়ঙ্কর পদ্ধতি আগে বহুবার চেষ্টা করা হয়েছে এবং পরীক্ষা করা হয়েছে। যুগোস্লাভিয়া, ইরাক, লিবিয়া এবং সিরিয়া ধ্বংস করার সময় তারা নির্লজ্জভাবে এবং দ্বিগুণ আচরণ করেছিল। এই লজ্জা তারা কখনোই ধুয়ে ফেলতে পারবে না। সম্মান, বিশ্বাস এবং শালীনতার ধারণা তাদের জন্য নয়।” 

পুতিন পশ্চিমা শক্তির এই আচরণের জন্যে তাদের দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক আধিপত্য ও অন্য জাতির মানুষকে গোলামে পরিণত করার ইতিহাস কে দায়ী করে বলেন, “দীর্ঘ শতাব্দীর ঔপনিবেশিকতা, হুকুম ও আধিপত্যের কারণে তারা সব কিছু পেতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে, সারা বিশ্বে থুতু ফেলতে অভ্যস্ত হয়েছে। দেখা গেল যে তারা তাদের নিজস্ব দেশে বসবাসকারী লোকদের সাথে একই ঘৃণার সাথে একজন মালিকের মতো আচরণ করে। সর্বোপরি, তারা তাদেরও প্রতারিত করেছে, শান্তির সন্ধান সম্পর্কে, ডনবাস সম্পর্কে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব মেনে চলার বিষয়ে লম্বা গল্প দিয়ে তাদের প্রতারণা করেছে। প্রকৃতপক্ষে, পশ্চিমা অভিজাতরা সম্পূর্ণ, নীতিহীন মিথ্যার প্রতীক হয়ে উঠেছে।” 

রাশিয়া যে পশ্চিমা আধিপত্যের একমেরুর বিশ্বের বিরুদ্ধে বহু-মেরুর বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলতে আগ্রহী সেই প্রসঙ্গে পুতিন ফেডারেল অ্যাসেম্বলির ভাষণে বলেন, “আমরা দৃঢ় ভাবে আমাদের স্বার্থের পাশাপাশি আমাদের বিশ্বাসকে রক্ষা করি যে আজকের বিশ্বে তথাকথিত সভ্য দেশগুলিতে এবং বাকি সমস্ত দেশে কোনও বিভাজন হওয়া উচিত নয় এবং একটি সৎ অংশীদারিত্বের প্রয়োজন যা যে কোনো, বিশেষত একটি আক্রমণাত্মক, বিশেষত্বকে প্রত্যাখ্যান করে।” 

পুতিন তাঁর ভাষণে ফেডারেল অ্যাসেম্বলি কে জানান যে রাশিয়ার সরকার শান্তিপূর্ণ ভাবে পশ্চিমা শক্তির সাথে সহযোগিতা ও সহবস্থান করতে চেয়েছিল। কিন্তু তার বদলে তাঁর সরকার পশ্চিমাদের দ্বারা শুধু প্রতারিত হয়েছে বলে পুতিন অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, “কিন্তু প্রতিক্রিয়ায়, যতদূর আলোচনার সম্পর্ক ছিল, আমরা হয় একটি অস্পষ্ট বা কপট প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। কিন্তু সেখানেও কিছু পদক্ষেপ ছিল: আমাদের সীমান্তে ন্যাটোর সম্প্রসারণ, ইউরোপ এবং এশিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষার জন্য নতুন স্থাপনার ক্ষেত্র তৈরি করা –– তারা আমাদের থেকে একটি ‘ছাতার’ তলায় আশ্রয় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ––সামরিক কন্টিনজেন্ট মোতায়েন, এবং শুধু রাশিয়ার সীমান্তের কাছেই নয়।” 

মার্কিন সামরিক আগ্রাসন নিয়ে পুতিন অ্যাসেম্বলির ভাষণে বলেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিদেশে অন্য কোনো দেশের এত সামরিক ঘাঁটি নেই। তাদের শত শত আছে – আমি এটা জোর দিতে চাই – সারা পৃথিবীতে শত শত ঘাঁটি; গ্রহটি তাদের দ্বারা আচ্ছাদিত, এবং এটি দেখার জন্য মানচিত্রের দিকে একবার নজর দেওয়া যথেষ্ট।” 

তিনি আরও অভিযোগ করেন যে, “সারা বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে কিভাবে তারা মধ্যবর্তী এবং স্বল্প-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র চুক্তি সহ অস্ত্র সংক্রান্ত মৌলিক চুক্তি থেকে সরে এসেছে, একতরফা ভাবে বিশ্বশান্তি রক্ষাকারী মৌলিক চুক্তিগুলোকে ছিঁড়ে ফেলেছে। কিছু কারণে, তারা এটা করেছে। তারা কারণ ছাড়া কিছু করে না, আমরা জানি।” 

ইউক্রেনের বিরুদ্ধে বিশেষ সামরিক অভিযান চালানো কেন জরুরী হয়ে পড়লো সেই ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পুতিন ফেডারেল অ্যাসেম্বলি কে জানান, “দিন দিন হুমকি বাড়ছিল। আমরা যে তথ্য পেয়েছি তা বিচার করে কোনো সন্দেহ ছিল না যে দনবাসে আরেকটি রক্তাক্ত শাস্তিমূলক অপারেশন শুরু করার জন্য ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে সব কিছু ঠিক করা হচ্ছিল। আমি আপনাদের মনে করিয়ে দিই যে ২০১৪ সালে, কিয়েভ সরকার তার কামান, ট্যাঙ্ক এবং যুদ্ধবিমান দনবাসে যুদ্ধ করার জন্য পাঠিয়েছিল।” 

তিনি আরও বলেন, “আমরা সবাই দোনেৎস্ককে লক্ষ্য করে বিমান হামলার এরিয়াল ফুটেজ মনে রেখেছি। অন্যান্য শহরগুলিও বিমান হামলার শিকার হয়েছে। ২০১৫ সালে, অবরোধ বহাল রেখে এবং বেসামরিক নাগরিকদের গোলাগুলি ও সন্ত্রাস চালিয়ে যাওয়ার সময় তারা আবার দনবাসের বিরুদ্ধে সম্মুখ আক্রমণ করার চেষ্টা করেছিল। আমি আপনাদের মনে করিয়ে দিই যে এই সবই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক গৃহীত নথি এবং প্রস্তাবের সম্পূর্ণ বিরোধিতা ছিল, কিন্তু সবাই এমন ভান করেছিল যেন কিছুই ঘটছে না।” 

যুদ্ধের দায় ইউক্রেনের নয়া-নাৎসি শক্তির ও পশ্চিমা শক্তির ঘাড়ে চাপিয়ে পুতিন বলেন, “আমি আবারও বলছি যে তারাই এই যুদ্ধ শুরু করেছিল, আমরা এখন শক্তি প্রয়োগ করেছি এবং তা যুদ্ধ থামাতে ব্যবহার করছি।” তিনি পশ্চিমাদের যুদ্ধবাজির দায়ে অভিযুক্ত করেন ও তথ্য দেন কী ভাবে বিশ্বের দরিদ্রদের বঞ্চিত করে পশ্চিমা শক্তি যুদ্ধে অর্থ লগ্নি করছে।  

পুতিন ফেডারেল অ্যাসেম্বলির ভাষণে বলেন, “যখন পশ্চিমারা সীমাহীন শক্তি চায়, আমরা মানুষের জীবন এবং আমাদের সাধারণ বাসস্থান রক্ষা করছি। এরা ইতিমধ্যে কিয়েভ শাসনকে সাহায্য ও সশস্ত্র করতে ১৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলার খরচ করেছে। আপনাদের একটা ধারণা দিই, অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অনুসারে বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলিকে সাহায্য করার জন্য জি-৭ দেশগুলি ২০২০-২১ সালে প্রায় ছয় হাজার কোটি মার্কিন ডলার বরাদ্দ করেছে। এটা পরিষ্কার তো? তারা যুদ্ধে ১৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে, যখন দরিদ্রতম দেশগুলিকে ছয় হাজার কোটি ডলার দিয়েছে, সব সময় তাদের যত্ন নেওয়ার ভান করা সত্ত্বেও, এবং সুবিধাভোগী দেশগুলির পক্ষ থেকে এই সমর্থনকে আনুগত্য করার জন্য শর্তযুক্ত করেছে। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই, টেকসই উন্নয়ন এবং পরিবেশ রক্ষার এই সব কথা কী? কোথায় গেল সে সব? সব কি হারিয়ে গেছে? ইতিমধ্যে, তারা যুদ্ধের প্রচেষ্টায় আরও অর্থ সরবরাহ করে চলেছে। তারা আগ্রহের সাথে বিশ্বের অন্যান্য দেশে অস্থিরতা বপন এবং সরকারী অভ্যুত্থানকে উৎসাহিত করতে বিনিয়োগ করে।” 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আগ্রাসন কে সমালোচনা করে পুতিন ফেডারেল অ্যাসেম্বলি কে জানান, “মার্কিন বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০০১ সালের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক সংঘটিত যুদ্ধে প্রায় নয় লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছিল এবং ৩.৮ কোটিরও বেশি শরণার্থী হয়েছিল। দয়া করে মনে রাখবেন, আমরা এই পরিসংখ্যান উদ্ভাবন করিনি; আমেরিকানরাই তাদের জোগান দিচ্ছে। তারা এখন কেবল মানবজাতির স্মৃতি থেকে এই সমস্ত মুছে ফেলার চেষ্টা করছে এবং তারা ভান করছে যে এই সমস্ত কিছুই ঘটেনি। যাইহোক, বিশ্বের কেউ এটি ভুলতে পারেনি বা ভুলবে না।” 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচারযন্ত্র সম্পর্কে পুতিন ফেডারেল অ্যাসেম্বলির ভাষণে বলেন, “তাদের কেউই মানুষের হতাহত এবং ট্র্যাজেডির বিষয়ে চিন্তা করে না কারণ অবশ্যই অনেক লক্ষ কোটি ডলার ঝুঁকিতে রয়েছে। তারা গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার ছদ্মবেশে সবাইকে লুণ্ঠন করতে পারে, নব্য উদারনৈতিক এবং মূলত সর্বগ্রাসী মূল্যবোধ চাপিয়ে দিতে, সমগ্র দেশ ও জাতিকে ব্র্যান্ড করতে, তাদের নেতাদের প্রকাশ্যে অপমান করতে, তাদের নিজ দেশে ভিন্নমতকে দমন করতে এবং দুর্নীতি কেলেঙ্কারি থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিতে পারে একটি শত্রু ইমেজ তৈরি করে। আমরা টেলিভিশনে এই সব দেখতে থাকি, যা বৃহত্তর অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং আন্তঃজাতিগত সমস্যা, দ্বন্দ্ব এবং মতবিরোধ তুলে ধরে।” 

ইউক্রেনের সেনা বাহিনী যে নাৎসিবাদের থেকে, নাৎসি জার্মানির থেকে অনুপ্রেরণা নেয়, সেই প্রসঙ্গে পুতিন তাঁর ভাষণে কিছু তথ্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “বেশ সম্প্রতি, ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর একটি ব্রিগেডকে একটি নাৎসি বিভাগের নামানুসারে এডেলউইস নামকরণ করা হয়েছিল যার কর্মীরা ইহুদিদের নির্বাসন, যুদ্ধবন্দীদের মৃত্যুদণ্ড এবং যুগোস্লাভিয়া, ইতালি, চেকোস্লোভাকিয়া এবং গ্রীসে পার্টিজানদের বিরুদ্ধে দমনমূলক অপারেশন পরিচালনায় জড়িত ছিল। আমরা এই বিষয়ে কথা বলতে লজ্জিত, কিন্তু তারা হয় না। ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনী এবং ইউক্রেনীয় ন্যাশনাল গার্ডের সাথে কর্মরত কর্মীরা বিশেষভাবে শেভরন পছন্দ করে যা আগে দাস রাইখ, টোটেনকফ (মৃত্যুর প্রধান) এবং গালিচিনা বিভাগ এবং অন্যান্য এসএস ইউনিটের সৈন্যদের দ্বারা পরিধান করা হয়েছিল। তাদের হাতও রক্তে রঞ্জিত। ইউক্রেনীয় সাঁজোয়া যানে নাৎসি জার্মান ওয়েহরমাখটের চিহ্ন রয়েছে।” 

রাশিয়ার বিশেষ সামরিক অভিযান যে আসলে ইউক্রেনের জনগণের বিরুদ্ধে নয় বরং পশ্চিমা মদদপুষ্ট নয়া-নাৎসি শাসকদের বিরুদ্ধে, সেই বিষয়টা উল্লেখ করে পুতিন বলেন, “আমরা ইউক্রেনের জনগণের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত নই। আমি অনেকবার এটা স্পষ্ট করেছি। ইউক্রেনের জনগণ কিয়েভ শাসকদের এবং তাদের পশ্চিমা পরিচালকদের হাতে বন্দি হয়ে পড়েছেন, যারা প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক অর্থে সেই দেশটিকে দখল করে রেখেছে এবং কয়েক দশক ধরে ইউক্রেনের শিল্পকে ধ্বংস করে চলেছে কারণ তারা এর প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠন করেছে।” 

পুতিন অভিযোগ করেন যে পশ্চিমা শক্তি নিজের হার অবশ্যম্ভাবী দেখে বারবার রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভুয়া প্রচার করে জনমত কে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। পুতিন ফেডারেল অ্যাসেম্বলির ভাষণে বলেন, “তারাও (পশ্চিমা শক্তিগুলো) বুঝতে পারে যে যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়াকে পরাজিত করা অসম্ভব এবং প্রাথমিকভাবে তরুণ প্রজন্মকে লক্ষ্য করে আমাদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান আক্রমণাত্মক তথ্য যুদ্ধ পরিচালনা করছে।”  

রাশিয়ার ভিতরে ও বাইরে যারা এই যুদ্ধে পশ্চিমাদের সহযোগিতা করছে, তাদের সমালোচনা করে পুতিন বলেন, “পশ্চিমারা আমাদের সমাজকে দুর্বল ও বিভক্ত করার চেষ্টা করবে এবং বেইমানদের উপর বাজি ধরতে চাইবে, যারা ইতিহাস জুড়ে, এবং আমি এটিকে জোর দিয়ে বলতে চাই, তাদের নিজস্ব পিতৃভূমির প্রতি অবজ্ঞার একই বিষ ব্যবহার করে আসছে এবং যে কেউ এর জন্যে অর্থ দিতে ইচ্ছুক, তাকেই এই বিষ বিক্রি করে অর্থোপার্জনের আকাঙ্ক্ষা এদের রয়েছে।” 

তবে পুতিন বলেন যে ইউক্রেনের সরকারের মতন রাশিয়ার সরকার নিজ দেশে নয়া-নাৎসিবাদের বিরুদ্ধে চালিত বিশেষ সামরিক অভিযানের বিরোধীদের উপর কোনো প্রতিহিংসামূলক আক্রমণ নামিয়ে আনবে না। পুতিন বলেন, “যারা আমাদের সমাজের নিরাপত্তা এবং দেশের আঞ্চলিক অখণ্ডতার বিরুদ্ধে সরাসরি বিশ্বাসঘাতকতা, সন্ত্রাসী এবং অন্যান্য অপরাধের পথে নেমেছে, তারা আইনের অধীনে এর জন্য দায়বদ্ধ হবে। কিন্তু আমরা কখনই কিয়েভ শাসন এবং পশ্চিমা অভিজাতদের মতো আচরণ করব না, যারা প্রতিহিংসামূলক আক্রমণে  জড়িত ছিল এবং এখনও জড়িত। যারা পিছিয়ে যায় এবং তাদের মাতৃভূমির থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, আমরা তাদের সাথে প্রতিযোগিতা করব না। এটা তাদের বিবেকের উপর থাকুক, তারা এটা নিয়ে বাঁচুক –– তাদের এটা নিয়েই বাঁচতে হবে। মূল বিষয় হল আমাদের জনগণ, রাশিয়ার নাগরিকরা তাদের একটি নৈতিক মূল্যায়ন করেছে।” 

গত বছর দনবাস অঞ্চলে গণভোটের মাধ্যমে দোনেৎস্ক ও লুগানস্ক গণপ্রজাতন্ত্রগুলো রাশিয়ান ফেডারেশনে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে, যা ইউক্রেন ও পশ্চিমা শক্তি নাকচ করেছে। এই অঞ্চল প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপতি পুতিন ফেডারেল অ্যাসেম্বলির ভাষণে বলেন, “আমরা ইতিমধ্যে ফেডারেশনের মধ্যে এই নতুন অঞ্চলগুলির জন্য একটি বড় আর্থ-সামাজিক পুনরুদ্ধার এবং উন্নয়ন কর্মসূচি শুরু করেছি এবং তা প্রসারিত করব। এর মধ্যে রয়েছে উৎপাদন সুবিধা, চাকরি, এবং আজভ সাগরের বন্দর পুনরুদ্ধার করা, যেটি আবার রাশিয়ার স্থলবেষ্টিত সাগরে পরিণত হয়েছে, এবং নতুন, আধুনিক রাস্তা তৈরি করা, যেমনটি আমরা ক্রিমিয়াতে করেছি, যেটি এখন পুরো রাশিয়ার সাথে একটি নির্ভরযোগ্য স্থল পরিবহন করিডোর হয়েছে। আমরা অবশ্যই একসাথে এই সমস্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করব।” 

রাশিয়ার ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযানের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে ২৪শে ফেব্রুয়ারি, আর এই সময়ে পুতিন ফেডারেল অ্যাসেম্বলির ভাষণে যে ভাবে পশ্চিমা শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন ও রাশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি কে জনসমক্ষে আবার তুলে ধরেছেন তার ফলে পশ্চিমা শক্তিগুলোর অস্বস্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যেই কিয়েভ ও পোল্যান্ডে মার্কিন রাষ্ট্রপতি বাইডেন যে ভাবে যুদ্ধ চালু রাখার অভিপ্রায় প্রকাশ করলেন তাতে রুশ রাষ্ট্রপতির এই সংঘর্ষ কে পশ্চিমাদের রাশিয়ার বিরুদ্ধে ছায়া যুদ্ধ বলে চিহ্নিত করা যে যুক্তিপূর্ণ, তা আবার প্রমাণিত হচ্ছে।

Leave a comment
scroll to top