Close

রাষ্ট্র ভাষা: মানুষের সমস্যা বাদ দিয়ে কি বাংলার সঙ্কটমোচন সম্ভব?

ভাষা বেঁচে থাকে রক্তমাংসের মানুষের উচ্চারণের মধ্যে দিয়ে। তাই মানুষের বাস্তব পরিস্থিতি, তার টিকে থাকা, তার বাস্তব সমস্যার সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে ভাষার সমস্যা, ভাষার বিকাশ অথবা বিনাশ বা ভাষার ভবিষ্যৎ। উল্টো দিকে নির্দিষ্ট ভাষার ভবিষ্যৎ ঐ ভাষার মানুষের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে। বাঙালিও তার ব্যাতিক্রম নয়।

বাংলা বনাম হিন্দি ভাষা: সমস্যার মূল কোথায়?

ভাষা বেঁচে থাকে রক্তমাংসের মানুষের উচ্চারণের মধ্যে দিয়ে। তাই মানুষের বাস্তব পরিস্থিতি, তার টিকে থাকা, তার বাস্তব সমস্যার সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে ভাষার সমস্যা, ভাষার বিকাশ অথবা বিনাশ বা ভাষার ভবিষ্যৎ। উল্টো দিকে নির্দিষ্ট ভাষার ভবিষ্যৎ ঐ ভাষার মানুষের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে। বাঙালিও তার ব্যাতিক্রম নয়।

জনসংখ্যা স্থিতিশীল থাকতে গেলে গড়ে প্রত্যেক নারীর দুই জন সন্তান হতে হয়। অর্থাৎ এই পৃথিবীতে মায়ের একজন প্রতিনিধি এবং বাবার একজন প্রতিনিধি। প্রাকৃতিক কারণে বাবা যেহেতু প্রসবে অক্ষম তাই সন্তান প্রসবের দায় মায়ের ঘাড়েই বর্তায়। প্রতি মহিলা পিছু সন্তান প্রসবের গড় দুইয়ের থেকে বেশি হলে জনসংখ্যা বাড়ে, দুইয়ের কম হলে জনসংখ্যা কমে যায়।

নোয়েমার তথ্য থেকে জানা যায় ১৯৫০ সালে ভারতে গড়ে একজন নারীর ৫.৯ টি সন্তান হত। ২০১৮ সালে এই সর্বভারতীয় গড় কমে দাঁড়িয়েছে ২.২২। সুতরাং সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে ভারতের জনসংখ্যা স্থিতিশীল। এবার দেখা যাক রাজ্য ভিত্তিক অবস্থা।

অ-হিন্দিভাষী রাজ্যগুলোর পরিস্থিতি

২০১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গে গড়ে একজন নারীর সন্তান হয় ১.৫টি, তামিলনাড়ুর ১.৬টি, পাঞ্জাবের ১.৬টি, কেরালায়  ১.৭টি, অন্ধ্রপ্রদেশ ১.৬টি। সুতরাং এই অ-হিন্দিভাষী রাজ্যগুলোয় জনসংখ্যা কমছে এবং তরুণ প্রজন্মের তুলনায় বৃদ্ধ বৃদ্ধার সংখ্যা বাড়ছে। তাহলে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে জনসংখ্যা স্থিতিশীল হল কী ভাবে? 

হিন্দি-ভাষী রাজ্যগুলোর মধ্যে একজন নারী গড়ে সন্তান প্রসব করে রাজস্থানের ২.৫টি, মধ্য প্রদেশের ২.৭টি, উত্তর প্রদেশের ২.৯টি, এবং বিহারের ৩.২টি। 

সুতরাং দেখা যাচ্ছে ভারতের বিপুল জনসংখ্যা এখনো পর্যন্ত স্থিতিশীল হলেও তার মধ্যে হিন্দিভাষীদের অনুপাত বাড়ছে। ফলত স্বাভাবিক ভাবেই অ-হিন্দিভাষী উন্নত এলাকায় হিন্দিভাষী মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে আগামী দিনে। হিন্দি-ভাষী মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ হলে দোকানে, বাজারে,অফিসে, কারখানায় অ-হিন্দিভাষী রাজ্যগুলোতেও কোনো জোর না খাটালেও স্বাভাবিক ভাবে সংখ্যালঘু আঞ্চলিক ভাষার জায়গায় হিন্দি প্রতিষ্ঠা পাবে। 

বলিউডি সংস্কৃতি বা প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের স্লোগানের মধ্যে দিয়েও হিন্দির ব্যাপক আধিপত্য ইতিমধ্যে তৈরি হয়ে চলেছে। অর্থনীতি বড় হলে বাজারের বিস্তারের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন ভাষা সংস্কৃতি মিশবে, নতুন কিছুর জন্ম হবে, পুরানো অনেক কিছু হারিয়ে যাবে সময়ের স্বাভাবিক গতিতে। কিন্তু যা পরিকল্পিত, যা চাপিয়ে দেওয়া, যা একটা ভাষাকে আক্রমণের মধ্যে দিয়ে এক আত্ম বিস্মৃত, নিজের ভাষা সংস্কৃতি নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগা মানুষের জন্ম দেয়, তা আসলে একটি জাতি এবং তার জীবন জীবিকাকেই ধ্বংস করে।

শুধু হিন্দিভাষী মানুষ পশ্চিমবঙ্গে ব্যবসা বা চাকরি করতে আসছে এমনটা নয়। বাংলার গ্রাম থেকে বহু অক্ষর পরিচিতিহীন বা স্বল্প শিক্ষিত মানুষ বাইরের রাজ্যে যান জীবিকার সন্ধানে। তাদের মধ্যে সংযোগ সাধনকারী দেশীয় ভাষা হিসেবে হিন্দি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বলে অনেকের মত। 

পশ্চিমবঙ্গের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ইমানুল হককে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি ইস্ট পোস্ট বাংলা  কে বলেন, “প্রথমত আমাদের রাজ্য থেকে হিন্দি বেল্টে কাজ করতে যায় খুব কম। কাজ করতে যায় এখন দক্ষিণ ভারতে বেশী। তারা শিখে নেয়, তারা যখন যে রাজ্যে যায়, তারা ভালোই শিখে নেয়। মানুষ তার পেটের প্রয়োজনে মুখের ভাষা শিখে নেয়। তার জন্য আগে তাকে হিন্দি শিখিয়ে পাঠাতে হবে, এমন কোনো মানে নেই।…ইংরেজি জানলে চাকরি হলে ইংল্যান্ডে এত বেকার কেন? হিন্দি জানলে চাকরি হলে উত্তর প্রদেশে এত বেকার কেন? বিহারে এত বেকার কেন? ওরা আগে বেকার সমস্যার সমাধান করুক… আমরা মাতৃভাষা শিখছি এটাই যথেষ্ট। প্রয়োজনে মানুষ অন্য ভাষা শিখে নেবে।”

ব্রিটিশ আমল থেকেই ভারতের ব্যবসাদারদের মধ্যে প্রাধান্যকারি গুজরাটি ও মাড়োয়ারি বেনিয়ারা ঐক্যবদ্ধ বাজার এবং ঐ বাজারে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখার স্বার্থে হিন্দি ভাষা, হিন্দু ধর্মের ভিত্তিতে হিন্দুস্থান গঠনের ধারণার প্রচার এবং প্রসারে ব্যাপকভাবে পয়সা ঢালতো। ভারতের জাতীর জনক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, যিনি জাতিতে একজন গুজরাটি বেনিয়া এবং বিড়লা গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ ছিলেন, হিন্দির প্রচার এবং প্রসারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন।

ইংরেজ শাসকেরা চলে যাওয়ার পরে ইংরেজির বদলে কোন ভারতীয় ভাষাকে সরকারী ভাষার মর্যাদা দেওয়া হবে, এই নিয়ে গণপরিষদের সদস্যরা প্রবল বিতর্কের সম্মুখীন হন। অবশেষে  মুন্সী আয়েঙ্গারের খসড়া প্রস্তাবটি প্রচুর সংশোধনীসহ গৃহীত হয়। মুন্সীর প্রস্তাবের উপর ভিত্তি করেই সংবিধানের সপ্তদশ অংশটি রচনা করা হয়। সংবিধানের ৩৪৩ ধারায় বলা হয় যে দেবনাগরী হরফে লিখিত হিন্দি ভারতের সরকারি ভাষা হিসেবে বিবেচিত হবে। কিন্তু সংবিধান প্রচলিত হওয়ার ১৫ বছর  পর্যন্ত ইংরেজি আগের মতই সরকারি ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। ১৫ বছর পরে সংসদে আইন প্রনয়নের মাধ্যমে ইংরেজির ব্যবহার চালু রাখা যাবে। সুতরাং আইন পাশ করে ইংরেজি ব্যবহারের সময় সীমা বাড়ানো গেলেও, হিন্দিকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানের কথা সংবিধানে রয়েই গেছে। ৩৫১ নং ধারায় স্পষ্ট বলা হয়েছে ইউনিয়ন সরকাদের দ্বায়িত্ব হল হিন্দির প্রচার এবং প্রসার করা।

সংবিধান চালুর সময় অষ্টম তফসিলে মোট ১৪টি ভারতীয় ভাষার উল্লেখ ছিলো। ভাষাগুলো হল অসমীয়া, বাংলা, গুজরাটি, হিন্দি, কানাড়া, কাশ্মীরি, মালয়ালাম, মারাঠি, ওড়িয়া, পাঞ্জাবী, সংস্কৃত, তামিল, তেলেগু এবং উর্দু। পরবর্তীতে  সিন্ধী, নেপালি, কোঙ্কনি, মনিপুরি, বোড়ো, ডোগরি, মৈথিলী, সাঁওতালি ভাষাকে সংবিধানের অষ্টম তফসিলে যুক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে মোট ২২টি ভাষা আছে। তবুও হিন্দির প্রতি ঐতিহাসিক পক্ষপাতিত্ব স্পষ্ট। 

সংবিধানের ৩৪৪(১) নং ধারা অনুযায়ী ১৯৫৫ সালে বালাসাহেব গঙ্গাধর খারের নেতৃত্বে প্রথম ভাষা গবেষণা কমিশন গঠিত হয়। বাইশ জন সদস্যকে নিয়ে গঠিত ঐ কমিশন ১৯৫৬ সালে তার প্রতিবেদন পেশ করে। প্রতিবেদনে সরকারী কাজ কর্মের ক্ষেত্রে ইংরেজির পরিবর্তে হিন্দি ভাষার অধিকতর ব্যবহারের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হলেও ১৯৬৫ সালের মধ্যে ইংরেজির পরিবর্তে হিন্দি ভাষাকে যে সরকারি ভাষা হিসেবে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করা সম্ভব নয়, সে কথাও বলা হয়। জোর করে ইংরেজি ভাষার ব্যবহারের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করা হয়। 

সর্বভারতীয় স্তরে সরকারী চাকরির নিয়োগের জন্য হিন্দির জ্ঞান থাকা আবশ্যিক করা প্রয়োজন বলে কমিশন মনে করে। বিভিন্ন রাজ্যের বিচার বিভাগীয় এবং প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালনার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের সুপারিশ করা হলেও বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে এবং কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে হিন্দির কথা বলা হয়। শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে আঞ্চলিক ভাষাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হলেও মাধ্যমিক স্তরে হিন্দিকে আবশ্যিক করা প্রয়োজন বলে মত প্রকাশ করা হয়।

খারে কমিশনের প্রতিবেদন ১৯৫৭ সালে সংসদে যৌথ কমিটির কাছে পেশ করা হয়। যৌথ সংসদীয় কমিটি সরকারী ভাষা ইংরেজি থেকে হিন্দিতে পরিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বনের কথা বলে। ইংরেজির পরিবর্তে হিন্দিকে সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহন করার ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া প্রয়োজন নেই বলে কমিটি মনে করে। ১৯৬৫ সালের পর থেকে ইংরেজির পরিবর্তে হিন্দি হবে প্রধান সরকারি ভাষা আর ইংরেজি সহকারী সরকারি ভাষা হিসেবে গণ্য হবে বলে মত প্রকাশ করা হয়।

খারে কমিশন এবং যৌথ সংসদীয় কমিটির মতামত অহিন্দিভাষী রাজ্যগুলো মেনে নেয়নি 

১৯৫৭ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ৫৫জন অহিন্দিভাষী সাংসদ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কাছে এই মর্মে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন যে, সরকারি ভাষা হিসেবে হিন্দিকে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত যেন ১৯৯০ সাল পর্যন্ত স্থগিত করা হয়। 

সেই সময় দিল্লির ইউনিয়ন সরকার এবং রাজ্য সরকার উভয়ই কংগ্রেসের হাতে। কিন্তু ১৯৫৮ সালের ২৬ মার্চ সরকারি ভাষা হিসেবে হিন্দিকে গ্রহণ করার ব্যাপারে অসম্মতি জানিয়ে কংগ্রেস এবং বামপন্থীরা একসাথে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব পাশ করায়।

পাকিস্তান সরকারের পথে না হেঁটে প্রধানমন্ত্রী নেহরু কিছুটা পিছিয়ে আসেন, ভারতে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের হিন্দি-বিরোধী মনোভাবের পরিচয় পেয়ে ১৯৫৯ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর সংসদে ঘোষণা করেন যে, যতদিন লোকে প্রয়োজনীয় মনে করবে ততদিন ইংরেজি “পরিবর্ত ভাষা” হিসেবে চালু থাকবে এবং অ-হিন্দিভাষী লোকেরাই ইংরেজির বদলে হিন্দিকে গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেবে।

নেহরুর ঘোষণা নরম শোনালেও, ১৯৬০ সালের ১৭ই এপ্রিল রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ যৌথ সংসদীয় কমিটির সুপারিশ গুলোকে কার্যকর করার জন্য  আদেশ জারি করেন। ঐ আদেশ অনুযায়ী ইউনিয়ন সরকারের অধীন সংস্থায় কর্মরত সরকারী কর্মীদের জন্য হিন্দি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তর, ডাক ও তার বিভাগ ঐ মর্মে কর্মচারীদের উপর বিভিন্ন বিজ্ঞপ্তি জারি করে।

এর প্রক্রিয়ায়, ১৯৬০ সালের ১৬ই নভেম্বর পাঞ্জাবের বিধানসভায় সরকারী ভাষা আইন পাশ করে বলা হয়, গুরুমুখী হরফে লিখিত পাঞ্জাবী এবং দেবনগরী হরফে লিখিত হিন্দি যথাক্রমে পাঞ্জাবের পাঞ্জাবী-ভাষী এবং হিন্দি-ভাষী অঞ্চলে সরকারী ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হবে। 

১৯৬১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা দার্জিলিং জেলা ছাড়া রাজ্যের সর্বত্র ইংরেজির পরিবর্তে বাংলাকে রাজ্যের সরকারী ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। 

অসম বিধানসভায় ১৯৬০ সালে ইংরেজি ও হিন্দির পরিবর্তে অসমীয়া ভাষাকে রাজ্যের সরকারী ভাষা হিসবে গ্রহণ করা হয়। কিন্তু অসমে বসবাসকারী বাঙালিরা বাংলা ভাষাকে অসমের অন্যতম সরকারী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানের দাবিতে “সংগ্রাম পরিষদ” এর নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু করে। অবশেষে অসম সরকার ১৯৬১ সালের ৭ই অক্টোবর ১৯৬০ সালে প্রণীত সরকারি ভাষা সম্পর্কিত আইনিটি সংশোধন করে বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে সরকারী ভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দেয়।

বিভিন্ন রাজ্যের বিরূপ প্রতিক্রিয়াত ফলে ১৯৬১ সালের অক্টোবর মাসে ইউনিয়ন সরকার নয়া দিল্লিতে একটি ‘জাতীয় সংহতি সম্মেলন’ এর আয়োজন করে। ঐ সম্মেলন থেকে দেশের সর্বত্র প্রাথমিক স্তরে “ত্রি ভাষা সূত্র” লাগুর সুপারিশ করা হয়। সুপারিশে বলা হয় অ-হিন্দি ভাষাভাষী অঞ্চলে একটি আঞ্চলিক ভাষা, ইংরেজি এবং হিন্দি শিক্ষার ব্যবস্থা করা অন্যদিকে হিন্দি ভাষাভাষী অঞ্চলে হিন্দি ইংরেজি ছাড়া অন্য একটি ভারতীয় ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করা। বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজির বদকে আঞ্চলিক ভাষার ব্যাবহার এবং বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর মধ্যে যোগাযোগের ভাষা হিসেবে ইংরেজির বদলে হিন্দিকে গ্রহণ করার কথা সুপারিশে বলা হয়।

১৯৬৩ সালের ১৩ই এপ্রিল ইউনিয়ন সরকার লোকসভায় সরকারি ভাষা বিল নিয়ে আসে। পূর্বে উল্লিখিত সংবিধানের ৩৪৩ নং ধারার আওতাতেই এই বিলে বলা হয় ১৯৬৫ সালের ২৬ জানুয়ারির পরেও হিন্দির পাশাপাশি ইংরেজিও পূর্বের মতই ইউনিয়নের এবং পার্লামেন্টের কাজকর্ম পরিচালনায় ব্যবহার হবে। এই আইনে বলা হয়, জম্বু ও কাশ্মীর ছাড়া যে সব রাজ্য হিন্দি ছাড়া অন্য কোনো ভাষাকে রাজ্যের সরকারী ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছে সেই সব রাজ্যের আইন সভা প্রণীত সব আইনকেই হিন্দি এবং ইংরেজিতে অনুবাদ করতে হবে। ১৯৬৫ সালের জানুয়ারি মাসের পরে কোনো রাজ্যের রাজ্যপাল হিন্দি বা কোনো আঞ্চলিক সরকারী ভাষায় রাজ্য হাইকোর্টের রায়, আদেশ বা ডিক্রি জারির অনুমতি দিলেও সেগুলির ইংরেজি অনুবাদ করতে হবে।

বহু বিতর্কের পর সরকারি ভাষা বিলটি ২৭শে এপ্রিল লোকসভায় এবং ৭ই মে রাজ্যসভায় গৃহীত হয়। যদিও এই আইনটি নিয়ে অ-হিন্দি ভাষাভাষী অঞ্চল গুলোতে, মূলত দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে, ব্যাপক বিতর্ক শুরু হয়। ১০ই জুন দ্রাবিড় মুনেত্রা কাঝগামের (ডিএমকে) সাধারণ পরিষদে এই আইনিটিকে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের অগ্রগতির চক্রান্ত বলে অবিহিত করা হয়। প্রত্যক্ষ সংগ্রামের অংশ হিসেবে সংবিধানের সপ্তদশ অধ্যায়ের হাজার হাজার অনুলিপি পোড়ানো হয়। মাদ্রাসে সরকারি ভবন গুলোতে পিকেটিং শুরু হয়। এই আন্দোলন অন্ধ্র, কেরল, পশ্চিমবঙ্গেও ছড়িয়ে পড়ে।

১৯৬৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী বেতার ভাষণে বলেন যত দিন মানুষ চাইবেন ততদিন ইংরেজি পরিবর্ত ভাষা হিসেবে চালু থাকবে এবং যে দিন অহিন্দিভাষী মানুষেরা ইংরেজির বদলে  হিন্দিকে সরকারি ভাষা হিসেবে চাইবেন, সে দিনই এই বদল হবে। এই ঘোষণার প্রক্ষিতে ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বরে ১৯৬৩ সালের আইনটিকে সংশোধন করে বলা হয় সর্বভারতীয় সরকারি পরীক্ষার মাধ্যম হিসেবে হিন্দির পাশাপাশি ইংরেজি চালু থাকবে।

হিন্দি বিরোধী বিক্ষোভের মুখে কংগ্রেস সরকার যে নমনীয় ধীরে চলো নীতি নিয়েছিলো, স্বাভাবিক ভাবেই ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নীতি তার থেকে কিছুটা আলাদা হতে বাধ্য। যদিও কংগ্রেসের মত বিজেপিও সংবিধানের ঘোষিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথেই এগিয়ে যাচ্ছে বলা যায়। যখন অহিন্দিভাষী মানুষেরা আর ৫০/৬০ দশকের মত হিন্দি বিরোধীতায় তেমন সক্রিয় নয়, তখন অবলীলায় নোটবন্দির পরে ছাপা নোট গুলোতে বড় আকারে হিন্দি সংখ্যা জ্বলজ্বল করে।

বাঙালিরা বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস উপহার দিয়েছে

১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের গণপরিষদে ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে সমান মর্যাদা দেওয়ার দাবি উত্থাপন করে ভাষণ দেন হিন্দু বাঙালি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী তাঁকে হত্যা করে। ১৯৫২ সালে যারা বাংলা ভাষার জন্য পাকিস্থানি শাসকে গুলিতে প্রাণ দেন তারা জন্ম সূত্রে মুসলিম ধর্মালম্বী, রফিক, জব্বার, বরকত, ও সামাদ। তবুও বাংলাদেশে কান পাতলে এই প্রশ্ন শোনা যায় “বাঙালি নাকি হিন্দু?” পশ্চিমবঙ্গে শোনা যায় “বাঙালি নাকি মুসলিম?”  বিভাজিত জাতির পক্ষে জাতীয় সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়, এটা নতুন করে বলার কথা নয়।

বাংলাভাষার সমস্যা বাঙালির প্রধান সমস্যা না হয়ে পাড়ে না। কারণ বাঙালি হওয়ার প্রাথমিক শর্তটাইতো তার ভাষা। বাংলা ভাষা কাজের ভাষা না থাকলে, এই ভাষায় ক্রমে আড্ডাও উঠে যাবে। অন্য ভাষায়, যা বাঙালির নিজের ভাষা নয়, সেই ভাষায় বাঙালি অবশ্যই পিছিয়ে যাবে, সেই ভাষা যাদের মাতৃভাষা, তাদের কাছে। সুতরাং বাংলা ভাষায় কথা বলা মানুষদের বাস্তব সমস্যা গুলোর বাস্তব সমাধান ছাড়া, ভাষা নিয়ে আবেগি চর্চা অরণ্যে রোদনে পরিনত হতে বাধ্য।

লেখক

  • সৌম্য মন্ডল

    সৌম্য মন্ডল একজন আর্থ-সামাজিক এবং ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তিনি ইস্ট পোস্ট বাংলায় মুখ্য সম্পাদক হিসাবে কর্মরত। মূলত উদীয়মান বহু-মেরুর বিশ্বের নানা ঘটনাবলীর তিনি বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করেন।

    View all posts

সৌম্য মন্ডল একজন আর্থ-সামাজিক এবং ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তিনি ইস্ট পোস্ট বাংলায় মুখ্য সম্পাদক হিসাবে কর্মরত। মূলত উদীয়মান বহু-মেরুর বিশ্বের নানা ঘটনাবলীর তিনি বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করেন।

Leave a comment
scroll to top