সৌদির চিঠি: বিদেশে বাঙালি ডেলিভারি বয়দের গল্প(পর্ব ১৪)
খুব বেদনাদায়ক এক সপ্তাহ এখন কলকাতায়। খবর যেন আর চালানো যাচ্ছে না, এতদূরে থেকেও। এখানে পড়ে পড়ে ছাত্র আত্মহত্যার এই ধরনের খবর দেখে এবং আমারি চেনা ছাত্র বন্ধু দের এই মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে আন্দোলন-বিতর্ক করতে দেখে আরো যেন প্রান আনচান করছে। কিন্তু কিরকম অদ্ভুত ভাবে, এইখানে শ্রমিকদের যখন এই বিষয় নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা নেই। ব্যাপারটা ভীষণ নির্মম লাগলেও এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। এই দুর্ঘটনা ঘটার সময়ে যাদবপুরের গ্রুপ ডি স্টাফরাও নিজেদের এরকম একই এক ব্যাপার নিয়ে সোচ্চার হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু কেউ কানেই তোলেননি। যেন সাফাই কর্মী, পাচক, অর্থাৎ যেকোনো প্রতিষ্ঠানের গ্রুপ ডি স্টাফের দাবি, আবেদনের কোনো মুল্যই নেই। কেমন এক ভয়াবহ শ্রেণী বিভাজনের দর্শন যেন প্রচলিত হয়ে থাকছে, আমাদের অজান্তেই, সমস্ত ক্ষেত্রে।
এইরকম এক নিদর্শনের অভিজ্ঞতা নিয়েই আজ বলবো। বিষয়টা সম্পূর্ণ আমার নিজের বিশ্লেষণ, এই ধারনা এবং বক্তব্য গুলোর জন্য অন্য কোনো ব্যাক্তি আমাকে সরাসরি এই নিয়ে কিছু বলেননি অথবা কোনো রকম প্রভাব খাটায়নি। এই মতামত সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত, এই নিয়ে কেউ যদি অন্যরকম ধারণা পোষণ করেন তাহলে সেই নিয়ে আলোচনায় বসতে উৎসাহিত হবো।
আমার নতুন কিছু মানুষের সাথে এখানে পরিচয় হয়েছে। আক্ষরিক অর্থে এবং যেন একটু ব্যঙ্গ করেই, নতুন মানুষজন একেবারে। কলকাতার মধ্য শ্রেণী হিন্দু পরিবারদের কথা বলছি। ব্যাপারটা রসিকতা লাগতে পারে কিন্তু এতদিন পর এনাদের যেন নতুন মানুষ হিসেবেই আমার মনে হচ্ছে! আমি নিজে যেহেতু এক মিডল ক্লাস কলকাতার বাঙালি পরিবার থেকে, তাই এনারা আমাকে স্বাভাবিক ভাবেই নিজেদের অংশ হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছেন। কত সহজেই যেন হয়ে গেল ব্যাপারটা। আসলে অনেকেই মনে করেন যে সৌদি আরবে কলকাতার মানুষ নাকি আসেন না, শুধু বাংলাদেশের বাঙালী রাই আসেন, তাও শ্রমিক, চাষা সম্প্রদায়ের মানুষজন। মধ্যবিত্ত, উচ্চ শ্রেনীর মানুষ সৌদি আরবে কেন আসতে যাবে আবার, এইরকম এক ধারনা অনেকের মনে। এটা হওয়ার কারন তারা সৌদি আরব, এবং সমগ্র মিডল ইস্ট এক লেবার দেওয়ার জায়গা হিসেবে ভেবে নিয়েছেন। এখানে আমি বাঙালি শ্রমিকদের কথা বলছি, যারা ধরেই নিয়েছেন যে এখানে আমরা শুধু আরবি মনিবদের চাকর হিসেবেই আসি। কথাটা খুব একটা ভুল নয়, কেউ হয়তো শারীরিক শ্রম দিতে এসেছেন আর কেউ নিজেদের পড়াশোনার জোরে ভালো কোনো চাকরি নিয়ে উপস্থিত। কিন্তু তাদের মধ্যেও যে কতটা শ্রেণী বিভাজন রয়ে গেছে এবং রীতিমতো বাড়তে থাকছে, তা হয়তো আমি নিজে নিজের জন্মগত শ্রেণী যুক্ত সুবিধার গন্ডি থেকে না বেরোলে বুঝতাম না।
কলকাতার বেহালার জনৈক এক ব্যক্তি, সায়ন্তন দা(নাম পরিবর্তিত), আমার কোম্পানি তে হেড অফিসে উঁচু পোস্টে চাকরি করেন, বেশ মোটা মাইনে তে। তিনি আমাকে পেয়ে যেন উৎফুল্ল, এতদিন পর কলকাতার বাঙালি পেয়ে! “আরে কিছু না হোক একটু ভালো করে আড্ডা তো মারা যাবে, এই বাংলাদেশি আর পাকিস্তানি দের সাথে আর কত পারবো…” এই ওনার বক্তব্য। আমি সম্পূর্ণ সহমত, কলকাতার মানুষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে সারা পৃথিবী ঘুরলেও সে যেন তার পাড়ার মানুষ কেই খুজতে থাকে একটু আড্ডা দেওয়ার জন্য। এনারা যতই “আমার মন বসে না শহরে, ইঁট পাথরের নগরে” গান দিয়ে বাংলাদেশের, গ্রাম বাংলার রিল্স বানান, এনারা নিজেদের ওই মধ্যবিত্ত সার্কল এর বাইরে বেরোতেই পারবেন না। আমি যে কিভাবে বেরিয়ে গিয়ে লেবার দের সাথে আছি, কাজ করছি, সেটা তে সায়ন্তনদা তাজ্জব। তাই বলে এই নয় যে উনি খারাপ ভাবে নিয়েছেন; উনি শুধু অবিশ্বাস্য মনে করছেন যে একজন ব্যবসায়ীর সন্তান হয়ে, দিল্লি তে ভালো ম্যানেজমেন্ট কলেজ থেকে পাস করে কি কারনে এখানে পড়ে আছি! চাকরির জন্য এসেছিলাম সে না হয় এক ব্যাপার, কিন্তু আমার সত্যিই যে কিভাবে এই শ্রমিকদের সাথে মন বসে গেল, এবং এদের সাথেই এখন এতটা স্বচ্ছন্দ হয়ে এদের একজন হয়েই থাকছি, সেটা হয়তো ঠিক হজম হচ্ছে না!
উনি আমাকে একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে অ্যাড করালেন। রিয়াধে কলকাতার বাঙালি দের গ্রুপ। মাত্র ৫০-৫৫ জন মেম্বার, সবাই আমার থেকে অনেকটাই বড়ো বয়সে, এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত হিন্দু। তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই, গ্রুপে হিন্দু জাতীয়তাবাদী পোস্ট বিনিময় দেখে অবাক হলাম না। এ এক ধরনের স্বভাব লক্ষ্য করেছি প্রবাসী বাঙালি হিন্দু দের মধ্যে, তারা যেন বিশেষ করে ভারতের বাইরে পা রেখে বেশ জাতিয়তাবাদী হয়ে যান!
যখন এই কলকাতার মধ্যবিত্ত সমাজ যাদবপুরের বাম এবং ছাত্র ছাত্রীদের সুরক্ষা নিয়ে হঠাৎ করে প্রচন্ড আশঙ্কিত, তখন আমি যেন সেইসব কোলাহলের একদম বাইরে। আমি এখানে আমার নতুন ব্র্যাঞ্চের কর্মচারী দের বানানো শুশি খাচ্ছি, যখন আমার দেশে সর্বত্র আগুন জ্বলছে। বিষয়টা কি খুব গর্বের, নাকি ধিক্কার জনক? এই এতসব ঝামেলার মধ্যে মানুষ বীতশ্রদ্ধ আমার দেশে, কিন্তু আমি তখন আরব রাজ্যে বসে অত্যন্ত দামি শুশি শাঁটাচ্ছি! কেন? কারন যেই লেখাপড়া না জানা কর্মচারী, যে জাপান দেশটার বিষয়েও কিছু জানেনা, সে আমার সাথে পরিচয় হয়ে, আমার খেতে ভালো লাগে শুনে অত্যন্ত ভালোবেসে আমার জন্য বানিয়ে দিয়েছে, যাতে আমি একটু সাহস পাই এই ভেবে যে এই মালিক আর শ্রমিক যে যেই দেশেরই হোক না কেন, আমরা শ্রমিকরা অন্তত মালিকদের নানা দ্বিচারিতার বিরুদ্ধে গিয়ে একে অপরের পাশে থাকবো।