Close

সৌদির চিঠি: শ্রমিক বিক্ষোভে অবশেষে খুলল বাথরুমের দরজা (পর্ব ১৮)

সৌদিতে আরেক আজব কাণ্ড! পরিচ্ছন্ন বাথরুমের অধিকার আদায়ে হয়ে গেল ছোটোখাটো শ্রমিক আন্দোলন। প্রবাসের চিঠিতে লিখছেন পথিকৃৎ।

রিয়াধের বাইরে এক খেজুর বাগানের মধ্যে।

নতুন আর এক কান্ড হয়ে গেল! গত চিঠিতে বলেছিলাম যে আমাদের রুমের একটা বাথরুম আটকে দেওয়া হয়েছে যেটার কারনে ১৫জন স্টাফকে একটাই বাথরুম ব্যবহার করতে হচ্ছে। দ্বিতীয় বাথরুম খোলানোর জন্য এক ছোটোখাটো শ্রমিক আন্দোলন হয়ে গেল! এক লেবানিজ স্টাফ আমাদের শেফের অত্যন্ত কাছের মানুষ হওয়ার সুযোগে নিজেকে কোম্পানির বেশ বড়ো সড়ো কিছু মনে করে, তাই সে এই কান্ড টা করেছিল। তার বক্তব্য, ভারতীয়, নেপালি, বাঙালিরা নাকি অনেক নোংরা তাই তারা “তার লেভেলের ভদ্রলোকের” সাথে একই বাথরুম ব্যবহার করার যোগ্য নয়। সেই কারণে সে তার রুমের পাশের বাথরুম টা শুধুমাত্র নিজের জন্য চাবি দিয়ে রেখে দিয়েছিল। শুনে অথবা পড়ে অনেকেই চটে যেতে পারেন কিন্তু ওই ছেলেটার এমন কাজ এবং ওর নিজের স্বভাবের জন্য আমার বেশ হাস্যকর লেগেছিল। তাই আশা করেছিলাম সবাই মিলে ম্যানেজার কে জানালে নিশ্চয় সমাধান বেরিয়ে আসবে। হলোও তাই, ম্যানেজার তৎক্ষণাৎ নির্দেশ দিলেন বাথরুম খুলে দেওয়ার জন্য। আমি সেই দাবি নিয়ে তার কাছে যেতে সে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল!

শেফ কে জানানো হলো, তিনিও বললেন ব্যবস্থা নেবেন। তবুও লাভ হলো না। এবার আমার মাথা গরম হয়ে গেল…. আর সামলাতে না পেরে দুমদাম করে ওর দরজা ভেঙে দেওয়ার প্রয়াস করতে ও হতচকিত হয়ে যেই খুললো আমি একেবারে তেড়ে গেলাম ওর দিকে, সিনিয়র জুনিয়র সব ভুলে গিয়ে! ততক্ষণে বাকি স্টাফ এগিয়ে এসেছে আমার সমর্থনে, যারা এতদিন আরবি সিনিয়র হিসেবে ওকে বেশ ভয় পাচ্ছিল। কিন্তু আমার রীতিমতো আক্রোশের সামনে ওকে ঘাবড়ে যেতে দেখে সবাই যেন মনে করলো যে হ্যাঁ, এবার একে একটু কোনঠাসা করা গেছে। আর হবেই তাই। একসাথে অতজন শ্রমিক-কে এগিয়ে আসতে দেখলে কোন আদরে বাঁদর হওয়া সুবিধাবাদীর শিরদাঁড়া সোজা থাকে! তৎপরতার সাথে বাথরুম খুলে গেল! তারপরেও সে “দেখে নেবো, জানিস না আমি কে” গজগজ করতে লাগলো আমার দিকে তাকিয়ে। এরকম ব্যবহারের পর সত্যিই আর হাসি চাপতে পারলাম না!

এই ঘটনা গুলো যখন আমরা শ্রমিক-রা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করি তখন আরো অনেক এই ধরনের গল্প বেড়িয়ে আসে। আমাদের পাশাপাশি রেস্টুরেন্টের এক বাংলাদেশের শেফ এর থেকেও সাংঘাতিক এক কাহিনী শোনালেন। যদিও আমি তার সত্যতা যাচাই করিনি। কিন্তু ব্যাপারটা এতই দুর্ধর্ষ যে এখানে তুলে ধরতেই হচ্ছে। তাদের কোম্পানি তেও নাকি এরকম আরবি, লেবানিজ লোকজন ছিল যাদের জন্য টেকা যেত না। আরবি বলে তারা যেন আলাদা হাওয়ায় থাকবে, আমাদের দেশের শ্রমিক-দের অনেক নীচে রেখে দেখবে। তাই এরম এক লেবানিজ ম্যানেজার একদিন যথারীতি চেঁচামেচি করে সবাইকে বিরক্ত করতেই থাকছে। তখন হঠাৎ কয়েকটি বাঙালি স্টাফ একসাথে মিলে তাকে একটু কাছে ডাকলো। সিসিটিভি ক্যামেরার আওতার বাইরে যেতেই ম্যানেজারের টাকে দে এক মার! তারপর বাকি সব বাঙালি কর্মচারী তখন এক হয়ে তাকে গণধোলাই দিতে লাগলেন!

এই ঘটনার পর অবশ্যই গুরুতর পুলিশ কেস হয়ে সেই সমস্ত শ্রমিক-দের জেল হওয়ার কথা, বিশেষ করে রিয়াধে। কিন্তু এক আজব ব্যাপার ঘটলো। শ্রমিকরা তো জানিয়েই দিয়েছিলেন যে কোনো প্রমাণ নেই ওদের বিরুদ্ধে (একমাত্র ম্যানেজারের ফুলে ওঠা টাক মাথা ছাড়া!) তাই তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলেও ওদের কোনো ভয়ডর নেই। কিন্তু দেখা গেল, সেই ম্যানেজার কোনো অভিযোগ করলেনই না। আরবি ম্যানেজার হয়ে একদল বাঙালি শ্রমিকদের হাতে মার খাওয়া তার কাছে এতই লজ্জাজনক যে সে আর এই নিয়ে কোনো কথাই না বাড়িয়ে রিয়াধ থেকে জেড্ডায় ট্রান্সফার নিয়ে পালিয়ে গেলেন, আর তার মাস ছয়েক বাদে একেবারে পাততাড়ি গুটিয়ে সৌদি থেকেই বিদায় হলেন! পুরো কাহিনী টা শুনিয়ে সেই দেশী ভাই, ইসমাইল(নাম পরিবর্তিত) বুক ফুলিয়ে এক বিজয়ী হাসি হাসলেন…

অনেক মারামারি, ঝামেলা ঝক্কির গল্প হলো; এবার নাহয় একটু নরম এবং প্রেমের সুর দিয়ে শেষ করা যাক। এক অদ্ভুত, প্রায় সিনেমার মতো এক প্রেমকাহিনি শোনাতে চাই এখন একটা। আমাদের সাথে এক সমকামী ফিলিপিনো ওয়েটার কাজ করেন, আমারই বয়সী। সে নিজের অবিশ্বাস্য ভালোবাসার গল্প শোনাচ্ছিলো আমাকে। অবিশ্বাস্য কারন তার সমকামী প্রেম এই সৌদি আরবের মাটিতে! এই বিষয় নিয়ে আমি কোনো খুঁটিনাটি বিবরণে যাবোই না, সেই অসাধারণ জুটির স্বার্থে। আসল ব্যাপারটা এই যে সে নাকি সৌদি তে এসেছে তার দীর্ঘদিনের রাশিয়ান প্রেমিকের কাছাকাছি থাকবে বলে, যিনি এই সৌদি আরবেই বসবাস করেন, নিজের পরিচয় গোপন রেখে। এই কথা শুনে আরো চমকে উঠলাম কারণ হালে রাশিয়া সমকামিতা একেবারে নিষিদ্ধ করেছে। সেই কারনেই এই জুটি নিজেদের পরিবারের সাথে একে অপরের পরিচয় করিয়ে, পরিবারের আশির্বাদ নিয়ে, নিজেদের একসাথে থাকার অভিযানে বেরিয়েছে বিশ্বের বিরাট শক্তিশালী দেশগুলোর সম্মুখীন হয়ে! আমি জানতে চাইলাম কি করে সে সাহস পাচ্ছে এমন এক সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যেতে? যেখানে রাশিয়া এবং সৌদির মতো দুটো রক্ষণশীল দেশ জড়িত, যার জন্য মৃত্যুদন্ডও কপালে জুটতে পারে। সে হেসে জানালো, তার দেশে যেহেতু সমকামী বিবাহ বৈধ তাই তারা ফিলিপিন্সে বিয়ে করে ইউরোপের কোনো লিবারেল দেশে পাড়ি দেবে। বিয়ের ব্যবস্থা সে করে নেবে, আর ইউরোপের ব্যবস্থা রাশিয়ার ব্যাক্তিটি করতে পারবে তার রাশিয়ার অধিবাসী হওয়ার দৌলতে। কিন্তু সমকামী বিবাহের পর তার রাশিয়া ফেরা আর কতটা হয়ে উঠবে সেই নিয়ে যথেষ্ট চিন্তা থেকে যাচ্ছে আমার। কিন্তু তাদের ভাব গতি দেখে মনে হলো না যে তারা আর কোনোদিন সেই দেশে যাবে বলে। খাস সৌদি তে এই ধরনের এক দুঃসাহসিক প্রেম দেখে যেন মনে হয় বলিউড কেও ছাড়িয়ে যায়!

Leave a comment
scroll to top