Close

সৌদির চিঠি: বিদেশে বাঙালি ডেলিভারি বয়দের গল্প(পর্ব ১৪)

সৌদিতে ডেলিভারি বয়দের নিয়ে অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। স্বদেশ থেকে বিদেশে যেন অদ্ভুত দাসত্বের ইকোসিস্টেম চলছে। লিখছেন পথিকৃৎ‌।

সৌদিতে ডেলিভারি বয়দের নিয়ে অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। স্বদেশ থেকে বিদেশে যেন অদ্ভুত দাসত্বের ইকোসিস্টেম চলছে। লিখছেন পথিকৃৎ‌।

সৌদির চিঠি: বিচিত্র শহর রিয়াধ (পর্ব ১৩)

বিদেশে দেশি শ্রমিকদের সাথে থাকলে অনেক রকমের দরকারী শিক্ষা পাওয়া যায়। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে বাধ্য করে দেয়। আমার এক ছোট্ট অথচ অত্যন্ত ভাবানোর মতো অভিজ্ঞতা হলো এই সপ্তাহে, সেটা দিয়ে ভূমিকা দিতে চাই। রুমে থাকতে খাবার অর্ডার করেছিলাম, এখানকার এক জনপ্রিয় ফুড ডেলিভারি অ্যাপের মাধ্যমে। এই সব ডেলিভারির কাজে প্রচুর বাংলাদেশী নিযুক্ত। তাই অনেক সময়ে আমি খাবার অর্ডার করার পর ডেলিভারি রাইডারের সাথে ফোনে কথা বলতে অসুবিধা হয়নি। রাইডাররা স্বাভাবিক ভাবেই মনে করেন যে যিনি অর্ডার করেছেন তিনি নিশ্চয়ই কোনও সৌদি ব্যাক্তি কারন সচরাচর বাঙালি খরিদ্দার তারা আশা করেন না। বাঙালি, অর্থাৎ বাংলাদেশী শ্রমিক, এবং সেরকমই পাকিস্তানি, ভারতীয় শ্রমিক শ্রেণীর মানুষ এত পরিমানে আছেন এখানে যে হঠাৎ সেই দেশ গুলোর মানুষ ফুড ডেলিভারি অ্যাপে খাবার অর্ডার করছে সেরকম হয়তো ভাবেন না সেই ডেলিভারি বয়রা, কারন তারা তাদেরই শ্রেনীর মানুষের সাথে সৌদি তে থেকে অভ্যস্ত। যারা এইসব “লাক্সারি” নিয়ে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন না। ওই সামান্য আয়ে এই সব কারণে খরচা করে টাকা নষ্ট করার ব্যাপার শুধু নয়, আমাদের শ্রমিকরা এমনিতেই নিজের হাতে বানানো ডাল ভাত তরকারি খেয়ে থাকতেই পছন্দ করবেন, কারন আমরা তাতেই অভ্যস্ত।

তা যাই হোক, এবার এই নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা টা নিয়ে এবার বলা যাক। ছেলেটা আমার ডেলিভারির প্যাকেজ টা নিয়ে সামনের গলিতে তার গাড়ির ভেতর বসে ছিল। আমি অত ভাবনাচিন্তা না করে, আমার ঘরের সাজেই বেড়িয়ে এসছি খাবার নিতে। এবার আমার ওই পোশাক এবং আচরণ অত্যন্ত অদ্ভুত মনে হতে পারে অনেকের কাছেই, কারন আমি চশমা আর কানে হেডফোন লাগিয়ে রীতিমতো বেমানান ভাবেই গায়ে গেরুয়া ফতুয়া আর সাদা লুঙ্গি পড়ে রাস্তায় নেমে পড়েছিলাম!

অনেকেই সেটা দেখে শুধু যে অবাক হবেন তা নয়, বিরক্তও হতে পারেন। এটার কারন, আমি শুনেছি, যদিও নিজের এখনও অভিজ্ঞতা হয়নি, যে সৌদি তে প্রকাশ্যে লুঙ্গি পড়া নিষিদ্ধ। আমি এটার কোনও জুতসই কারন খুঁজে পাইনি, একমাত্র লুঙ্গির অতটা “ইনফর্মাল” চেহারা ছাড়া। তাই জেড্ডায়ে থাকতে মাঝেমধ্যেই এই একই পরনে রুম থেকে বেড়িয়ে নিচে নেমে ২-৩ মিনিটের দূরত্বে জল ভরা, খাবার নিয়ে আসা, নিচের দোকানে যাওয়ার মতো কোনো কাজ সেরে আসতে দ্বিধা বোধ করতাম না। আমার নিজের অভিজ্ঞতা এবং আন্দাজ অনুযায়ী মনে হয়েছিল যে বাংলাদেশীদের হয়তো সৌদিরা অত ভালো নজরে দেখে না, আর সেই কারণে সেই লুঙ্গি টা কেও সেভাবে ওদের পরিচয়ের সাথে জড়িয়ে ফেলেছে। বাঙালি শ্রমিক মানেই হয়তো ওরকম ঢিলেঢালা লুঙ্গি পড়া নিম্ন শ্রেণীর মানুষ হবে, কেবল চেহারাছবির কারনে, এরকম চিন্তা থাকতেই পারে, এটা আমার স্বল্প জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছিল। তাই এই সাজে নিজের একজন কাস্টমারকে দেখে প্রথমে একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল ছেলেটা। তারপর খাবার নেওয়ার পর আমি নগদ টাকা দিয়ে পে করার সময়ে মাত্র এক রিয়াল ব্যালেন্স পড়ে থাকতে স্বভাবতই তা আর নিতে চাইলাম না, খুব স্বাভাবিক ভাবেই ওকে ই টিপ্স হিসেবে দিলাম। এই ছোট্ট একটা আচরণে যেন ছেলেটার চোখ মুখ পালটে গেল। অসম্ভব বিনয়ের সঙ্গে বুকে হাত রেখে এক সেলাম জানালো! এক থেকে দুই মিনিটের মধ্যে কত রকম ভাবে যে ছেলেটার হাবভাব পাল্টাতে দেখে ফেললাম তা ভেবে আমার নিজেরই শিহরণ লাগছে।

আরেকবার আমি এমনই এক বাংলাদেশী রাইডারের থেকে খাবার নেওয়ার সময়ে তাকে ফোনে বাংলায় রাস্তা চেনাতে শুরু করেছিলাম, তখন সে যেন একেবারে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল আনন্দে! সে আলাদা করে আরবি শিখে রেখেছিল এই কাজের জন্য আরবি খদ্দের দের সাথে কথা বলার জন্য, তাই সে ভাবতেই পারছিল না যে বাঙালি কাস্টমার পেতে পারে। সৌদি আরবে কম করে ৩০ লক্ষ বাংলাদেশীরা নিজেদের কে সবরকমের ম্যানুয়াল লেবার অথবা “আনস্কিল্ড” কাজের সাথেই যুক্ত করে রেখেছে, যারা সৌদি প্রভুদের জন্য কাজ করতেই এখানে উপস্থিত। সেরকমই এক কাজে হঠাৎ আমার মতো এক অতি পাকা বঙ্গ সন্তান যদি লুঙ্গি ফতুয়া পরে বুক চিতিয়ে সেই সৌদির জায়গায় দাঁড়ায়, তাতে এদের কি হেন প্রতিক্রিয়া হতে পারে নিশ্চয়ই আন্দাজ করা যাচ্ছে!

যেই মূহুর্ত থেকে আমার এই দেশি ভাই বোনেরা নিজেদের বাসা ছেড়ে গাল্ফের জন্য পাড়ি দিয়েছে তখন থেকেই তারা চূড়ান্ত লাঞ্ছনার শিকার। ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকেই এয়ারপোর্ট কর্মচারীদের ব্যবহার শ্রমিকদের সাথে এবং মধ্য ও উঁচু শ্রেনীর সেই অর্থে “শিক্ষিত, ভদ্র” মানুষদের সাথে ব্যবহারের মধ্যে বিস্তর ফারাক দেখা যায়। ধরেই নেওয়া আছে এই একগুচ্ছ মানুষ বংশ পরম্পরা অনুযায়ী প্রচুর ধার দেনা করে সেই গাল্ফেই গিয়ে পড়ে থাকবে রোজগারের আশায় তাই নিজের দেশ ছেড়ে যাওয়ার মূহুর্তেও এদের খুব একটা আপ্যায়ন দেখানোর প্রয়োজন নেই, যেমন তেমন করে বিরক্তি চেপে রেখে প্লেনে চাপিয়ে বিদায় করলেই হলো! নিজের দেশের এয়ারপোর্ট কর্মচারীদের থেকেই যদি এই ব্যবহার আসে, তাহলে বিমানগুলোর ফ্লাইট ক্রু-র আচরণের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। মনে ধরেই নেওয়া হয়েছে যে আমরা তো বাঙালি আর লেবার, আমরা কিভাবে ওত আরবি মালিক অথবা শিক্ষিত বাবুদের থেকে শ্রদ্ধা আশা করতে পারি! এক অদ্ভুত দাসত্বের ইকোসিস্টেম তৈরি হয়েছে যেন…

সৌদির চিঠি: আরবে হিন্দুত্বের শ্রেণী বিভাজন (পার্ট ১৫)

Leave a comment
scroll to top