গত ৬ই সেপ্টেম্বর ভারতীয় জনতা পার্টির বুদ্ধিজীবী নেতা মোহিত রায়-এর একটি প্রবন্ধ আনন্দবাজার পত্রিকার পোর্টালে প্রকাশিত হয়েছে। প্রবন্ধটি মূলত মনিপুরের বর্তমান সংঘাত নিয়ে হলেও, লেখাটির মধ্যে সমাজবিজ্ঞানের একটি ধারাকে তিনি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। যেই ধারা সমাজের দ্বন্দ্বের কারণ হিসেবে সম্পদ বন্টনের বৈষম্য বা বস্তুগত কারণকে ছোটো করে দেখে, অন্যদিকে মানুষের আবেগ অনুভূতি সংস্কৃতিকে প্রধান সমস্যা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে থাকে।
রায় লিখেছেন “মুশকিল হল, ধর্মীয় দ্বন্দ্ব আলোচনায় আমরা বিপন্ন বোধ করি” এর পর রায় ব্রিটেন-আয়ারল্যান্ড দ্বন্দ্ব এবং যুগোস্লাভিয়ার ভেঙে যাওয়ার পেছনে ধর্মীয় কারণই প্রধান বলে উল্লেখ করেছেন। এরপর তিনি লিখেছেন “সুতরাং ধর্মীয় পটভূমিও বিরোধের কারণ হতেই পারে, মেনে নেওয়া ভাল।”
এরপরেই রায় মনিপুর-এ কুকিদের খ্রীষ্টধর্মে ধর্মান্তরকরণ বনাম মেইতেইদের হিন্দু ঐতিহ্যের কথা তুলে ধরেছেন। রায় মিজ়োরাম প্রেসবিটেরিয়ান চার্চ ও কেরলের সিরিয়ো-মালাবার ক্যাথলিক চার্চ বা পশ্চিমা মিডিয়ার সুরে মনিপুর-এর সংঘর্ষকে হিন্দু বনাম খ্রিষ্টান সংঘর্ষ দেখাতে চেয়েছেন। এবং খ্রীষ্টান কুকিদের আক্রমণকারী এবং হিন্দু মেইতেইদের আক্রান্ত এবং প্রতিরোধী হিসেবে চিত্রায়িত করতে চেয়েছেন।
যদিও সংঘর্ষের শুরু থেকেই সমস্যার কারণ স্পষ্ট ছিলো। মনিপুর হাইকোর্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই দের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে রাস্তায় নামে কুকি সহ অন্যান্য আদিবাসী মানুষরা। কারণ তাদের আশঙ্কা ছিলো মেইতেইরাও আদিবাসী তকমা পেলে তাদের সংরক্ষণের আর কোনো দাম থাকবে না, সংখ্যাগুরু মেইতেইদের সাথে বিশেষ সংরক্ষণ ছাড়া তাদের পেরে ওঠা সম্ভব নয়।
অন্যদিকে মেইতেই নেতাদেরও অভিযোগ সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই দের (৫৩%) মাত্র ৯% সমতল অংশে বসবাস করতে হয়। তারা নিজেরা আদিবাসী হলেও স্বীকৃতি না থাকার কারণে আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত পাহাড়ের তারা জমি কিনতে পারে না। ফলত জনঘনত্ব একটা বড় সমস্যা।
কুকি পিপলস এলায়েন্স এর সাধারণ সম্পাদক উইলসন লালাম হানসিং করণ থাপারকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যদি ব্যাপারটা উল্টো হত, যদি মনিপুরে ১০% পাহাড় আর ৯০%, সমতল হত, তবে হয়তো এরকম সমস্য হত না।
অন্যদিকে থাপারকে সাক্ষাৎকারে মেইতেই লীপন সংগঠনের প্রধান প্রমোদ সিং বলেছেন পাহাড়ে কুকি অঞ্চলে মেইতেইরা কাঠ সংগ্রহ করতে যেতে পারেনা, ব্যবসায়ী বা ট্রাক ড্রাইভাররা কুকিদের দ্বারা অপহৃত হয়।
বিজেপি ঘনিষ্ঠ মেইতেই নেতারাও কুকিদের অ-মনিপুরী বহিরাগত বলেছেন, কুকিদের সাথে ভাষা সংস্কৃতির বিভেদের কথা বলেছেন, কিন্তু “খ্রিস্টান” হওয়া নিয়ে কোনো আপত্তি জানাননি।
অন্যদিকে নিউজ লন্ড্রি বা দ্য ওয়ারে সাক্ষাৎকার দেওয়া কুকি নেতারা হিন্দু আগ্রাসনের কথা বলেননি। তারা মেইতেই জনগোষ্ঠীর আক্রমণের কথা বলেছেন।
আন্তর্জাতিক চাপ হোক বা কৌশল হোক বা সততার কারণে হোক, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদও কিন্তু মনিপুর-এর এই মেইতেই-কুকি সংঘর্ষকে ধর্মীয় রুপ দিতে চায়নি৷ তারা স্পষ্ট ভাবেই এটাকে জনগোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখেছেন। কিন্তু রায় বাবু একেবারেই ছাড়বার পাত্র নন।
আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড এর সাথে ব্রিটেনের সমস্যা মূলত উপনিবেশিকতার সমস্যা, সম্পদ নির্গমনের সমস্যা, জাতিসত্তাগত সমস্যা। এই নিয়ে কার্ল মার্কস সহ তৎকালীন বুদ্ধিজীবীদের বিস্তর লেখাপত্র আছে। অন্যদিকে যুগোস্লাভিয়া ভেঙে সাত টুকরো হয়ে যাওয়ার পেছনে টিটোপন্থী সমাজতন্ত্র ভেঙে যাওয়ার পর এক একটি জাতিসত্তার স্বার্থ সংঘর্ষ দায়ী। যুগোস্লাভিয়ায় যতগুলো ধর্মীয় গোষ্ঠীর কথা রায় বাবু উল্লেখ করেছেন (রোমান ক্যাথলিক, ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চ, ইসলাম) তার থেকে বেশী ভাগে ভেঙেছে দেশটি। তারা জাতিসত্তার ভিত্তিতেই মূলত ভেঙে গেছে ধর্মের ভিত্তিতে নয়।
অনেক ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট জাতিসত্তার ভেতরে নির্দিষ্ট ধর্মের প্রাধান্য দেখা যায়, সেই জাতিসত্তার রাজনৈতিক ভাষাতেও নির্দিষ্ট ধর্মের প্রাধান্য দেখা যেতে পারে। ধর্ম কখনো কখনো সংঘর্ষের কারণও হতে পারে। কিন্তু একটি জাতিসত্তা তৈরি হয় ভাষা, সংস্কৃতি, ভূখণ্ড, ইতিহাস গত মিলের জায়গা থেকে। একটি জাতিসত্তার মধ্যে বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষ থাকতে পারে। ধর্মীয় কারণে সংস্কৃতিতে কিছু অমিলও থাকতে পারে। কিন্তু জাতিসত্তাগত মিলের জায়গাটাই প্রধান। যেমন বাঙালি হিন্দু-মুসলিমের কিছু আচারের পার্থক্য থাকলেও ভাষা, ভূখণ্ড, ইতিহাস, সংস্কৃতির মিলটাই প্রধান। তাই ধর্ম নির্বিশেষে আমরা সবাই বাঙালি।
রায় বাবুদের ত্বত্ত্ব অনুযায়ী জিন্না পাকিস্তান গঠন করলেও জাতিসত্তারগত কারণে মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ তৈরি হয়েছে। এখনো পাকিস্তানে গিলগিট, বালুচিস্তান সহ যেসব অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতার লড়াই চলছে, সেই লড়াই মুসলিমরাই চালাচ্ছে। আর এই জাতিসত্তার সংঘর্ষের অন্যতম কারণ জমি, চাকরি, ব্যবসা নিয়ে বিবাদ। যে উপাদান গুলো মানুষের রুজিরুটির সাথে জড়িত। যে বাস্তব সমস্যার বাস্তব সমাধান সম্ভব। শুধু তার জন্য প্রয়োজন সংবেদনশীলতার সদিচ্ছার। এমন কর্মসূচী প্রয়োজন যার ভিত্তিতে সমস্ত জাতিসত্তার মানুষেরা সম সুযোগ এবং মর্যাদার ভিত্তিতে একত্রে বাস করতে পারে। অন্যদিকে রায় বাবু সহ বিভিন্ন গোড়া ধর্মীয় গোষ্ঠী যে ভাবে ধর্মীয় পরিচয়কে প্রধান হিসেবে দেখে, তার বাস্তব কোনো সমাধান নেই। তাদের মতে ঐক্যের ভিত্তি একমাত্র ব্যাপক ধর্মান্তরকরণ অভিযান বা বিধর্মীদের উৎখাত।
রায় বাবুরা যতই ধর্মের নামে বাঙালির উপর হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্থানের আগ্রাসন চাপিয়ে দিতে চান, ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালির এক আত্ম পরিচয় আছে, তার জাতিগত স্বার্থ আছে। ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তানও ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি, ধর্মের ভিত্তিতে ভারতও ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না। জাতিসত্তাগুলোর সমমত সমমর্যাদার ভিত্তিতে ঐক্যই ভারতকে জুড়ে রাখতে পারে। এই সহজ সত্যিটা রায় বাবুরা সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থেই অস্বীকার করবেই, তাই তাদের সর্বত্র অকারণ অহেতুক হাতে আতশ কাঁচ নিয়ে ধর্ম খুঁজতে ঘুরে বেড়াতে হবে।