Close

আদানি বিরোধীতা বিজেপির নিজের দোষেই সরকার বিরোধীতা হয়ে উঠছে

আদানি-কে প্রচ্ছন্ন সমর্থনই কি কাল হলো বিজেপির জন্য। দেশ জুড়েই আদানি বিরোধিতা সরকারের বিরোধিতায় পরিণত হচ্ছে।

আদানি-কে প্রচ্ছন্ন সমর্থনই কি কাল হলো বিজেপির জন্য। দেশ জুড়েই আদানি বিরোধিতা সরকারের বিরোধিতায় পরিণত হচ্ছে।

চলতি বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শর্ট সেলিং সংস্থা হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টের ধাক্কায় বিধ্বস্ত হয়েছিলেন ভারতীয় ধনকুবের গৌতম আদানি। আবার যেন আগস্ট মাসের শেষ কয়েকটা দিন দেজাভু-র মত জানুয়ারি ফিরে এল আদানি-র জীবনে। মরিশাসে শেয়ার বাজার কারচুপি থেকে মুম্বাইয়ের ধারাভি বস্তির পুনঃনির্মাণের বরাত পাওয়া নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ বা এই রাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলায় তাঁর সংস্থার জমি অধিগ্রহণ অথবা ক্ষতিপূরণ নিয়ে ইউনিয়ন সরকারের কাছে হাইকোর্টের হলফনামা তলব, হঠাৎ করে এক ঝাঁক অভিযোগে বিদ্ধ ভারতীয় ধনকুবের।

আদানি-র গলায় মরিশাসের কাঁটা

পশ্চিমা তদন্তমূলক সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক অর্গানাইজড ক্রাইম এন্ড কোরাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্টের (OCCRP) এর আদানি গোষ্ঠী কে নিয়ে করা রিপোর্টে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। রিপোর্টটি যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান এবং ফিনান্সিয়াল টাইমস এ প্রকাশ করা হয়।

এই রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে আদানি গোপনে তাঁর ঘনিষ্ঠদের দিয়ে আদানি এন্টারপ্রাইজের তালিকাভুক্ত সংস্থাগুলোর শেয়ার কিনে কারচুপি করে শেয়ারের দাম বাড়িয়েছেন। OCCRP এর দাবি তারা মরিশাসে আদানির লেনদেন গুলি এবং মেইল গুলি পর্যবেক্ষণ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। যদিও আদানি গোষ্ঠী দাবি করেছে সমস্ত অভিযোগই ভিত্তিহীন এবং হিন্ডেনবার্গের তোলা পুরানো অভিযোগ গুলোকেই আবার নতুন ভাবে তোলা হয়েছে।

একই সাথে ৩০শে অগাস্ট, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডির বরাত দিয়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানিয়েছে যে হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টের ফলে আদানির সর্বনাশ হলেও শর্ট সেলিং এর মাধ্যমে পৌষ মাস হয়েছে ১২ টি কোম্পানির। যার মধ্যে দুটি ভারতীয় কোম্পানি আছে, যার একটি দিল্লিতে ও অন্যটি মুম্বাইয়ে নথিবদ্ধ। এর মধ্যে দিল্লির কোম্পানিটির বিরুদ্ধে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া (সেবি) বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করা এবং শেয়ার মার্কেট কারচুপির অভিযোগ এনেছে।

ধারাভি পুনঃনির্মাণে আদানি


এশিয়ার বৃহত্তম বস্তি ধারাভি ভেঙে আবাসন গড়ার বরাত পেয়েছিল আদানি গোষ্ঠী। আদানির প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থা সেকলিঙ্ক টেকনোলজিস কর্পোরেশনের অভিযোগ, ২০১৮ সালের দর পত্রে তারা এগিয়ে ছিল, কিন্তু ২০২২ সালে সেই দরপত্র “বেআইনি ভাবে বাতিল করে, নতুন দরপত্র আহবান করা হয়, এবং বরাত আদানি গোষ্ঠীর হাতে দেওয়া হয়”।

প্রসঙ্গত, ২০২২ সালে শিব সেনা-জাতীয় কংগ্রেস-জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস পার্টির (এনসিপি) জোট মহা বিকাশ আগহাদি বা এমভিএ জোট সরকার ভেঙে, শিবসেনারই একনাথ শিন্ডে গোষ্ঠীর সাথে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) জোট সরকার গড়ার পরেই নতুন দরপত্রটি আহবান করা হয়।

ফলে, আদানিকে বেআইনি ভাবে সুযোগ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বিজেপির বিরুদ্ধে। যদিও বিষয়টি বর্তমানে আদালতের বিচারাধীন রয়েছে।

অন্যদিকে, ধারাভি বস্তিতে যাঁরা একতলায় থাকেন, তাঁদের নতুন আবাসনে স্থান দেওয়া হলেও উপরতলায় যাঁরা থাকেন, তাঁদের ১০ কিলোমিটার দূরে পুনর্বাসন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে অভিযোগ। এর ফলে আদানি গোষ্ঠীকে নিয়ে ক্ষোভ সঞ্চারিত হয়েছে ধারাভির বস্তিবাসীদের মধ্যেও।

আদানি গোষ্ঠীর মুর্শিদাবাদ জেলায় জমি অধিগ্রহণ

অন্যদিকে, বুধবার ৩১শে অগাস্ট, মুর্শিদাবাদে আদানি গোষ্ঠীর জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে একটি মামলায় করে ইউনিয়ন সরকারের হলফনামা তলব করেছে কলকাতা হাইকোর্ট। ঝাড়খণ্ডের গোড্ডা জেলায় আদানি গোষ্ঠীর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে মুর্শিদাবাদ জেলার উপর দিয়ে হাইটেনশন তার গিয়ে ঢুকেছে বাংলাদেশে।

মুর্শিদাবাদের যে এলাকার উপর দিয়ে এই তার যাচ্ছে সেখানে আম ও লিচু বাগান থাকায় আপত্তি জানান কৃষকরা। এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে জড়ায় কৃষকরা। আদালতে মামলা করে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি বা এপিডিআর।

আদানি গোষ্ঠীর আইনজীবীর মতে, ইতিমধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে, তাই তিনি এই মামলার গুরুত্ব নেই বলে দাবি করলেও, মামলাটির নিষ্পত্তি করতে রাজি হননি প্রধান বিচারপতি টি এস শিবজ্ঞানম ও বিচারপতি হিরন্ময় ভট্টাচার্যর ডিভিশন বেঞ্চ। জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া এবং ক্ষতিপূরণ সম্পর্কে এক সপ্তাহের মধ্যে ইউনিয়ন সরকারকে হলফনামা জমা দিতে বলেছে হাইকোর্ট।

ভোট, সরোস বিদেশী হস্তক্ষেপ

জানুয়ারিতে হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টের পর বিশ্বের তৃতীয় ধনীতম ব্যক্তির থেকে একেবারে ৩০ তম ব্যক্তিতে নেমে এসেছিলেন আদানি। আদানির পতনের সাথে ব্যাপক ধ্বস দেখা যায় ভারতের শেয়ার বাজারে। জাতীয় কংগ্রেসের সাংসদ রাহুল গান্ধী তীক্ষ্ণ আক্রমণ করেন আদানি-বিজেপি আঁতাতকে।

যদিও বিশ্বজোড়া লাঞ্ছনার মাঝেও, ঘনিষ্ঠ সাথীর মত দুর্দিনে আদানিকে রক্ষা করেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি। বিরোধীরা তাকে “গৌতম দাস মোদী” বলেও কটাক্ষ করতেও ছাড়েনি। হাল ছেড়ে না দিয়ে মোদী সরকারে সহচর্যে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল আদানি গোষ্ঠী।

কিন্তু হঠাৎ যেন দেজাভু-র মত জানুয়ারি মাস আবার ফিরে এল। একের পর এক ইস্যু উঠে এল আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। বৃহস্পতিবার ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) [সিপিআই (এম)] তার বিবৃতিতে অভিযোগ করেছে যে মোদীর সাথে ঘনিষ্ঠতার জন্যই নাকি আদানি ভারতের তদন্ত সংস্থাগুলোর ধরা ছোয়ার বাইরে।

যদিও এতসব কিছুর পিছনে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের সম্পর্ক দেখছে বিজেপি শিবির। আদানিও প্রশ্ন তুলেছেন মার্কিন ধনকুবের জর্জ সরোসের ভূমিকা নিয়ে। বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র সাঈদ জাফর ইসলাম একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন যে “তবে আমি নিশ্চিতভাবে বলতে চাই যে জর্জ সরোসের মতো কিছু শক্তি রয়েছে… ভারত, যেটি একটি নরম দেশ ছিল, আজ একটি শক্তিশালী জাতি হিসাবে আবির্ভূত হচ্ছে। যে এজেন্সি এবং প্রতিষ্ঠানগুলি এই ধরনের অভিযোগ মোকাবেলা করবে তারা তাদের কাজ করবে। আমি মনে করি না যে এই বিষয়ে কোনও জ্ঞান ছাড়াই এই নিয়ে কোনও মন্তব্য করা উচিত।”

বিভিন্ন দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ এবং সরকার ফেলে দেওয়ার কারিগর সরোস এবং রকফেলার ব্রাদার্স ফান্ডের মত সংস্থার অর্থায়নে পরিচালিত OCCRP-এর নতুন অভিযোগ এর উদ্দেশ্য নিয়ে অবশ্যই প্রশ্ন তোলার অবকাশ আছে, কিন্তু এই প্রশ্নও থাকবে যে পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতাদের মত দেশের সাংবাদিকদের তদন্তকে যদি সরকার গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতো, তবে সরোসেরা এই সুযোগ পেত কিনা? প্রশ্ন উঠবে আদানি বিরোধী পক্ষান্তরে মোদী বিরোধিতায় পরিণত হওয়ার পেছনে দায়ী কে? বিদেশী শক্তি, নাকি মোদী সরকারের আদানি ঘনিষ্ঠতা?

ইস্ট পোস্ট বাংলার সম্পাদকীয় কলামে এই পত্রিকার সম্পাদকীয় মতামত প্রকাশিত হয়।

Leave a comment
scroll to top