প্রথম পথ দেখিয়েছিল জাপান-কোরিয়া। ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করে দেখাতে পেরেছিল সাহেব-সুবোধরা যতই হাসি ঠাট্টা করুক এশিয়াতেও বিশ্বকাপের মতো ইভেন্ট আয়োজন করা সম্ভব হয়। আর কার্যত সেই পথ অনুসরণ করে যুব বিশ্বকাপ আয়োজন করে পথ দেখাল ভারত, পরবর্তী সময়ে কাতার। মাস খানেক আগে এই কাতারেই শেষ হয়েছে ফুটবল বিশ্বকাপের আসর। চ্যাম্পিয়ন কিংবা রানার আপ হতে না পারলেও উল্লেখযোগ্য ভাবে এশীয় এবং আফ্রিকার দলগুলো উত্থান নিঃসন্দেহে নজর কেড়েছে ফুটবল বিশ্বের।
এর মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য রকম উত্থান বলতে মরক্কোর। পিছিয়ে পড়া আফ্রিকা মহাদেশের দেশ হয়েও, ফ্রান্সের মতো তথাকথিত এগিয়ে থাকা দেশকে সেমি ফাইনালে রীতিমতো নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে। ফুটবল বিশ্বকাপের ইতিহাস দেখলে প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রেই দেখা যাবে সব বারই এরকম কোনও অনামী দেশ উঠে এসেছে। এবং প্রথম সারির দলগুলোকে প্রায় নাকের জলে চোখের জলে করে ছেড়েছে। বিশ্বকাপ মানেই যে অঘটন, তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
কিন্তু এসব কিছুকে ছাপিয়েও উল্লেখযোগ্য রকমের খবর ছিল সে সময় ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো (যিনি সিআর সেভেন নামে খ্যাত)। বিশ্বকাপ পর্বের সময় থেকেই ইংল্যান্ডের ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অবনতি হচ্ছিল। বিশ্বকাপ চলাকালীন সেই সম্পর্ক তলানিতে এসে ঠেকে। ফলাফলে, সিআর সেভেনকে ছেড়ে দেয় রেড ডেভিলসরা। এই অবস্থায় পর্তুগিজ তারকা কোন ক্লাবে সেই নিয়ে ভক্তদের মধ্যে গুঞ্জন কিছু কম ছিল না। ফুটবল বিশ্বেও রীতিমতো আলোড়ন পড়ে গিয়েছিল। আর সেই আলোড়়ন বহুগুণে বেড়েছিল যখন খবর রটেছিল সিআর সেভেন কাতারের কোনও ক্লাবেই হয়ত শেষ পর্যন্ত যোগ দিচ্ছেন। কিন্তু সে সব রটনা মাত্র। বাস্তবে তিনি কাতারের কোনও ক্লাবে যোগ দেননি। তবে, এশিয়া থেকে বেরোনওনি। শেষপর্যন্ত সমস্ত জল্পনার অবসান ঘটিয়ে পর্তুগিজ তারকা যোগ দিয়েছেন সৌদি আরবের ক্লাব আল নেসারে। কয়েকদিন আগেই ফ্রান্সের ক্লাব প্যারিস সাঁ জাঁ-র সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ ম্যাচ যা এখনও ফুটবলপ্রেমীদের মনে থেকে গিয়েছে।
এর মধ্যেই খবর, ক্রোয়েশীয় তারকা লুকা মদ্রিচও রোনাল্ডোর ক্লাব, আল নেসারে যোগ দিতে পারেন। জানা গিয়েছে, তাঁর সঙ্গে রিয়াল মাদ্রিদের চুক্তি খুব শিগগিরই শেষ হতে চলেছে। এই অবস্থায় ইউরোপীয় কোনও ক্লাবের পরিবর্তে, মদ্রিচও সৌদির ক্লাবকেই তাঁর আগামী গন্তব্য হিসেবে বেছে নিচ্ছেন।
তবে, প্রশ্ন হল ফুটবলে এগিয়ে থাকা তথাকথিত ইউরোপ বা লাতিল আমেরিকা ছেড়ে হঠাৎ এশিয়ায় কেন সিআর সেভেনের মতো তারকা? বিভিন্ন সময় এর বিভিন্ন রকমের ব্যাখ্যাও এসেছে। অনেকের মতে, কেরিয়ারের শেষ লগ্ন বলেই এশিয়া। আবার কেউবা নেহাৎই সহজ অর্থনীতির ব্যাখ্যায় হেঁটেছে। বস্তুত কারওর কথাই ফেলে দেওয়ার নয়। ভারতেও ইন্ডিয়ান সুপার লিগ (আইএসএল) শুরুর দিনে রর্বের্তো কার্লোস, দাভোর সুকেরের মতো বিশ্বখ্যাত তারকারা খেলে গিয়েছেন।
তবে, কার্লোস বা সুকের যখন আইএসএলে খেলেছেন তখন তাদের কারিয়ার বলতে আর কিছুই নেই। নতুন করে প্রাপ্তিরও কিছু অবশিষ্ট নেই। হয়ত একই কথা প্রযোজ্য রোনাল্ডোর ক্ষেত্রেও।কিন্তু বাস্তব চিত্রটা একটু আলাদা। নতুন করে আর বিশাল কিছু ফুটবলকে দেওয়ার না থাকলেও মাথায় রাখতে হবে প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল কিন্তু এখনই না ছাড়ার ঘোষণা ইতিমধ্যেই করে রেখেছেন পর্তুগিজ তারকা। অর্থাৎ তাঁকে ২০২৪-র ইউরোয় খেলতে দেখা যাবে। সেক্ষেত্রে নিন্দুক বা সমালোচকদের যুক্তি অকাট্য এমনটা মনে করার কোনও কারণ নেই। বরং ভুলই বলা চলে। কারণ, এশিয়ার ক্লাবে খেলার পর ইউরো-র মতো প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে অংশ নেওয়া যে সম্ভব সব ঠিক থাকলে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চলেছেন রোনাল্ডো। সেক্ষেত্রে এতদিন ধরে ফুটবল নিন্দুকরা এশিয়া বা আফ্রিকার ফুটবলকে যে অবজ্ঞার চোখে দেখে এসেছে, তা কার্যত অসত্য প্রমাণিত হবে।
একই ভাবে যাবতীয় হিসেব নিকেশ উল্টে দিয়ে সদ্য সমাপ্ত বিশ্বকাপেই সৌদি আরব দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে বিশ্বের অন্যতম সেরা দলকে কীভাবে পর্যুদস্ত করতে হয়! প্রথমার্ধে লিওনেল মেসির আর্জেন্তিনার বিরুদ্ধে পিছিয়ে পড়েও, দ্বিতীয়ার্ধের দুরন্ত কামব্যাকও দেখিয়ে দিয়েছে এশিয়ার-ই দেশ। এবং ম্যাচের ৫৩ মিনিটে সালেম আলদাওসারির গোল সদ্য সমাপ্ত বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা গোল হিসেবেই বিবেচিত।
একই ভাবে দেখিয়ে দিয়েছে জাপান- কোরিয়ার মতো তথাকথিত ছোট দলগুলোও। চার বারের চ্যাম্পিয়ন জার্মানির মতে বড় দলকে হারিয়ে যেভাবে টুর্নামেন্ট থেকেই ছিটকে দিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে নজির বলাই যায়। একই কথা প্রযোজ্য কোরিয়ার ক্ষেত্রেও। পর্তুগালকে হারিয়ে প্রি-কোয়ার্টারের টিকিট নিশ্চিত করেছে তারা।
এ যদি শুধু এশিয়ার দেশগুলোর কথা হয়, তাহলে মুদ্রার উল্টোদিকে রয়েছে আফ্রিকা। মরক্কো-র কথা আর নতুন করে বলার দরকার নেই। সদ্য সমাপ্ত বিশ্বকাপে তাদের কীর্তি মনে রাখার মতো। এর বাইরে বলার মতো সেনেগাল। যুদ্ধবিধ্বস্ত, সন্ত্রাস-জঙ্গি কবলিত দেশ, সেনেগাল বিশেষ কিছু করতে না পারলেও, উল্লেখযোগ্য রকমের পারফরম্যান্স দেখিয়ে প্রি কোয়ার্টার অবধি পৌঁছেছিল।
সামান্য এই পরিসংখ্যান-ই আসলে জবাব দিচ্ছে এশিয়া-আফ্রিকা সম্পর্কে ফুটবল সমালোচকদের সমালোচনার। আরও তথ্য পরিসংখ্যান সামনে এনে তালিকা হয়তো আরও দীর্ঘায়িত করা যেত। কিন্তু তার আর বিশেষ দরকার নেই বোধহয়। সামান্য পরিসংখ্যানেই বোঝা যাচ্ছে আসলে চলতি শতাব্দী তো বটেই পরবর্তী শতাব্দীও অন্তত ফুটবলের ক্ষেত্রে এশিয়া ও আফ্রিকার হতে চলেছে। বাকি… শুধু সময়ের অপেক্ষা করতে হবে।