এতদিন অনেকরকমের দুর্ভোগ, পরিশ্রমের কথা আলোচনা করেছি। আজ একটু বিদেশে আমাদের অন্যান্য কিছু বিষয় নিয়ে গল্প করতে চাই। একটু সুর নরম করে কিছু ব্যাপার আর কি! বিদেশে থাকতে সমস্ত শ্রমিকদের এক বড়ো আক্ষেপ থেকেই যায়-নিজেদের পরিবার নিয়ে। তারা তাদের ভালোবাসার মানুষদের অথবা সেই মানুষটিকে যে কি ভীষণ কষ্টের সাথে দূর থেকে বুকে আগলে রাখতে চেষ্টা করেন তা না দেখলে বোঝা সম্ভব নয়। অনেকেই মনে করেন যে এই ক্ষেত্রে একমাত্র দায় তাদের, অর্থাৎ সেই শ্রমিকদেরই নিতে হবে, নিজেদের প্রতি এবং সেই মানুষগুলোর প্রতি তাদের এই অবহেলার জন্য। কিন্তু তারা কি এই নিয়ে অবগত নন? তারা কি তাদের এই বেদনা নিয়ে একটুও ওয়াকিবহাল নন? কিভাবেই বা দিন কাটে তাদের এরকম নিজেদের সমস্ত সুখের পাওনা কে ত্যাগ করে?
আমাদের মধ্যে এক জনপ্রিয় ঠাট্টার কথা আছে যে অনেকেই, বিশেষ করে বাংলাদেশীরা নাকি আজকাল ডিজিটাল যুগে অনলাইনে নিকাহ করে নেন। আমাদের সাথে বেশ কয়েকজন কলিগের বিরুদ্ধে নাকি এই অভিযোগ আছে। একজন একবার বলেছিলেন, তিনি চার বছর বিদেশে আছেন, দেশে ফেরেন নি, তাই তার পরিবারের সহযোগে ভিডিও কলের মাধ্যমে বিয়ে করে ফেলেছেন! পরিবারের মানুষজন পাত্রি দেখে ঠিক করে, তার অনুমতি নিয়ে তার সাথে সম্বন্ধ পাকা করিয়ে অনলাইন কলে মৌলবি বসিয়ে “কবুল” বলিয়ে নিয়েছেন। আমি অবাক হয়ে গিয়ে পরে বুঝলাম এটা নতুন কিছু নয়, এরকম প্রায়ই হয়ে থাকে, এবং সেই অনলাইন বিয়ের অনেকদিন বাদে সেই ব্যাক্তি দেশে ফিরে সামাজিক এবং আইন অনুযায়ী বিয়ে সেরে নেন, কিন্তু তিন কবুল হয়ে যায় বলে তারা স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের সূচনা করে ফেলেন তখন থেকেই, অনলাইনে! এটা সম্ভব হয়েছে এখন তাদের ঘরে ঘরে স্মার্টফোন এবং সস্তায় ডেটা প্যাক পাওয়া যাচ্ছে বলেই।
তারা একটু সময় সুযোগ পেলেই, কাজের ফাঁকে, ঘুম ত্যাগ দিয়ে, চুলহায় ভাত পুড়িয়ে ফোন সামনে নিয়ে ভিডিও কল অন করে রাখবেন নিজেদের ভালোবাসার মানুষটির সাথে। নিজে একজন গর্বিত ব্যাচেলর হওয়ার দৌলতে আমি তো মাঝে মধ্যে এই নিয়ে তাজ্জব হয়ে যাই যে এত কি এমন প্রেম এবং ধৈর্য যে তারা এত এত টাকা ধার নিয়ে সেই ধার শোধ করার জন্য বিদেশে বছরের পর বছর পরে থাকতে রাজি, অথচ সেই মানুষটিকে অথবা মানুষগুলোকে এইভাবে কাছে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমার ঘরে থাকা এক বাঙালি শ্রমিকের প্রায়ই দেখতাম নিজের নতুন বিয়ে করা বউয়ের সাথে অভিমান হয়ে ২-৩দিন কথা বন্ধ হয়ে যেত, কিন্তু তার একেবারে সদ্যোজাত শিশুর সাথে ভিডিও কল থাকতো না। বিশেষ আলাপ পরিচয় ছাড়াই ছুটির তাড়াহুড়োয় বিয়ে করে নিয়ে কি অনায়াসে এবং মিষ্টি ভাবে যে এদের প্রেম অভিমানের সম্পর্ক গড়ে উঠতো, তা নিয়ে আমার বিস্ময়ের অন্ত থাকতো না।
এইসব বিচিত্র প্রেমকাহিনীর সূত্রে আমার নিজেরও যে দুশ্চিন্তা জাগেনি তা বলবো না। অনেকেই ক্ষেপে উঠেছে আমার বিয়ে করাবে বলে! একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের অবিবাহিত থাকা উচিত নয়, এই অজুহাতে আমার অনেক সহকর্মী আমায় হুমকি দিতে শুরু করেছিল যে তারা আমার জন্য পাত্রি দেখা শুরু করেছেন আমি যেন প্রস্তুত থাকি! ব্যাপারটা অত্যন্ত হাস্যকর হলেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমাকে ভাবতে বাধ্য করলো। যেমন এত বছর নিজের শহর থেকে বাইরে বাইরে থেকে নিজের কাজ এবং পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থেকে কোনোদিন এইসব বিষয় নিয়ে অত বিচার বিশ্লেষণ করাও হয়নি। দূরদেশে পরিবারের থেকে এত দূরে থাকতে গিয়ে এক প্রবল যেই একাকিত্ব ঘিরে ধরে, সেইটা একে অপরের স্নেহ এবং যত্নের মাধ্যমেই কাটিয়ে দিতাম, যেটি আমার কাছে বেশ গর্বের এবং রোমাঞ্চকর ব্যাপার ছিল। কিন্তু এতদিন পর, হঠাৎ মনে হলো যে কোথাও যেন একটা খামতি থেকেই যাচ্ছে, কোনো এক সঙ্গ যেন বাদ পড়েই যাচ্ছে। তার সাথে এটিও বারবার মনে হচ্ছে যে আমি যতই বিদেশে উড়ে বেড়াই, যতই টাকা পয়সা কামিয়ে ফেলি, আমি বাকিদের মতো মোবাইল স্ক্রিনে পরদা ফেলা অথবা পান পাতা সরতে দেখতে পারবো না! বাকিরা যে কি সাংঘাতিক মনের জোরে এবং ভীষণ খিদের দায়ে এই উপায় বেছে নিয়েছেন তা আমার ধর্তব্যে আসবে না, কিন্তু আমি ওই স্ক্রিনের মধ্যে “আব্বু তুমি কই?” বন্দি দেখতে পারবো না।