Close

সৌদির চিঠি: হকের টাকা ছাড়বো কেন? (পর্ব ২৭)

শ্রমিকদের টাকা মেরে দেওয়া নতুন নয়। কিন্তু আরশাদের শিক্ষা একটা নতুন জিনিস শেখালো। প্রবাসের চিঠিতে সৌদি থেকে লিখছেন পথিকৃৎ।

শ্রমিকদের টাকা মেরে দেওয়া নতুন নয়। কিন্তু আরশাদের শিক্ষা একটা নতুন জিনিস শেখালো। প্রবাসের চিঠিতে সৌদি থেকে লিখছেন পথিকৃৎ।

সৌদির চিঠি পর্ব ২৬

গতবার যেই ভাবে সোহেলের চুক্তির মেয়াদ হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছিলাম, সেই সূত্রেই নতুন কিছু যোগ করে রাখি। আসলে এইসব বিষয় আমরা সকলেই জানি, কিন্তু ভয়ের বিষয় হচ্ছে আমরা এইসব কুকীর্তি মানিও বটে, এবং অভ্যস্ত হয়ে যেতে শিখেছি। এই ক্ষেত্রেই কিছু ভারতের অভিজ্ঞতাও বলতে চাই। এখানে আমাদের সাথে বোকারো থেকে একটা ছেলে আরশাদ(নাম পরিবর্তিত) এখানে লেবারের কাজ করতে এসেছে। এর আগে মুম্বাই তে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতো। তখন এক দারুণ অভিজ্ঞতার কথা বলছিলো।

আরশাদ যখন মুম্বাই তে কর্মরত ছিল, তখন কোনো এক বন্ধুর ডাকে সিনেমার একটা কাজ করতে গিয়েছিল। ভিড়ের কাজ। মানে, ভিড়ে দাঁড়াতে হবে আর কি। বলেছিল পাঁচশো টাকা দেওয়া হবে সারাদিনের জন্য। কিন্তু আড়াইশো মতো ধরিয়ে বিদায় করেছে। এইবার আমি ভাবলাম বিষয়টা একটু যাচাই করে খতিয়ে দেখি। দেখলাম, সত্যিই ও ভিড়ের মধ্যে এক নিশ্চিহ্ন মাথা হিসেবে ক্যামেরায় ধরা দিয়েছে। এইবার সিনটা ছিল “রক অন ২” সিনেমার “জাগো” গানটার এক অতি স্বল্প সময়ের দৃশ্য। সেইখানে ভিড়ের মধ্যে ফারহান আখতারের অত দাপাদাপির মধ্যেও আরশাদের ঘর্মাক্ত হাসি মাখা উজ্জ্বল চেহারা খুঁজে বার করতে একটুও কষ্ট হচ্ছে না। তারপর গানটা মন দিয়ে শুনে আমার ধারনা হলো যে এইটা তো যুব সমাজের জাগরণের গান বলে মনে হচ্ছে। অত ভালো হিন্দি অথবা হার্ড রক সঙ্গীত বুঝি না আমি, তবু একটু শুনে মনে হলো যে নিজেদের সমস্ত রকম সমস্যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে জেগে ওঠার আহবান জানাচ্ছেন ফারহান আখতার আরশাদদের দিকে তাকিয়ে।

গান শেষ হওয়ার পর, মানে গনের শুটিং শেষ হওয়ার পর অর্ধেক পাওনা ধরিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হলো। জানি না এর মধ্যে থেকে আরশাদ কতটা জাগ্রত হলো। অগ্রগামী এবংবলেই ধারনা করেছিলাম। সেখানে এরকম সাধারণ শ্রমিকের বিশ্বাস ভেঙে তার টাকা মেরে নেওয়াতে খুব একটা অবাক হয়েছি বলছিনা অবশ্য। আরশাদের সেই দিন এক জাগরণের শিক্ষা হয়ে গিয়েছিল প্রকৃত ভাবে। সবে গ্রহণ থেকে বেড়িয়ে আসা এক অল্প বয়সী ছেলে নিজের হকের টাকা নখ পেয়ে দুনিয়া চেনার প্রথম অভিজ্ঞতা অর্জন করলো।

এখন সেই শিক্ষা লাভ করে সে আমাকে বোঝাতে এলো যেন কোনোভাবেই নিজের অধিকার না ছেড়ে দি। সোহেল প্রতারিত হয়েছে, আমি যেন কিছুতেই সেই ফাঁদে পা না দিয়ে ফেলি। আমার এখানে সৌদি আরবে চুক্তি শেষ, নিজের সমস্ত হিসাব নিকেশের অপেক্ষা করছি। যেন এক পয়সাও ছেড়ে না দি। আমাকে এখন কোনো কারন ছাড়াই বসিয়ে রাখা হয়েছে অপেক্ষার মধ্যে। গত মাসের বেতন না দিয়ে বসে থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে স্রেফ কোম্পানির আলসেমির জন্য। আবার সেই পরিস্থিতি তে জানা গেল সমস্ত পুরুষ ম্যানেজার দল বেঁধে আমোদ প্রমোদের জন্য একসাথে বাহরাইন ঘুরতে গেছে। কোম্পানির এক ভাগ কর্মী যেখানে গত মাসের বেতন পায়নি এবং আমরা যারা নিজেদের বেনেফিট মানি আর বেতন কিছুই না পেয়ে বেকার আটকে বসে আছি শুধুমাত্র ম্যানেজার দের ঢিলেমির জন্য, সেখানে সেইসব ম্যানেজার রা ফূর্তি করতে বাহরাইন চলে গেছে উইকেন্ডে! এই ক্ষেত্রে আমার কি করা উচিত? হাত পা ছড়িয়ে কাঁদবো, নাকি এই নিয়ে হেড অফিস অথবা শ্রম আদালত গিয়ে ঝামেলা করবো? আরশাদ, এক অত্যন্ত হাসিখুশি ছেলে, সমস্ত শিশুসুলভ আচরণ হারিয়ে এক অদ্ভুত গাম্ভীর্য নিয়ে আমাকে সেই প্রশ্নের জবাব দিল, “ভাই অনেক বুদ্ধি খাটিয়ে চিন্তা ভাবনা করে কাজ করেন, কারন আপনার পর আমিও আছি লাইনে। আর যাই করেন ভাই, নিজের হিসেব বুঝে নেবেন ভাই। নিজের অধিকারের টাকা যেন কোনোভাবেই তছরুপ না হয়, আর সেটার কোনো সুযোগও যেন না পায় ওরা। সেরকম কোনো সুযোগ ওদের দেবেন না ভাই। যেভাবেই হোক, নিজের অধিকার আদায় করে নেন ভাই… আপনার পরে আমিও আছি”

Leave a comment
scroll to top