Close

সৌদির চিঠি: প্রবাসী শ্রমিকদের ননসিনেম্যাটিক জীবনগাথা (পর্ব ২৫)

করোনার সময়ে প্রবাসী শ্রমিকদের দুরবস্থা নিয়ে অনেক চর্চা অনেক ঢঙ দেখেছিলাম, এখন ভাবছি ভাগ্যিস সৌদি আরবে আসা হয়েছিল! লিখছেন পথিকৃৎ সরকার।

করোনার সময়ে প্রবাসী শ্রমিকদের দুরবস্থা নিয়ে অনেক চর্চা অনেক ঢঙ দেখেছিলাম, এখন ভাবছি ভাগ্যিস সৌদি আরবে আসা হয়েছিল! লিখছেন পথিকৃৎ সরকার।

সৌদির চিঠি: পর্ব ২৪

করোনার সময়ে প্রবাসী শ্রমিকদের দুরবস্থা নিয়ে অনেক চর্চা অনেক ঢঙ দেখেছিলাম, একটা সিনেমাও তৈরি হয়ে গিয়েছিল মনে আছে। এখন ভাবছি ভাগ্যিস সৌদি আরবে আসা হয়েছিল, তাই সেই জীবনটা চাক্ষুষ করার সুযোগ পাচ্ছি। ছোটবেলায় পড়েছিলাম আগেকার যুগে নাকি ব্রাহ্মণদের গুরুকুলে থেকে কঠোর অনুশাসনের মধ্যে দীক্ষা নিতে হতো। সেই পরিপ্রেক্ষিতে প্রবাসী শ্রমিকরা তো আরো কঠিন জীবন যাপন করছেন। আমরা চূড়ান্ত লাঞ্ছনা, বঞ্চনার মধ্যেও সেই শক্ত পরিকাঠামো, নিয়মাবলী মেনে চলছি। একজন দিন শ্রমিকের মতো নিয়মানুযায়ী জীবনযাপন কি আর কেউ খুব একটা টিকিয়ে রাখতে পারে? আমাদের অনেকেই হয়তো বলবে আমি নিয়ম করে এত সকালে উঠে শরীরচর্চা করে প্রাতরাশ সেরে আরো নানা কাজ করি, প্রতিদিন এক নিয়ম মানি। কিন্তু একজন শ্রমিককে তো সেই অনুশাসন বাধ্য হয়ে পেটের দায়ে মানতে হয়। সে তো শখ করে এত কিছু মানছে না, তার কাছে তার রোজগার ঘন্টা অনুযায়ী যন্ত্রের মতো এক নিয়মে কাজ না করলে সে হয়তো সেদিন আর খেতে পাবে না। এইবার এই জাঁতাকলের মধ্যে থাকতে গিয়ে যদি আরও দুর্ভোগের শিকার হতে হয় তাহলে তার পরিস্থিতি কেমন হতে পারে?

আপনাদের হয়তো একবার আমাদের পশ্চিম বাংলার দুইজন লেবার, আনিস এবং নাসিমের(দুই নামই পরিবর্তিত) কথা বলেছিলাম। এনাদের মধ্যে একবার জানিয়েছিলাম যে আনিস প্রচুর কাজের চাপে অসুস্থ হয়ে পড়েছে, ডাক্তার দেখাতে গিয়ে সেই গন্যমান্য ডাক্তারের তিরষ্কার শুনে এসেছে। দুই মেয়ের বাপ সেই আনিস মুখ বুজে সব মেনে নিয়েছিল, আমাদের সবার মধ্যে সবচেয়ে তুখোড় এবং চটপটে কর্মী হওয়া সত্ত্বেও। সে তার জবাব দিল, তার কাজের চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় শত প্রলোভনের মুখেও চাকরি ছেড়ে দিয়ে। যতই অফার দেওয়া হোক, আনিসের মন গলানো গেল না, আনিস আর কাজ করতে রাজি হলো না। কোম্পানি অনুরোধ করলো যেন অন্তত পাওনা ছুটি গুলো না নিয়ে কাজ করে, যেটার উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিয়ে দেওয়া হবে। সেই টাকা আনিস পেল না। বিনা বাক্যে যেন একগুচ্ছ অপমান ছুঁড়ে দেওয়া হলো ওর দিকে। সমস্ত দিক বিচার করে, এই বিদেশ বিভুঁইয়ে যে সমস্ত ব্যবস্থা যে তার মতো এক প্রবাসী শ্রমিকের বিরুদ্ধে, সেই জ্ঞান নিয়ে আনিস এইবারও সব মেনে নিলে। কিন্তু ওর শক্ত চোয়ালে ওর এক দৃঢ় প্রতিজ্ঞা যেন স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠলো।

এইবার আসি নাসিমের কথায়। আমাদের এন্টালির বাচ্চা ছেলে নাসিম, আমারি বয়সী হবে। ভীষণ স্বল্পভাষী, সারাক্ষণ যেন কি ভাবছে, কি চিন্তায় আছে মনে হতো। স্বভাবে অত্যন্ত শান্ত এবং ধিরস্থির, অল্প বয়সে কাজের অভিজ্ঞতা নেই বলে তেমন চটপটে ভাবে অত কাজও জানতো না। তাকে দিয়ে কম খরচায় কাজ চালিয়ে নেওয়ার জন্য কিচেনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যথারীতি বেশ সময় লাগছিল সব কাজ শিখতে তার। শেফের থেকে চূড়ান্ত অপমানিত হওয়ার পর একদিন দেখেছিলাম পেছনে এক ঘুপচি জায়গায় গিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। একদিন হঠাৎ কাজ জানে না বলে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হলো। সে যেই দালাল সংস্থার থেকে এসেছিল, সেখানেই ফেরত যেতে হলো নিরুপায় হয়ে। কিন্তু সে আর কাজ পেল না, একবার এইরকম কালি লেগে যাওয়ার জন্য। বোঝাই গেল, কোম্পানি শুধুমাত্র নিজেদের খরচা বাঁচিয়ে একজন কম বয়সী শ্রমিকের অপমানের জন্য এইরকম হঠকারী স্বীদ্ধান্ত নিল। নাসিম অসুস্থ হয়ে পড়লো।

অল্পেতেই যেন ঘাবড়ে যেত ছেলেটা, এই পরিস্থিতিতে চোখের জল মুছে শুধু একবার বললো, “মায়ের সাথে কথা বলবো”। এমন এক গলায় কথাটা বললো যে বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো আমার। সেই শেষ কথা হয়েছিল আমার তার সাথে। শুনেছিলাম নিজের ছোট্টো ভাগ্নিকে রাক্ষসের মতো ভালোবাসে, এই হেন এক অত্যন্ত সহজ সরল শিশুসুলভ ছেলে কে হঠাৎ তাড়িয়ে দিয়ে বলা হলো নিজের ব্যবস্থা নিজে করে নে এই অজানা দেশে। এতদিন কাজের চাপে ওর কথা খেয়াল ছিল না, কিন্তু এই সপ্তাহে হঠাৎ আরেক শ্রমিকের থেকে ওর খবর পেয়ে চমকে উঠলাম। কি দোষের জন্য যে নাসিমকে এই হেনস্থা হতে হলো, সেই নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে করতে নাকি হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো তাকে। যেই ছেলেটা তাকে দেখতে গিয়েছিল, সে চরম আশঙ্কার সাথে জানালো, “ভাই দেশে ফেরত যাওয়ার আগে ওর এমন অবস্থা দেখলাম, সিনেমায় যেমন দেখায় না চারিদিকে সবরকম নল লাগিয়ে রাখে শরীরে, ওর সেই চেহারা দেখে এলাম ভাই। এটা কি হলো, কেন হলো ভাই…”।

One Comment
scroll to top