Close

সৌদির চিঠি: কর্পোরেট হাঙর এবার কি শায়েস্তা হবে? (পর্ব ১৭)

লোভনীয় কর্পোরেট অফার সরিয়ে রেখে অফিসে গণ রিজাইন স্কিলড লেবারদের। নড়ে চড়ে বসছে কর্তৃপক্ষ। সোদির চিঠিতে লিখছেন পথিকৃৎ।

লোভনীয় কর্পোরেট অফার সরিয়ে রেখে অফিসে গণ রিজাইন স্কিলড লেবারদের। নড়ে চড়ে বসছে কর্তৃপক্ষ। সোদির চিঠিতে লিখছেন পথিকৃৎ।

সময় হয়ে এসছে প্রায়! আর মাস দুয়েক পর আমার এই কোম্পানি তে কন্ট্র্যাক্ট শেষ হয়ে যাবে, তখন দেশে ফিরবো দীর্ঘ দুই বছর পর। অনেকবার ম্যানেজমেন্টের তরফ থেকে আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে যাতে আমরা থেকে যাই, নিজেদের কন্ট্র্যাক্ট আরও এক বছর বাড়িয়ে নিই। কিন্তু বেশিরভাগ স্টাফ নাছোড়বান্দা। যতই মাইনে বাড়ানোর লোভ দেখানো হোক, যারা ঠিক করেছি যে আর কাজ করবো না, তারা আর কোনো প্রলোভনে পা দিতে রাজি নই। “অনেক সহ্য করেছি, আর নয়” এমন এক চিন্তা যেন। কর্পোরেট-এর লোভ এবং ঠগবাজি নিয়ে এই দুই বছরেই আমার বিশাল শিক্ষা হয়ে গেছে। আমার এই নতুন কিচেনে যে কত রকম অসুবিধা নিয়ে থাকতে হচ্ছে তা বলে শেষ করা যাবে না।

ম্যানেজমেন্ট রিয়াধের কিচেন গুলোয় স্টাফের খাওয়ার জল পর্যন্ত রাখেনি। আমার কিচেনে একটা চেয়ার ছিল, সেটাও সরিয়ে নিয়েছে। যেখানে সৌদি তে নতুন এক নিয়ম হয়েছে এক শপিং মলের কিছু মহিলা কর্মচারীদের অভিযোগের ভিত্তিতে যে কাজ না থাকলে মহিলা কর্মী দের দাঁড় করিয়ে রাখা যাবে না, তাদের বসার ব্যবস্থা করতে হবে। না আমাদের সাথে কোনো মহিলা কাজ করেন না, কিন্তু তাই বলে স্টাফের ন্যূনতম সুবিধা গুলো কেড়ে নেওয়া নিশ্চয়ই উচিত নয়।

গত মাসের মাইনে থেকে আমার একদিনের হিসেব কেটে নিয়েছে, কারন আমার সিনিয়র আমার মাধ্যমে এক “উদাহরণ” সৃষ্টি করতে চেয়েছিল বাকি স্টাফের জন্য। এমন টা প্রথমবার নয়, আগেও হয়েছে আমাদের সাথে। এই সপ্তাহে আবার নাকি আমাদের সবার মাইনে থেকে কাটা যাবে হুমকি দেওয়া হয়েছে, আমাদের থাকার জায়গা নোংরা রাখার অভিযোগে। যেই রুম গুলোতে আমাদের রেখেছে, সেখানে আমাদের প্রায় ১৫ জনকে একটি শৌচালয় ব্যবহার করতে হয়। আবার বলা হয়েছে, দুজন সুপারভাইজার দের রুমের পাশের বাথরুম যেন আমরা ব্যবহার না করি। এইরূপ চরম ভেদাভেদ এবং রীতিমত নোংরামির পর কার মাথার ঠিক থাকবে?! এমন নয় যে আমাদের থাকার জায়গা দিয়ে ম্যানেজমেন্ট বিরাট কিছু দায়িত্ব পালন করছে। পুরো গাল্ফে এই ব্যবস্থা প্রচলিত এবং একরকমের বাধ্য যে কর্পোরেট মালিকরাই প্রবাসী শ্রমিকদের থাকার এবং যাতায়াতের ব্যবস্থা করে দেবে। এত সমস্যা এবং অপমানের মধ্যে যদি বলা হয় যে মাইনে কাটতে থাকবো, তাহলে কর্পোরেট-এর কালো চেহারা বারংবার সামনে আসতে থাকে।

এবার শুধু আমাদের সাথে এহেন দুর্ব্যবহারের বিষয় ছেড়ে, কাজের ক্ষেত্রেও আসা যাক। অর্থাৎ, সমস্ত ব্যাপার পরিচালনা, মানে ম্যানেজমেন্টের আসল কাজ গুলোর আঙ্গিক থেকেও যদি বিচার করা যায়, আমার মতো যেকোনো স্বল্প অভিজ্ঞতার মানুষও অনায়াসে বলে দিতে পারেন যে কি চরম অপদার্থের নিদর্শন। প্রচুর লোকসান নিয়ে কোম্পানি চলছে, আরবি মালিক যারা আছেন তারা নাকি একটা ব্যাঙ্ক থেকে দেনা নিয়ে আরেক ব্যাঙ্কের দেনা শোধ করছেন। নতুন ইউরোপীয় ম্যানেজাররা এমনভাবে কোম্পানির সর্বনাশ ঘটিয়ে চলেছেন। আমাদের লেখাপড়া না জানা শ্রমিকরাও বুঝতে পারছেন যে কিভাবে একের পর এক হঠকারী পদক্ষেপ নেওয়ার কারনে আর্থিক ক্ষতি বাড়তেই থাকছে, এবং সেই কোপ কিভাবে আমাদের ওপর এসে পড়ছে। কর্মী ছাঁটাই, টাকা না দিয়ে ওভারটাইম, যাতায়াতের সমস্যা, থাকার সমস্যা, কোম্পানির যেকোনো ক্ষেত্রেই সমস্যা হয়েই আছে। আর এটাও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে ইউরোপীয় ম্যানেজাররা কিভাবে এই পরিস্থিতির ফায়দা তুলছে, কিভাবে লোকসানের দিকে ঠেলে দিয়ে নিজেদের পকেট ভরছে। “কর্পোরেট এমবেজ়লমেন্ট” কোনও নতুন কথা নয়, সব জায়গাতেই ছোট বড়ো আকারের কোম্পানির ফান্ড তছরুপ হয়েই থাকে। কিন্তু এইখানে যেন হরির লুট লেগেছে! ভুলভাল বিভ্রান্তিকর সিদ্ধান্তের জন্য যতই লোকসান হতে থাকুক, এদের খাওয়াদাওয়া থামছে না কিছুতেই। এবার সেইসব প্রমাণ সহ বর্ণনা দিতে গেলে অনেক সময় এবং শব্দের অপচয় হবে এখন। তবে যেটা না বললেই নয় তা হচ্ছে এরা যেন এদের এইধরনের মূর্খতা এবং অসভ্যতার দায় আমাদের ওপর ঠেলে দিচ্ছে। যেন আমাদের দোষে এত সমস্যা বেঁধেছে, তাই স্টাফের মাইনে কেটে দাও, স্টাফের খাবার, জল বন্ধ করে দাও, গরু ছাগলের মতো এক একটা রুমে ৬-৭জন করে ঢুকিয়ে বলে দাও রুম নোংরা জরিমানা ভরো! ওদিকে ম্যানেজার যদি রেস্টুরেন্টের সোফা চেয়ার নিজের বাড়িতে পাচার করে তখন যেন কেউ সেটা লক্ষ্য না করে।

আসলে ঘটনা হচ্ছে, আরবিরা বরাবরই সাদা চামড়ার দিকে একটু ঝুঁকে থাকতে পছন্দ করে, সেটা এখন সবার জানা কথা। তাই অসাধারণ, দক্ষ কিছু ভারতীয় ম্যানেজার থাকতেও, তারা এমন ইউরোপীয় তুলে এনেছে ম্যানেজার, ডাইরেক্টর হিসেবে, শুধুমাত্র নিজেদের কোম্পানির চেহারা “হোয়াইটওয়াশ” করাবে বলে। এবার সেই সম্পূর্ণ অযোগ্য, অচল ম্যানেজমেন্ট যে তাদের লুটে খাচ্ছে, সেটা জেনেও যদি না জানার ভান করে থাকে শুধুমাত্র তেলের প্রাচুর্যের জন্য অঢেল টাকা পয়সা থাকার কারনে তাহলে আমরা আর কি বা বলতে পারি। বরং আমি মাথা গরম করে আরো বেশি করে যেন খাওয়াদাওয়া শুরু করেছি কিচেনের সামগ্রী দিয়ে, এবং অন্যকেও খাওয়াচ্ছি! ওরা যদি লক্ষাধিক রিয়াল লুটতে পারে, আমাদের স্বল্প বেতনেও হাত দিতে বাকি না রাখে, তাহলে আমিও রোজ কোম্পানির স্টক থেকে দুইবেলা পেট ভরে খাওয়ার অধিকার রাখি! আমি এই নিয়ে এখনই লেবার কোর্ট যেতে পারি, কিন্তু আর দুই মাস…


আমরা এতজন মিলে যে কাজ ছাড়ছি, এতে সবাই নড়েচড়ে বসেছে। অনেকবার সবাইকে আলাদা আলাদা করে অনেক প্রলোভন দেখানোর চেষ্টা চলছে, কিন্তু স্টাফ অনড়। এতদিন আমরা যতই হরতালের হুমকি দিয়ে থাকি না কেন, এইবার যেন আসল চাল খেলা হয়েছে মনে হচ্ছে! হরতাল করে না আমাদের লাভ হবে এই ভিন দেশে, না ম্যানেজমেন্টের তেমন হেলদোল হবে। তাই এইবার, আমরা যতজন সত্যিকারের “স্কিলড লেবার” অথবা দক্ষ কর্মী আছি, আমাদের সিংহভাগ একসাথে যখন রিজাইন করছি, তখন অবশেষে টনক নড়েছে। শুধু তাই না, রীতিমত হইচই পড়ে গেছে যা খবর পাচ্ছি। রিয়াধে বসে যখন জেড্ডাহ-র শ্রমিক ভাইরা আমাকে ফোন করে জানাচ্ছেন যে আমরা সবাই কাগজ জমা করে দিয়েছি, তুমিও করে ফেল, তখন যেন এক অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেল আমার মধ্যে দিয়ে। একসাথে এতজন কর্মী নিজে থেকে কাজ ছেড়ে দিলেন যাতে কর্পোরেট-এর কোমর ভেঙে যাবে। এর থেকে উপযুক্ত প্রতিবাদ আর কি হতে পারে!

Leave a comment
scroll to top