আপনারা বাংলাদেশের বাউল, মুর্শিদি, তাহেরি ইত্যাদি সঙ্গীত নিয়ে কতটা জানেন? আমার সেই অর্থে একেবারেই কোনো ধারণা ছিল না, ভাবিওনি কোনো দিন খুব একটা এই বিষয়ে। আমার মা বাংলা লোকগীতি নিয়ে মাস্টার্স করেছিলেন কলেজে, তিনিও এই বিষয়ে আমার প্রশ্নের জবাব দিতে পারলেন না। আমি একজন সঙ্গীতকারের ব্যাপারে জিগ্যেস করেছিলাম আসলে, যাঁর গান আজকাল বেশ ঘন ঘন শুনতে পাচ্ছি, আমাদের নতুন এক দেশী ভাই, ফাহাদ মিঞার(নাম পরিবর্তিত) দৌলতে। আমার সাথে নাইট ডিউটি হয় ওনার, প্রতি রাতে ৯টার পর ওনার মোবাইল বেজে উঠবে। কত নাম না জানা বাউল গায়কদের নিয়ে সাজানো ওনার প্লেলিস্ট। আমার কিচেন টায় এবং ফাহাদ ভাইয়ের মধ্যে যেন প্রান আসে তখন। পরিবেশটাই বদলে যায়, যখন রাতে আমরা ৩জন এপার ওপারের বাঙালী একসাথে বাউল চালিয়ে বসে পড়ি।
আমাদের সাথে আরেক যে দেশী ভাই আছেন তিনি আমার এই নিয়ে উৎসাহ দেখে একদিন অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, “কলকাতায় বাউল চলে নাকি?!” আমি হতভম্ব হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। এখন যেন আমরা দুই পারের বাঙালীরা একে অপরকে নিয়ে কিছুই জানি না মনে হচ্ছে । বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত, শহুরে, বুদ্ধিজীবী মানুষের সমাজ, মানে যাদের সাথে আমার আগে পরিচয় ছিল পরিবার এবং বন্ধু সূত্রে, তারা এখন আমার কাছে অচেনা মনে হচ্ছে। মানে পশ্চিম বাংলায় আমি যেই শ্রেণীর অংশ হিসেবে নিজেকে চিনতাম, আজকে পশ্চিমের প্রতিবিম্ব পূর্ব বঙ্গের সেই শ্রেণী কে যেন সমপূর্ণ অচেনা লাগছে। মনে হচ্ছে যেন গ্রামগঞ্জ থেকে আসা এই লেবার ক্লাসই তো আমার জন্য, এদের মধ্যেই তো আমার থাকার কথা। এটা হয়তো নিজের চেনা গন্ডির বাইরে বেরিয়ে আসতে পেরেছি বলেই এত সহজে উপলব্ধি করতে পারছি। আমার নিজের বাড়িতে যতই রবীন্দ্রসঙ্গীতের চর্চা হোক, অথবা যতই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সেজেগুজে পারফর্ম করি, এই শ্রমিকরাই তো আমাকে আপন করে নিয়ে আমার সাথে লোক সঙ্গীত চালিয়ে হেলেদুলে গুনগুন করছেন! হয়তো অনেকেই মনে করবেন এনারা সস্তা বলিউড, আধুনিক, অথবা ভোজপুরি জাতীয় গান ছাড়া কিছু উপভোগ করেন না, যদিও আমি একেবারেই ভোজপুরি গীতি কে কোনোভাবেই আজকালের ব্যঙ্গর কারণ হিসেবে দেখি না, তাদের দুর্ধর্ষ লোকগীতি প্রচলিত, দেহাতি শ্রমিকদের সাথে অনেকদিন থাকার দৌলতে শিখেছি। কিন্তু এখানে যেকোনো শ্রমিকই, মাঝে মধ্যে একটু ঠাট্টার জন্য আধুনিক কিছু বলিউড চালালেও, নিজের জন্য আপন মনে নিজের গ্রামের কোনো গীত গুনগুন করবেন, অথবা ইয়ার ফোনে শুনবেন।
এই ক্ষেত্রে এবার শহরের অনেকেই আবার এই ধরনের কিছু গান নিয়ে হাসাহাসি করতে পারে, অনেকে হয়তো কিছু গানের বিষয়বস্তুকে “রিগ্রেসিভ” ও বলতে পারেন। গ্রামের দিকের অনেক শিল্পী দের গান নিয়ে অনেক রকমের মিম, প্যারোডি ভিডিও হতে দেখেছি কলকাতায় থাকতে। আমি ভাবছি, সেই গ্রামের মানুষজন যদি এখন ইংরেজি জেনে আজকাল সেই হাসি ঠাট্টা করা “লিবেরাল” দাদা দিদি দের আধুনিক ইংরেজি প্লেলিস্ট গুলো শুনতেন, তাহলে কি না কি বলতেন! নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন প্লেলিস্টে কি ধরনের কোন গানগুলোর কথা বলছি, যাতে ভালো মতো “ভাইব” করা যায় আর কি। যদি আপনি সত্যিই বুঝে এবং নিজেকে সেই প্লেলিস্টের সাথে যুক্ত করে থাকেন তাহলে আমি অত্যন্ত দুঃখিত আপনার জন্য, শিঘ্রই আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন, কিছু অসাধারণ আধুনিক লোকগীতি দিয়ে আপনার ইউটিউব ফিড(কারন এনারা স্পোটিফাই জানেন না এখনও) শুদ্ধ করে দিতে পারি!
এই বিষয়ে বলতেই হচ্ছে, আগে একবার উল্লেখ করে ছিলাম, উত্তরাখণ্ডের প্রবীনের(নাম পরিবর্তিত) কথা, তিনি আমাকে পেলেই ওনার কানের একটা ইয়ার ফোন আমার কানে গুঁজে দিতেন। গঢ়ওয়ালি গান! দয়া করে ভোজপুরি অথবা নর্থ ইন্ডিয়া ভেবে নাক শিঁটকোবেন না, খুবই সুন্দর কিছু আঞ্চলিক লোকগীতি শোনাতেন তিনি। তার মধ্যে আবার গঢ়ওয়ালি ভাষারও কত যে আঞ্চলিক টান এবং তফাৎ আছে তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে হয় এখন! এবার সেই গঢ়ওয়ালি গানের সাথে ভীষণ অবাক ভাবেই, এই সপ্তাহে নতুন আরেক লোকগীতির মিল পেলাম। পাঞ্জাবি অথবা নেপালি ভাবছেন নিশ্চই। একেবারেই না, আমি পাশতু গীতির কথা বলছি! হ্যাঁ প্রথমে আমারো অবিশ্বাস্য লাগলো যখন আমাদের পাকিস্তানি ড্রাইভার জানালেন যে গাড়ির স্টেরিও তে গানগুলোর ভাষাটা পাশতু, কারন অনেকের মতো আমিও সেই পার্বত্য জনজাতির ব্যাপারে একেবারে কিছুই জানিনা। অনেকে তো অঞ্চলটার নাম শুনেই আবার বিরুপ চিন্তা করে বসেন ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং সন্ত্রাসবাদের আশঙ্কায়। কিন্তু মধ্যরাতে রিয়াধ শহরের ফাঁকা রাস্তায় গাড়িতে কারুর অক্স কেবিল না থাকার সৌভাগ্যে আরেকটা অজানা জাতির অপূর্ব কিছু গানের নিদর্শন পেলাম, যা চোখ বুজে শুনলে যেন সেইসব পাহাড়ের কথাই মাথায় আসে…
সৌদি আরবে এই হালে গানবাজনা, জনসাধারণের মনোরঞ্জনের ব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটেছে। তাই বলে এই নয় যে মানুষ জন গান থেকে মুখ ফিরিয়ে ছিলেন। এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ খেলতো যেন আমার মধ্যে যখন আমি একসাথে এক উজবেক কর্মচারী এবং আরেক ইয়েমেনের শ্রমিকের সাথে বসে, এখানে সবচেয়ে জনপ্রিয় আরবি ঊদ বাদ্যযন্ত্র টি ম্যান্ডোলিনের থেকে কতটা আলাদা এবং সেই ঊদ উজবেকিস্তানে পৌঁছে কি রুপ নিয়েছে সেই নিয়ে আলোচনা করতাম। সেই উজবেকিস্তানের “নাই” নামের এক বাঁশি নাকি মধ্য এশিয়ার মানুষের হাত ধরে সিন্ধু পেরিয়ে এসে শানাই নাম নিয়েছে! আমি কোনো সঙ্গীতকার নই, তেমন গুরুত্ব দিয়ে কোনোদিন সঙ্গীত চর্চা করিওনি, তাই এইসব বিষয় নিয়ে খুব একটা জ্ঞান নেই, ভুল হলে অথবা পাঠকের এই নিয়ে কোনো মন্তব্য থাকলে দয়া করে জানাবেন। কিন্তু নতুন নতুন দেশের মানুষ নিজের যেটুকু সংস্কৃতি এবং সঙ্গীত জ্ঞান আমার সাথে ভাগ করে নিচ্ছেন, সেটুকু তেই নিজেকে ধন্য মনে হচ্ছে!