১৭ শতকে আমেরিকায় চালু হয় “লণ্ঠন আইন” (Lantern laws)। এই আইন অনুযায়ী, যদি কোনো দাস তার সাদা চামড়ার মালিককে ছাড়াই রাতে বাইরে বের হয়, তবে অবশ্যই তাকে হাতে লণ্ঠন বা মোমবাতি রাখতে হবে; যাতে প্রভুদের নজরদারিতে থাকে দাসেরা। নিজের নাগরিকদের উপর মার্কিনি নজরদারিকে উলঙ্গ করে দেশান্তরী হতে হয়েছে এডওয়ার্ড স্নোডেনকে। যদিও বাংলা টিভির সঞ্চালিকা প্রশ্ন তুলেছেন, সব জায়গায় ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট আছে যখন, CCTV-তে সমস্যা কোথায়? জনসাধারণের একাংশের মনে প্রশ্ন CCTV-র মাধ্যমে অপরাধ সনাক্ত করা সহজ হলে, নজরদারিতে আপত্তি কিসে?
পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস যাদবপুরে র্যাগিং রুখতে মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর দারস্থ হয়েছেন। এছাড়াও বোস হায়দ্রাবাদ-ভিত্তিক একটি সংস্থার সাথেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। রাজ ভবনের বিবৃতিতে জানানো হয়েছে যে “তারা ভিডিও বিশ্লেষণ, ইমেজ ম্যাচিং স্বয়ংক্রিয় লক্ষ্য শনাক্তকরণ এবং রিমোট সেন্সিং এর মতো একাধিক উৎস ব্যবহার করে একটি উপযুক্ত প্রযুক্তি দ্বারা সমাধান তৈরি করার চেষ্টা করছে।”
শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং এর স্থাপত্য বিভাগের প্রাক্তনী সপ্তদীপা চৌধুরী শোনালেন তার CCTV মোড়া ক্যাম্পাসের অভিজ্ঞতা, “আমার তখন দ্বিতীয় বর্ষের শেষ বা তৃতীয় বর্ষের শুরু(২০১৮), তখন হঠাৎ একটি নোটিশ বের হয়, সেখানে বলা হয় CCTVর মাধ্যমে নজরদারি রাখা হবে, চার জনের বেশী যেন এক সাথে না বসে। শিবপুর কলেজের নাম জড়িয়ে যেন বাইরে কেউ কোনো রাজনৈতিক মতামত না দেয়। CCTV লাগানো হল প্রত্যেকটি বিল্ডিং এর এনট্রান্সে, প্রত্যেকটি লবিতে, প্রত্যেকটি জায়গায়। এর জন্য আমরা রাজনৈতিক আলোচনা করতে খানিকটা ভয়ই পেতাম। কিন্তু স্বাধীনতা দিবস, হোলি বা নবরাত্রি, সেই সবে অনুষ্ঠানে কিন্তু প্রকাশ্যে জয় শ্রীরাম গান বাজানো হত এবং এই ধরনের অনেক কিছুই করা হত কর্তৃপক্ষের সামনে।”
চৌধুরী আরো বলেন, “CCTVর সামনে ‘মুন্নি বদনাম হুই’ বা ‘শিলা কী জওয়ানি’ চালিয়ে নাচা নাচি হলে অথরিটির কোনো সমস্যা হত না। কিন্তু দুজন ছাত্র নিজের অধিকার নিয়ে, অথরিটির গাফিলতি নিয়ে কথা বললে সেখানে আপত্তি।”
“২০১৮ সালে অথরিটি সেনেট তৈরি করতে চাইছিলো না, কিন্তু যে সমস্ত ছাত্র সেনেট তৈরির পক্ষেছিলো, তাদের বাছাই করে সাসপেন্ড করে দেওয়া হয়”, চৌধুরীর দাবি এর পেছনে CCTVর ভূমিকা থাকতে পারে।
প্রসঙ্গত ২০১৮ সালের রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের ছাত্র শাখা অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (ABVP)-র রাষ্ট্রীয় সভাপতি হন সুদীপ্ত মুখোপাধ্যায়। ২০১৮ সালে এই মুখোপাধ্যায়ই শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং চিফ ওয়ার্ডেন এবং পরবর্তীতে ডিন অফ স্টুডেন্ট হন। ছাত্রদের অভিযোগ অনুযায়ী মুখোপাধ্যায় ক্যাম্পাসে বা ক্যাম্পাসের বাইরে প্রতিষ্ঠানের নাম জড়িয়ে ছাত্রদের রাজনৈতিক কার্যকলাপের বিরোধী হলেও, তার স্যোশাল মিডিয়া একাউন্টে তিনি নিয়মিত ABVP-র প্রচার করে থাকেন।
শিবপুর ক্যাম্পাসের ডাইরেক্টর পার্থ সারথী চক্রবর্তী কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি ঘনিষ্ঠ বলে দাবি ছাত্র ছাত্রীদের একাংশের। তাদের আরও দাবি, ক্যাম্পাসের দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদী নেতাদের নিত্য আনাগোনা, কিন্তু প্রাক্তন ছাত্রদের কলেজে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়।
বিশ্ব ভারতীর সাঁওতালি ভাষা বিভাগের প্রাক্তনী শুভ নাথ বলেন “নতুন উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী আসার পর ক্যাম্পাস সিসিটিভি-তে ভরে গেছে। আগে অথরিটির বিরুদ্ধে ছাত্র ছাত্রীরা আন্দোলনে সামিল হলে, অথরিটিপন্থী অধ্যাপকরা সিকিউরিটি গার্ড বা অন্য ছাত্রদের জিজ্ঞাসা করে জানতো, কারা কারা আন্দোলনে গেছে, তার পর সেই আন্দোলনকারীদের ছাত্রদের আন্দোলনে যেতে বাধা দেওয়া হত। এখন আন্দোলনকারীদের পরিচয় গতিবিধি ওই ক্যামেওরাতেই রেকর্ড হয়।”
নাথের আরো দাবি “ক্যাম্পাসে যদি কোনো মেয়ের শাড়ি পরাতে কোন গোলযোগ হয়, তবে যে ফাঁকা জায়গায় গিয়ে শাড়িও ঠিক করে নিতে পারে না, কারণ CCTV ক্যামেরার কেউতো তাকে দেখছে, এটাতো তার প্রাইভেসিতে হাত দেওয়া।”
২০২০ সালে ক্যামেরার সামনে বিজেপি নেতা কপিল মিশ্রর উস্কানিমূলক ভাষণে পর রাজধানী দিল্লির উত্তর পূর্ব অঞ্চলে উন্মত্ত হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের কর্মীদের দ্বারা মুসলিম জনসাধারণের উপর আক্রমণ শুরু হয়। শুরু হয় ব্যাপক হিংসা; মৃত্যু হয় ৫৩ জনের। কপিল মিশ্রর বিরুদ্ধে দিল্লি দাঙ্গা মামলায় FIR হলেও, তিনি আজও গ্রেফতার হননি।
দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজের গবেষক ওয়াকার আজ়ম মনে করেন মানুষের সুবিধার জন্য CCTVর ব্যবহার হওয়া উচিৎ। কিন্তু ব্যবহার হয় আসলে মানুষের উপর নজরদারিতে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে। আজ়ম বলেন, “লাইব্রেরিতে কারো ল্যাপটপ হারিয়ে গেলে সেটা উদ্ধারের জন্য CCTV ভালো। কিন্তু CCTV ব্যবহার করা হয় কে কার সাথে বসছে, কী রাজনীতি করছে তার উপর নজরদারি চালানোর জন্য।”
অন্যদিকে প্রাক্তন আইপিএস নজরুল ইসলাম CCTVকে খুবই জরুরি প্রযুক্তি বলে মনে করেন। ইসলাম বলেন “CCTV থাকলে এক ধাক্কায় তদন্ত অনেকটা এগিয়ে যায়।” ইসলামের আরো দাবি “CCTV একটা যন্ত্র, তার কোনো পক্ষপাতিত্ব নেই। যে CCTV চালনা করছে, সে পক্ষপাতিত্ব দেখালে৷ CCTV ব্যবহার করেও পক্ষপাতিত্ব দেখাতে পারে, না করেও দেখাতে পারে।”
মানবাধিকার সংগঠন গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতির সাধারণ সম্পাদক রঞ্জিত সূর বলেন “CCTV বা নজরদারির পেছনে একটা রাজনীতি আছে, সমস্ত কিছুই রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করবে, তোমার ব্যক্তিগত জীবন, তোমার সামাজিক জীবন। এই রাজনীতিটা খুব ভয়ঙ্কর। ব্যক্তির রাজনৈতিক জীবন, সামাজিক জীবনেকে নিয়ন্ত্রণ করার হাতিয়ার হল CCTV।” সূর আরো বলেন, “ছাত্রদের ক্ষেত্রে সুস্থ রাজনীতিই পারে অসুস্থ রাজনীতিকে পরাজিত করতে, CCTV সেখানে অপরাধ ঘটে যাওয়ার পর অপরাধীকে সনাক্ত করতে পারে মাত্র।”
১৯৪২ সালে, জার্মান বিজ্ঞানী ওয়াল্টার বারুচ দূর থেকে রকেট উৎক্ষেপণ নিরীক্ষণের জন্য CCTV ক্যামেরা তৈরি করেছিলেন। যদিও ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ হামলার পর মূলত নিরাপত্তা সরঞ্জামের ব্যাপক বাজার গড়ে তোলা হয়। যার অন্যতম একটি পন্য CCTV। ২০২১ সালের মে মাসে, কম্প্যারাটেক সারা বিশ্বের ১৫০টি প্রধান শহরে CCTV ক্যামেরার ব্যবহার সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তারা বিশ্বব্যাপী প্রায় ৭৭০ মিলিয়ন ক্যামেরা চিহ্নিত করেছে এবং এর মধ্যে ৫৪%ই শুধুমাত্র চীনে রয়েছে বলে তারা দাবি করেছে।
CCTV প্রতি হাজার জনের হিসেবে হায়দ্রাবাদ, ইন্দোর, দিল্লী, সিঙ্গাপুর, মস্কো, বাগদাদ, সিউল, সেন্ট পিটার্সবার্গ, লন্ডন এবং লস এঞ্জেলেস হল এমন দশটি শহর যেখানে চীনের বাইরে সর্বাধিক নজরদারি করা শহর।
সারাক্ষণ কেউ দেখছে, এই অনুভূতিটা একটা মানসিক চাপ তৈরি করে, এই ভাবেই রাষ্ট্র, কারখানা, বা কলেজ অথরিটি নিরবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে ব্যক্তিকে, এমনটাই মনে করে অনেকে। মানবাধিকার কর্মী সূর বলেন “CCTV ব্যক্তিমানুষ হিসেবে বা সামাজিক মানুষ হিসেবে বিকশিত হওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে।”
যদিও চীনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটাকে অন্য দৃষ্টিতে দেখছেন চীনে পাঠরত এক ভারতী ছাত্রী শ্রেয়সী চৌধুরী। যাদবপুর ক্যাম্পাসে CCTV বিতর্কের মাঝেই তিনি তার ফেসবুক পেজে লিখছেন “আমি যে ইউনিভার্সিটিতে পড়ি সেই ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস, কি হোস্টেল কম্পাউন্ড সর্বত্রই সিসিটিভির ছড়াছড়ি। সর্বত্র কর্মচারীদের আনাগোনাও বটে। কিন্তু এই ব্যবস্থা কতৃপক্ষের চাপিয়ে দেওয়া নয়, বরং মানুষের একত্রিত উদ্যোগ। সেই সিসিটিভি পরিচালনা করার অধিকারও কেবল কতৃপক্ষের কুক্ষিগত নয়। কতৃপক্ষ ও সাধারণ আবাসিকের মধ্যেকার এই ক্ষমতার বিভেদটাই দেখা যায় না। বরং সচেতন সমস্ত ছাত্রছাত্রী ও আবাসিকরা যেকোনো সমস্যা সমাধানে সেই সিসিটিভিকে একটি উপায় হিসেবে ব্যবহার করেন। সিসিটিভি একটি tool। সেটা শিক্ষাক্ষেত্রে কেন, সমাজের যে কোনো স্তরে, যে কোনো ক্ষেত্রে ব্যবহার করার আগে মূল প্রশ্ন তার ব্যবহার কি মানুষের প্রয়োজনে করা হবে? মানুষ ব্যবহার করবে সেই যন্ত্র? নাকি ক্ষমতায় থাকা পচাগলা ফ্যাসিবাদী আঁতাত সেই সিসিটিভি নামক টুল টি ব্যবহার করবে শিক্ষাক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন মানুষকে ‘দেশদ্রোহী’ মর্মে ইউএপিএর মত ভয়াবহ আইনের আওতায় গ্রেপ্তার করে জেলে পচিয়ে মারার উদ্দেশ্যে?”
একদিকে CCTVর মাধ্যমে যেমন খুব দ্রুত অপরাধী সনাক্তকরণে বা ফুটেজ দেখে আসল ঘটনা কী ঘটেছে দ্রুত জানতে পারায় সাফল্য পাওয়া গেছে, তেমনই CCTVর পক্ষপাতিত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যবহারেও উঠেছে প্রশ্ন। CCTV মানুষকে নিরাপত্তা দেবে নাকি, বিরোধী দমনে নজরদারিতে ব্যবহৃত হবে ক্রমশ? সেই প্রশ্ন থাকছেই।।