প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বুধবার একটি সংবাদ সংস্থার সঙ্গে কথা বলার সময় বলেন, ভারত খুব শীঘ্রই তার তৃতীয় বিমানবাহী রণতরী তৈরি শুরু করবে, তিনি আরও জানান ভারত শুধু এখানেই থেমে থাকবে না, ভারতের লক্ষ্য হলো যত তারাতারি সম্ভব নৌসেনার জন্য আরও পাঁচ থেকে ছয়টি বিমানবাহী রণতরী তৈরি করা।
বর্তমান সময়ে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল হয়ে উঠেছে বিশ্বরাজনীতির মূল কেন্দ্র, তাই এই অঞ্চলকে প্রতিটি শক্তিশালী রাষ্ট্র নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় । বিশেষজ্ঞদের মতে ভবিষ্যতে যে দেশ ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবে সেই দেশ সরাসরি বৈশ্বিক বাণিজ্যের ৫০ শতাংশ এবং ৪০ শতাংশ তেলের বানিজ্যকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখবে।
এই অঞ্চলে বর্তমানে তিনটি প্রভাবশালী নৌশক্তির (ব্লু-ওয়াটার নেভি) উপস্থিতি রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং চীন, কিন্তু ভারত ও চীনের বর্তমান নৌসেনা একসাথে দুটি অঞ্চলের বেশি নজরদারি চালাতে অক্ষম। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মোট ১১ টি, ভারতের কাছে ২ টি এবং চীনের কাছে ২টি বিমানবাহী রণতরী রয়েছে ।তবে ১লা মে থেকে চীন তার তৃতীয় বিমানবাহী রণতরী ফুজিয়ান ক্লাসের এক সপ্তাহব্যাপী সমুদ্র পরীক্ষা চালায়।
এখন পর্যন্ত ভারত তিনটি বিমানবাহী রণতরীর থাকার কথা বলে আসছে। গত বছরের জানুয়ারিতে প্রতিরক্ষা বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি তৃতীয় সমুদ্রগামী বিমানবাহী রণতরী রাখার প্রয়োজনীয়তার পরামর্শ দিয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, “একটি রণতরীর নাগাল এবং নমনীয়তা দূরবর্তী দ্বীপ অঞ্চলে সামরিক বিমানঘাঁটির চেয়ে অনেক বেশি উন্নত।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং যা বলেছেন তাতে ভারতের জন্য একটি নতুন লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছে ,এটি শোনার পর নিশ্চিত ভাবে চীন, যুক্তরাষ্ট্র সহ বাকি শক্তিশালী ইউরোপিয়ান দেশগুলির ও কান খাড়া হয়ে গেছে।
২০২১ সালে মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের একটি প্রতিবেদনে ভারতকে সতর্ক করা হয়, চীন একটি বহু-বাহক রণতরী সম্পন্ন বাহিনী তৈরি করতে চলেছে ২০৩০ সালের মধ্যে, যেখানে কমপক্ষে পাঁচটি রণতরী উপস্থিত রাখার পরিকল্পনা রয়েছে।
চীনের বর্তমানে দুটি অপারেশনাল বিমানবাহী রণতরী রয়েছে – লিয়াওনিং এবং শানডং। ১ মে থেকে চায়না তার পরবর্তী প্রজন্মের বিমান বাহক ফুজিয়ানের এক সপ্তাহব্যাপী সমুদ্র পরীক্ষা শুরু করে। এটি চীনের তৃতীয় বিমানবাহী রণতরী এবং প্রথম ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ক্যাটাপল্ট দিয়ে সজ্জিত। ফুজিয়ান, একটি ৮০,০০০ টনের যুদ্ধজাহাজ, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং ভারতের তৈরি বিমানবাহী রণতরীর চেয়ে বড়। বিশেষজ্ঞদের অনুমান অনুসারে ২০৩৫ এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক গুলি বিমানবাহী রণতরী অবসরপ্রাপ্ত হয়ে যাবে। ফলে চীন ও আমেরিকার মধ্যে নৌশক্তির পার্থক্য আরও কমে আসবে।
তাই ভারত- প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নৌশক্তির ভারসাম্য বজায় রাখতে ভারতের ভুমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তিনটি বিমানবাহী রণতরী ভারতকে ভারত মহাসাগরে চীনকে ঠেকাতে সাহায্য করবে, এবং অবশিষ্ট নতুন বিমানবাহী রণতরী গুলি (যা রাজনাথ সিং ঘোষণা করেছেন) ভারতীয় নৌবাহিনীকে ভারত মহাসাগরের অনেক বাইরে এমনকি দক্ষিণ চীন সাগরেও (SCS) শক্তি প্রদর্শন করার অনুমতি দেবে।
চীন স্থায়ীভাবে ভারত মহাসাগরে তাদের একটি CBG (একটি নৌবহর যা একটি এয়ারক্রাফ্ট ক্যারিয়ার এবং একাধিক এসকর্ট ভেসেল নিয়ে গঠিত) স্থাপন করার চেষ্টা করছে, জিবুতিতে, কম্বোডিয়ার রিমে, পাকিস্তানের গোয়াদরে, শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা এবং মায়ানমারের কিয়াউকপিউতে নৌঘাঁটি বানিয়ে।
যদি পরিকল্পনা মতো ভারতের আরও পাঁচ থেকে ছয়টি বিমানবাহী রণতরী তৈরি বাস্তবায়িত হয়, তবে এটি চীনের বিরুদ্ধে ভারতীয় নৌবাহিনীকে পরিমাণগত সমতা প্রদান করবে। তবে পাঁচ থেকে ছয়টি এয়ারক্রাফ্ট ক্যারিয়ারের জন্য প্রচুর সংখ্যক সহায়ক জাহাজ এবং অবকাঠামো প্রয়োজন হবে।
একটি CBG-তে একটি সাবমেরিন, একাধিক ফ্রিগেট, ডেস্ট্রয়ার, কর্ভেট এবং একটি ট্যাঙ্কার জাহাজ থাকা বাধ্যতামূলক যা বিমানবাহী রণতরীকে রক্ষা করবে। এই সবের জন্য প্রচুর পরিমাণে আর্থিক বিনিয়োগ প্রয়োজন। এটিকে বাস্তবে রূপ দিতে ভারত সরকারকে প্রতিরক্ষা বাজেট, বিশেষ করে বাজেটের মূলধন বৃদ্ধিতে আরও অনেক অর্থ বরাদ্দ করতে হবে ।
বর্তমানে শুধু ভারত ও চীন নয়, এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলিও সমুদ্রে নিজের শক্তি প্রদর্শন করার চেষ্টা করছে,এবং তারাও বিমানবাহী রণতরী তৈরির জন্য সরব হয়েছে। জাপান দুটি হেলিকপ্টার বাহক রণতরী কে এফ৩৫ যুদ্ধবিমান উড়তে সক্ষম বিমানবাহী রণতরীতে রূপান্তরিত করেছে। এবং দক্ষিণ কোরিয়া তাদের বিমানবাহী রণতরী ২০৩০ এর মধ্যে বিশ্বের সামনে আনবে বলে জানিয়েছে।