Close

পাকিস্তানে চিনের ঋণ ফাঁদের মিথ, ভারতকে দলে টানার চেষ্টা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের

সেক্রেটারি অফ স্টেট অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের আসন্ন ভারত সফরের ঠিক আগে পাকিস্তানে চীনের ঋণের ফাঁদ সংক্রান্ত তত্বটি আবার ব্যাপক ভাবে প্রচারিত হচ্ছে। কতটা সত্য এই তত্ত্ব? এর পেছনে মার্র্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক স্বার্র্থী বা কি?

পাকিস্তানে চিনের ঋণ ফাঁদের মিথ, ভারতকে দলে টানার চেষ্টা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের

পাকিস্তানে চীনা দূতাবাসের ট্যুইটার থেকে ছবিটি নেওয়া হয়েছে

শুক্রবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটনে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক মার্কিন সহকারী সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু, সেক্রেটারি অফ স্টেট অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের আসন্ন ভারত, কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান ভ্রমণের পূর্বে একটি বিশেষ প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গভীরভাবে উদ্বিগ্ন যে ভারতের নিকটবর্তী প্রতিবেশী দেশগুলিতে, বিশেষত শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানে চিনের ঋণ জোরপূর্বক সুবিধার জন্য ব্যবহার করা হতে পারে। প্রসঙ্গত আগামী মার্চ মাসে তিন দিনের ভারত সফরে আসছেন ব্লিঙ্কেন। ১-৩ মার্চ “রাইসিনা সংলাপ”, “জি২০” বৈঠক এবং কোয়াডের আলোচনায় যোগ দেবেন তিনি। ব্লিঙ্কেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সাথেও পৃথক বৈঠক করবেন বলে জানা যাচ্ছে।

লু বলেছেন আরো বলেন “আমরা ভারতের সাথে কথা বলছি, এই অঞ্চলের দেশগুলির সাথে কথা বলছি কিভাবে আমরা দেশগুলিকে তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতে পারি এবং চিন সহ কোনও বাইরের অংশীদার দ্বারা বাধ্য হয়ে নিতে হয় এমন সিদ্ধান্ত নয়।”

আমেরিকার দীর্ঘ দিনের বন্ধু পাকিস্তান যদি চিন ঘেঁসা অবস্থান নেয়, তবে অবশ্যই সেটা আমেরিকার জন্য উদ্বেগের বিষয়। সোভিয়েত আমলে ভারত জোট নিরপেক্ষ অবস্থান নিলেও, পাকিস্তান সামিল হয়েছিলো মার্কিন শিবিরে।চিনের সাথেও সু-সম্পর্ক রেখে চলতো পাকিস্তান। কিন্তু ইমরান খান ক্ষমতায় আসার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। এর ফলশ্রুতিতেই পশ্চিমারা সংসদীয় ক্যু এর মধ্যে দিয়ে নির্বাচিত ইমরান সরকারকে ফেলে দেয় বলে অভিযোগ ভূরাজনীতির বিশেষজ্ঞদের একাংশের। কিন্তু এবার নতুন সরকারও চিন ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়বে কীনা সেই নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কপালে চিন্তার ভাঁজ আসাটা স্বাভাবিক। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার দেশ গুলোতে চিনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকাতে “চিনের ঋনের ফাঁদ” তত্বটি মার্কিন কূটনীতির অন্যতম প্রধান হাতিয়ার।  লু এর মন্তব্যের পর থেকেই বিভিন্ন সংবাদ পত্রে শ্রীলঙ্কার মত পাকিস্তানকেও চিনের ঋন ডোবাবে কিনা সেই নিয়ে একের পর এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে।

২৩ ফেব্রুয়ারি “এই সময়” তার ওয়েব পোর্টালে “ফের চিনা লোনের ফাঁদে পাকিস্তান! ইসলামাবাদকে ৫৭৮৩ কোটি ঋণ দিতে তৈরি বেজিং” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

২৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা হিন্দুস্থান টাইমস লিখেছে “পাকিস্তানকে সম্প্রতি ৭০০ মিলিয়ন ডলার ‘অর্থসাহায্য’ করেছে চিন। এর আগে এভাবেই ‘অর্থসাহায্য’ এবং ‘বিনিয়োগ’-এর নামে শ্রীলঙ্কাকে ঋণ দিয়ে সেই দেশকে আর্থিক ভাবে পঙ্গু করে দিয়েছে চিন। এই আবহে পাকিস্তানকে দেওয়া এই ঋণ নিয়ে উদ্বিগ্ন আমেরিকা।এবং এই নিয়ে ভারতের সঙ্গে এবার ‘গুরুত্বপূর্ণ’ আলোচনা শুরু করল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।”

যদিও ২৯ মার্চ, ২০২২ সালে হিন্দুস্থান টাইমসেরই প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, শ্রীলঙ্কার ঋণের ৩৬.৪% আন্তর্জাতিক সার্বভৌম বন্ডে। তারপর তালিকায় আছে যথাক্রমে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক (১৪.৬%), জাপান (১০.৯%) এবং চিন (১০.৮℅)। শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋন ছাড়াও বিশাল পরিমাণে অভ্যন্তরীণ ঋনও রয়েছে।সুতরাং বৈদেশিক ঋণের উৎস হিসাবে চিন রয়েছে চতুর্থ স্থানে। তা ছাড়া শ্রীলঙ্কাকে চিনের ঋন ফেরত দিতে হবে মূলত ২০০৪ সাল থেকে। সুতরাং জাপান বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত সংস্থা গুলো থেকে শ্রীলঙ্কা বেশী ঋন নিলেও, কী ভাবে দেউলিয়া হওয়ার জন্য পশ্চিমা মিডিয়ার সুরে সুর মিলিয়ে কিছু ভারতীয় মিডিয়া চীনা ঋনকে দায়ি করছে, সেটা ভাববার বিষয়। মোট বৈদেশিক ঋনের মাত্র ১০% হাতে নিয়ে কীভাবে একটা দেশ অন্য দেশকে নিয়ন্ত্রণ করে সেটাও একটা প্রশ্ন।

পাকিস্তানে চিনের ঋনের ফাঁদে পড়ার অভিযোগটা নতুন নয়। পশ্চিমা মিডিয়ার সুরে সুর মিলিয়ে ভারতের মিডিয়া এটাই প্রচার করে চিনের ঋনের জন্যই শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তান দেউলিয়া হয়েছে। কিন্তু ২০২১-২২ সালের পাকিস্তান ইকনমিক সার্ভের তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে পাকিস্তানের সবচেয়ে বেশী ঋন আছে পশ্চিমাদের কাছে। ২০২৪ সাল থেকে মূলত পাকিস্তানকে চিনের ঋণ শোধ করা শুরু করতে হবে।

বর্তমানে তীব্র অর্থ সঙ্কট থেকে উদ্ধার পাবার জন্য আইএমএফ (IMF) এর থেকে ঋন পেতে দরকষাকষির আলোচনা চালাচ্ছে পাকিস্তান। জানা যাচ্ছে ঋন পেতে কর বৃদ্ধি, ভর্তুকি হ্রাস ইত্যাদি “কাঠামোগত পূনর্বিন্যাসের” শর্ত দিয়েছে আইএমএফ (IMF) কর্তারা।

২০১৮ সালে সাংহাইতে অনুষ্ঠিত  আন্তর্জাতিক আমদানি প্রদর্শনীতে পাকিস্তানের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আসাদ উমর বলেন “নিশ্চিত ভাবে পাকিস্তান ঋনের ফাঁদ সংক্রান্ত সমস্যায় আছে, কিন্তু চীনা ঋনের ফাঁদ নিয়ে পাকিস্তানের কোনো সমস্যা নেই।”  এ ছাড়াও চিনের কাছে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঋনগ্রস্থ হয়ে যাওয়াকেও কটাক্ষ করেন তিনি।

চিন এখন মার্কিনি যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক ঋন দাতা। জাপান প্রথম। চিনের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১.৩ লোক্ষ কোটি ডলার ঋন আছে। এর থেকে সামান্য কিছু বেশী ঋন আছে জাপানের কাছে।

এই বছরের শুরুতে এশিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইকো-সিভিলাইজেশন রিসার্চ এর চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার সাকিল আহমেদ রামায় সংবাদ সংস্থা শিনহুয়াকে বলেন, আন্তর্জাতিক সমাজ পশ্চিমাদের বিশেষত ওয়াশিংটনের চিনের ঋন সংক্রান্ত অভিযোগটি গ্রহন করে না। তার বদলে বহু দেশ চিনের সাথে সম্পর্ক রাখতে পছন্দ করে, কারণ চিন তাদের ভালো বিকল্প দেয়। সঙ্গে তাদের সমাজ কাঠামো, শাসন ব্যবস্থাকে সম্মান দেয়।

২০২১ সালের মার্চে পকিস্তানের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ হাসান খাওয়ার বলেন পাকিস্তানের অর্থনীতি যে প্রেক্ষাপটে কাজ করছে তা বোঝারও প্রয়োজন, যেমন জাতীয় প্রেক্ষাপটে IMF এর শর্ত পাকিস্তানের  উপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করে।

ফলত কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলানোর চিনের বিদেশ নীতি, পশ্চিমাদের থেকে ভালো বানিজ্যিক প্রস্তাব দেওয়াটাই চীনের সাফল্যের চাবিকাঠি বলে মনে করেন অনেকে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমারা তাদের আধিপত্য ধরে রাখতে মরিয়া। পাকিস্তানে চিনের ঋণ ফাঁদের তত্বটি পশ্চিমাদের সেই আধিপত্য ধরে রাখার কৌশল কিনা সেই নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।

রুশ ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু পর থেকে মার্কিন চাপ উপেক্ষা করেই রাশিয়া থেকে তেল এবং সামরিক সরঞ্জাম কিনছে ভারত। আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতে স্পষ্ট করে দিয়েছে যে মার্কিন চাপের কাছে মাথা ঝোঁকানো হবে না। এবার বৃটিশদের সৃষ্টি করা চীন-ভারত সীমানা বিবাদ কে কাজে লাগিয়ে চীন-পাকিস্তান জুজু দেখিয়ে অবাধ্য ভারতকে শিবিরে টানতে আবার চীনেত ঋনের তত্বটা প্রচার করা হল কিনা সেই নিয়ে সন্দেহ জাগতে বাধ্য।

লেখক

  • সৌম্য মন্ডল

    সৌম্য মন্ডল একজন আর্থ-সামাজিক এবং ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তিনি ইস্ট পোস্ট বাংলায় মুখ্য সম্পাদক হিসাবে কর্মরত। মূলত উদীয়মান বহু-মেরুর বিশ্বের নানা ঘটনাবলীর তিনি বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করেন।

    View all posts

সৌম্য মন্ডল একজন আর্থ-সামাজিক এবং ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তিনি ইস্ট পোস্ট বাংলায় মুখ্য সম্পাদক হিসাবে কর্মরত। মূলত উদীয়মান বহু-মেরুর বিশ্বের নানা ঘটনাবলীর তিনি বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করেন।

Leave a comment
scroll to top