Close

হরিয়ানা দাঙ্গা, বিদ্বেষ রাজনীতির বুমেরাং?

হরিয়ানার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বিদ্বেষের রাজনীতি কি বুমেরাং হয়ে গিয়েছে? ইস্ট পোস্ট বাংলার তরফ থেকে বিশ্লেষণ করছেন সৌম মন্ডল।

হরিয়ানার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বিদ্বেষের রাজনীতি কি বুমেরাং হয়ে গিয়েছে? ইস্ট পোস্ট বাংলার তরফ থেকে বিশ্লেষণ করছেন সৌম মন্ডল।

হরিয়ানার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বিদ্বেষের রাজনীতি কি বুমেরাং হয়ে গিয়েছে? ইস্ট পোস্ট বাংলার তরফ থেকে বিশ্লেষণ করছেন সৌম মন্ডল।

সাম্প্রতিক হরিয়ানা দাঙ্গার প্রসঙ্গে বুধবার, ২রা আগস্ট, হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খট্টর বলেছেন সবাইকে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয়, রাজ্যের জনসংখ্যা ২কোটি ৭০ লক্ষ, অন্যদিকে পুলিশ মাত্র ৫০/৬০ হাজার। সদ্ভাব থেকেই নিরাপত্তা আসে, সেইরকম পরিবেশ বানাতে হবে। 

যদিও ঠিক একদিন আগে, মঙ্গলবার, ১লা আগস্ট মুখ্যমন্ত্রী খট্টর ষড়যন্ত্র করে “ধর্মীয় যাত্রার উপর হামলার” কথা বলে হরিয়ানা দাঙ্গার জন্যে নুহ জেলার মুসলিমদের দায়ী করতে চেয়েছিলেন।

বুধবারের সরকারি হিসেব অনুযায়ী হরিয়ানা দাঙ্গায় এখনো পর্যন্ত মৃত ছয়জন। এই ছয়জনের মধ্যে দুইজন হোমগার্ড আছেন। গ্রেফতার হয়েছেন ১১৬ জন।

খট্টর-র বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে পুলিশ নয়, সদ্ভাব এবং সুস্থ পরিবেশই নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। আমরা দেখে নেব, হরিয়ানার দাঙ্গার আগে সেই রাজ্যে সদ্ভাবের পরিবেশ কেমন ছিল, যার জন্য হিংসা ছড়ালো, বা হিংসার পর কী ধরনের পরিবেশ তৈরি হল যার জন্য খট্টর-এর নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টির (BJP) সরকারের জোটসঙ্গী দলের উপমুখ্যমন্ত্রী, ও একই দলের এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অন্য সুর গাইছেন! 

হরিয়ানা দাঙ্গার কেন্দ্রস্থল হল ১,৮৬০ বর্গ কিমি আয়তন বিশিষ্ট নুহ জেলা। ২০১১ সালের আদম সুমারী অনুযায়ী এই জেলার জনসংখ্যা ১১ লাখের মত, যার ৭৯.২% মানুষই মুসলিম। নীতি আয়োগের দেওয়া ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী নুহ জেলার প্রায় ৪০% মানুষই দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করে। নুহ ভারতের অষ্টম দরিদ্র জেলা। ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র জেলা উত্তর প্রদেশের বাহারাইচ, যার ৫৪.৪৪% মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করে। 

নুহ ন্যাশেনাল ক্যাপিটাল রিজিয়ন বা দিল্লি এনসিআর এর অন্তর্ভুক্ত। এই অঞ্চলের মুসলিমরা মূলত মিও মুসলিম। রাজস্থান এবং হরিয়ানার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে মেওয়াত অঞ্চল জুড়ে এই মিও মুসলিম সম্প্রদায়ের বাস এবং এদের মূল পেশা দুধ উৎপাদন। তাই এককালে রাজস্থান-হরিয়ানা সীমান্তে অবস্থিত মেওয়াত অঞ্চলে গরু ও মহিষের ব্যাপক কেনা বেচা চলতো মিও মুসলিমদের দুধের ব্যবসার কারণে। আর এর ফলেই এই অঞ্চলে গো-রক্ষার নামে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর উপদ্রব শুরু হয় হরিয়ানা ও রাজস্থানে বিজেপি সরকার থাকাকালীন। 

এই অঞ্চলে গো-রক্ষকদের আক্রমণে যারা প্রাণ হারিয়েছে, তারা মূলত মিও মুসলিম। হরিয়ানা দাঙ্গার বহু আগে, সেই ২০১৬ সাল থেকে গো-রক্ষার নামে সন্ত্রাসের জন্য ব্যাক্তিগত ভাবে এবং  পেশাগতভাবে মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এরাই। হরিয়ানার গুরুগ্রাম থেকে রাজস্থানের আলওয়ার যাওয়ার জাতীয় সড়ক গোরক্ষক বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করে। গো-রক্ষকদের হাতে পেহলু খানের হত্যা সমেত বহু খুন এই রাস্তার উপরেই হয়েছে।

৩১ জুলাই, নুহ-এর হিংসায় যে দুজনের নাম উঠে আসছে, তারা হলেন মনু মানেসর এবং বিট্টু বজরঙ্গি। এই দুইজনেই বজরঙ্গ দল এবং গো-রক্ষা বাহিনীর মাথা হিসেবে পরিচিত। এই বছরই ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে, গো-রক্ষার নামে জুনেইদ(৩৫) আর নাসির (২৫) নামে রাজস্থানের দুই সংখ্যালঘু যুবককে গাড়ির ভিতর জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেওয়ায় অন্যতম মূল অভিযুক্ত মানেসর। যদিও ঘটনার পরে পাঁচ মাস কেটে গেছে, তবুও মানেসর গ্রেফতার হয়নি। 

এই হত্যার তদন্তে রাজস্থান পুলিশের দল হরিয়ানায় এলে, তাদের বিরুদ্ধে এফআইআর করে হরিয়ানা পুলিশ। রাজস্থান পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ, দুই মুসলিম যুবকের হত্যায় কান্ডে অভিযুক্ত একজনের স্ত্রী এর গর্ভপাত হওয়ার জন্য তারা দায়ী। এ ছাড়াও মানেসরের উপর থেকে এফআইআর প্রত্যাহারের দাবিতে মহাপঞ্চায়েতও ডাকা হয় গুরুগ্রামের মানেসর গ্রামে। 

“ফেরার” মানেসর তার সামাজিক মাধ্যমে বিজেপির রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বা অটোমেটিক আগ্নেয়াস্ত্রের সাথে নিজস্বী দিয়ে থাকেন। হরিয়ানা দাঙ্গার পর মনু বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিলেও পুলিশের কাছে সে এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে। যদিও হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন যে মানেসর কোথায় তাঁরা জানেন না, রাজস্থান পুলিশকে মানেসরের বিরুদ্ধে সবরকম সাহায্য করা হবে।

এই ৩১শে জুলাই ধর্মীয় যাত্রার আগেই মানেসরের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়, যেখানে তিনি নিজে মিছিলে উপস্থিত থাকার কথা জানান এবং তার সমর্থকদের জমায়েত হতে বলেন। অন্যদিকে বজরঙ্গির আরেকটি ভিডিও প্রচারিত হয় যেখানে সে মুসলিমদের উদ্দেশ্য করে বলে আমি তোমাদের জামাই, এলাকায় যাচ্ছি, আপ্যায়ন করার জন্য তৈরি থাকো। 

স্থানীয় মুসলিমদের অনেকে সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছে, কুখ্যাত গো-রক্ষা বাহিনীর খুনের আসামিদের এইরকম উস্কানিমূলক হুঙ্কার এলাকাবাসীদের আতঙ্কিত করে। 

যদিও রাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অনিল ভিজ বলেছেন যে,তিনি মানেসরের ভিডিও দেখেছেন, সেখানে আপত্তিকর কিছু নেই। এর আগে ভিজ সোমবার জানিয়েছিলেন যে ২,৫০০-৪,০০০ মানুষকে নরহর শিব মন্দিরে বন্দি করা হয়েছে। যদিও মন্দিরের প্রধান পুরহিত দ্য ওয়ার নামক পোর্টাল কে জানিয়েছেন যে, কাউকে কেউ বন্দি করেনি, বাইরে গোলমাল চলার কারণে মানুষরা মন্দিরে আশ্রয় নিয়েছিল। 

হরিয়ানা দাঙ্গার থেকে সহজেই অনুমেয় যে একদিকে যেমন উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা অস্ত্র সহ ধর্মীয় যাত্রায় অংশগ্রহণ করেছিল, তেমনি নুহ এর স্থানীয়রাও আক্রান্ত হওয়ার আশংকায় আত্মরক্ষায় প্রস্তুত হয়েছিলেন।

হরিয়ানার নুহ দাঙ্গার আগুন শুধু গুরুগ্রাম নয় ফরিদাবাদে সহ ৫০ কিমি এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ রেওয়াড়ি, সোনিপথ, পানিপথ, পাতৌদি, মানেসর, মহেন্দ্রগড় প্রভৃতি অঞ্চলে হিংসার আশংকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে। এ ছাড়াও ১লা ও ২রা আগস্টে দশম এবং দ্বাদশ শ্রেণীর পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। রাজস্থানের ভরতপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। উত্তর প্রদেশ সরকার হরিয়ানা মথুরার সীমানা সিল করে দিয়েছে। হরিয়ানায় সংলগ্ন উত্তর প্রদেশের জেলাগুলোতেও সতর্কতা জারি করা হয়েছে।

হরিয়ানার উপমূখ্যমন্ত্রী, জননায়ক জনতা পার্টির (জেজেপি) দুষ্মন্ত চৌতালা বলেছেন ধর্মীয় যাত্রার আয়োজকরা ভিড় নিয়ে সঠিক তথ্য দেননি। ফলত প্রশ্ন জাগে নুহ এলাকায় বিভিন্ন এলাকা থেকে লোক জূটিয়ে যাত্রা করার আসল উদ্দেশ্য কী ছিল?

গুরুগ্রামের সাংসদ, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাও ইন্দ্রজিৎ সিং গুরুগ্রাম ও নুহর ঘটনা নিয়ে রাজ্যের বিজেপি সরকারের দিকে আঙুল তুলেছেন। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, “ধর্মীয় মিছিলে অস্ত্র থাকবে কেন? প্রশাসন কী করছিল? কে ওদের হাতে অস্ত্র দিল?” 

প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও বিজেপি নেতা চৌধুরী বীরেন্দ্র সিং বলেছেন, “এখানে শান্তিপ্রিয় মানুষের বাস, কে কোন ধর্মের কিছু যায় আসে না, আমাদের মধ্যে যে ভাতৃত্ব বোধ ছিলো, তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে”।

দিল্লির উপকন্ঠে এই সমস্ত অঞ্চল থেকে মানুষ যেমন রাজধানীতে কাজ করতে আসেন, তেমনই গুরুগ্রাম, ফরিদাবাদ, নয়ডার মত অঞ্চলে গড়ে উঠেছে বাণিজ্য কেন্দ্র, অভিজাতদের আবাসন, স্মার্ট সিটি। উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের তহবিল দাতাদের একটা বড় অংশ এই সম্ভ্রান্ত অঞ্চলগুলোতে থাকে। ধনীদের অর্থায়নে যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের ভুতকে লালন পালন করা হয়েছে, সেই ভুত আজ দুরের কোনো প্রত্যন্ত গ্রাম, মফস্বল, হাইওয়েতে নয়, বরং বাণিজ্য কেন্দ্র, স্মার্ট সিটিতে এসে তান্ডব শুরু করেছে। 

অভিজাতদের অফিস বন্ধ, বাচ্চাদের স্কুল, পরীক্ষা বন্ধ। অন্যদিকে আগামী মাসে ভারতে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে জি-২০ বৈঠক, ঠিক তার পরের মাসেই ক্রিকেট বিশ্বকাপ। এরকম পরিস্থিতিতে মুসলিম ধর্মীয় নেতাদের আপ্যায়ন করে, মিশরে মসজিদ ঘুরে, মুসলিম নেতাদের বিভিন্ন পদে বসিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর সরকারের যে সহনশীলতার শাঁক প্রদর্শন করতে চাইছেন, মানেসর বা বজরঙ্গীদের মত হিন্দু বীররা হরিয়ানা দাঙ্গায় সেই শাঁক সরিয়ে মাছটাকে সামনে এনে দিয়েছে। 

এই বীরম্বনা থেকে বাঁচতেই কি বিজেপি নেতাদের ভোল বদল? দুয়ারে দাঙ্গা দেখে অভিজাত ভদ্রলোকেরা যদি আগামী লোকসভার আগে শিবির বদলান তবে এই হিন্দুত্ব রাজনীতিই কিন্তু শাসকদলের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে।

সৌম্য মন্ডল একজন আর্থ-সামাজিক এবং ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তিনি ইস্ট পোস্ট বাংলায় মুখ্য সম্পাদক হিসাবে কর্মরত। মূলত উদীয়মান বহু-মেরুর বিশ্বের নানা ঘটনাবলীর তিনি বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করেন।

Leave a comment
scroll to top