সৌদির চিঠি পর্ব ১৯
আজ সৌদি আরবের ৯৩তম জাতীয় দিবস। আনন্দ উত্তেজনা তুঙ্গে, ৩দিন ধরে রাস্তাঘাটে সমস্ত সৌদি নিজেদের গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে আনন্দোৎসব পালন করছেন। এই বিষয়ে একটু জানিয়ে রাখা ভালো, আজকের দিনে ১৯৩২ খ্রীস্টাব্দে রাজা আব্দুলাজিজ, যিনি ইব্ন সৌদ পরিচয়ে জনপ্রিয়, নাজ্দ এবং হেজাজ রাজ্য দুটোর ঐক্যর মাধ্যমে তৃতীয় সৌদ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়েছিলেন রিয়াধ শহরে। নতুন রাজতন্ত্রের জাতীয় ভাষা হিসেবে আরবি এবং জাতীয় সংবিধান হিসেবে কুরআন ঘোষণা করা হলো। ওয়াহাবি আস্থায় ইসলাম এই রাষ্ট্রের জাতীয় চিন্তাধারা হিসেবে বিচার করা হলো,এবং তারপর খনিজ তেল এবং নানা মূল্যবান খনিজ সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেল খুব শিঘ্রই।
মার্কিনি পুঁজি আসতে বেশি দেরি লাগেনি, এবং খুব তাড়াতাড়ি ড্রিলিং, উৎপাদন শুরু হয়ে গিয়েছিল। তখনও, মানে ষাটের দশক অবধি রিয়াধ শহরে মাটির ঘরের ছড়াছড়ি। আমার সিরিয়ান সিনিয়রের বাবা তখন সৌদি তে কাজ করতে এসেছিলেন, ওনাকে ১রিয়ালের বিনিময়ে সৌদি পাসপোর্ট পাওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, যা উনি এক জাতীয়তাবাদী বাথিস্ট সিরিয়ান হিসেবে খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সেই যুগে যারা সৌদি পাসপোর্ট গ্রহণ করেননি, তাদের উত্তরসূরীরা আজ এই বিষয়টা নিয়ে আক্ষেপ করেন!
৭০এর দশক থেকে তারপর তেলের জন্য সৌদির এবং পুরো গাল্ফের চেহারা বদলাতে শুরু করলো। কিছু জায়গায় অনেক আইনকানুনের একটু ছাড় দেওয়া হলেও সৌদি আরব নিজের গরিমা এবং গোঁড়ামি বজায় রাখলো। তখন কাতারে কাতারে মানুষ ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে পাড়ি দিলেন এক লাফে বড়ো লোক হওয়ার আশায়। পুরো গাল্ফের যেন এটাই প্রয়োজন ছিল – দ্রুত গতিতে উন্নয়নের জন্য সস্তায় শ্রম। পুরো পৃথিবীর মানুষ গাল্ফের এত দ্রুত এবং অভাবনীয় উন্নতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বাহবা দিয়ে মাতামাতি যখন করেন তখন প্রত্যেক বার যেন এক অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এড়িয়ে যান। গাল্ফ এর এহেন উন্নয়নের পেছনে ভারতীয় উপমহাদেশের শ্রমিকদের চূড়ান্ত অবদান। শুরু থেকেই, সমগ্র গাল্ফে এত উঁচু উচুঁ অট্টালিকা ইমারত ভারতীয়, বাঙালি, পাকিস্তানি, নেপালি শ্রমিকদের হাতেই গড়ে উঠেছে। এখানে সবাই মনে করেন আল্লাহ এত তেল সোনার প্রাচুর্যে ওনার পবিত্র ভূমি ভরিয়ে রেখেছেন। সেই প্রাকৃতিক ধনসম্পদ ভারতীয় শ্রম এবং বুদ্ধি ছাড়া যে এখনও মাটির তলাতেই পড়ে থাকতো তা অনেকেই এখনও ভেবে দেখেন না।
দুবাইতে এই ক্ষেত্রে ভারতীয়দের অবদান মোটামুটি সবাইই জানে এবং এই জন্য প্রতিষ্ঠিত ভারতীয়দের বেশ সম্মান দেওয়া হয়। শুনেছি দুবাইতে নাকি আসল অধিবাসীরা প্রবাসী দের বেশ সম্মান দিয়ে থাকেন এই কারনে। কিন্তু সে কথা আমি একজন উচ্চ মধ্যবিত্ত বাঙালির থেকে শুনেছিলাম যিনি দুবাইতে বেশ ভালো চাকরি করতেন এবং সেই ধরনের জীবনযাপনের ক্ষমতাও রাখতেন। শ্রমিকদের কি হাল হয় সবসময়, সেই নিয়ে আগে একবার লিখেছিলাম যখন একজন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছিলেন ছুটি না পেয়ে, যাতে অন্তত উনি নিজে না পৌঁছালেও ওনার মৃতদেহের সাথে ওনার পরিবারের কাছে ক্ষতিপূরণের কিছু টাকা পৌঁছায়।
যাই হোক, সৌদি জাতীয় দিবসের আসল তাৎপর্য যে কত উন্নতি হয়েছে, কোন পরিস্থিতি থেকে আজ কোন স্বর্গরাজ্যে এসে দাঁড়িয়েছে, সেই সব নিয়ে উৎসবের এক সুযোগ। পুরো রিয়াধ শহর সৌদি জাতীয় পতাকায় ছেয়ে আছে, সমস্ত ব্যাক্তি নিজের গাড়িতে জাতীয় পতাকা, রাজার ছবি লাগিয়ে এবং নানা আরবি এবং পার্টি সাজে সারারাত বন্ধুদের সাথে আনন্দ করতে বেড়িয়েছেন। আমার চোখে পড়লো, একটা গাড়িতে আবার ললিপপ লাগানো আছে! একটা গাড়ি আবার পাকিস্তানের ঝান্ডা ওড়াচ্ছে দেখলাম, নিশ্চয়ই পাঠানদের গাড়ি হবে। গানবাজনা চালিয়ে সবাই গাড়ির জানলা দিয়ে শরীর বার করে তালে তালে নাচতে নাচতে চলেছেন, কারুর তেমন কোনো গন্তব্য নেই, শুধু সারারাত পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে গাড়ি নিয়ে চক্কর কাটা আর কি। তেলের দেশে আর গাড়ি ঘোরাতে থাকার চিন্তা কি!
এই উদ্দেশ্যে পুরো শহরে যত উঁচু ইমারত, শপিং মল ইত্যাদি আছে, সবাই যতটা সম্ভব সবুজ আলোয় আচ্ছাদিত করে রেখেছে। পুরো দেশ যেন ঝকমক করছে, রাতে আবার আতশবাজির খেলা, ড্রোন শো, নানা আকর্ষণের ব্যবস্থা আছে। এইসবের মধ্যে দিয়েই ঘুরে ফিরে ঘরে ফিরে দেখছি, আমার মৈথিলী রুমমেট আলি(নাম পরিবর্তিত) রুম অন্ধকার করে মোবাইলে ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে রুটি খাচ্ছে! আমি রেরে করে উঠতে গেলাম, তখন ও বললো, যেহেতু একসাথে একই ঘরে এতজন কে একসাথে গরু ছাগলের মতো ঢুকিয়ে রেখেছে, তাই যাদের মর্নিং ডিউটি তাদের যেন অসুবিধা না হয় তাই ও আলো জ্বালায় না। আমার ঘরে পাঁচজন থাকি আমরা, অন্য অনেক জায়গায় বেআইনি হওয়া সত্ত্বেও মালিক এবং দালালরা ১০-১২জন কে একসাথে বাঙ্ক বেডের ব্যবস্থায় রাখে, প্রচন্ড অসুবিধার মধ্যেও মানিয়ে গুছিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে থাকেন তারা একটু বেশি রোজগারের আশা নিয়ে। তা আমি তারপর যখন আলি কে বলছি এত কষ্টের কোনো প্রয়োজন নেই, আমরা সবাই সবার জন্য একটু মানিয়ে নিতে পারবো, তখন ও জানালো, উত্তর বিহারের এক অতি প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এসছে ও, যেখানে এই কয়েক বছর আগে আলো এসেছে, তাও দিনে কয়েক ঘন্টার জন্য। অন্ধকারেই বড়ো হয়েছে ও, এত রোশনাইতে চোখ ধাঁধিয়ে যায় নাকি…