Close

খালিস্তানি আন্দোলন নিয়ে ভারত-কানাডা কূটনৈতিক দ্বৈরথ কোন দিকে যাবে?

খালিস্তানি সমর্থকের হত্যা কে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হওয়া ভারত-কানাডা কূটনৈতিক দ্বৈরথ থেকে কি দুই দেশের সম্পর্ক অবনতির দিকে যাবে? আমাদের বিশ্লেষণ।

খালিস্তানি আন্দোলন নিয়ে ভারত-কানাডা কূটনৈতিক দ্বৈরথ কোন দিকে যাবে?

PM meets with the Prime Minister of Canada, Mr. Justin Trudeau, in New Delhi on September 10, 2023. Photo: PIB

ভারত-কানাডা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোর ধাক্কা খেয়েছে খালিস্তানি নেতা হরদীপ সিংহ নিজ্জর হত্যাকাণ্ডের পরে। সরাসরি যখন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকারের দিকে এই হামলা নিয়ে আঙ্গুল তুলেছেন সেখানে ভারতীয় বিদেশমন্ত্রক যেমন অস্বস্তিতে পড়েছে, তেমনি ভারত-কানাডা প্রস্তাবিত বাণিজ্য চুক্তির ভবিষ্যতও অথৈ জলে পড়েছে। এর মধ্যে ভারতের শেয়ার বাজারে যে ১.৭৭ লক্ষ কোটি টাকা কানাডার পুঁজি লগ্নি করা রয়েছে, তার ভবিষ্যতও অনিশ্চিত। এই ভারত-কানাডা কূটনৈতিক দ্বৈরথের মধ্যে ভারতের টাকার দাম সামান্য বাড়লেও, পতন শুরু হয়েছে শেয়ার বাজারে।

ভারত-কানাডা কূটনৈতিক সংঘাতের ফলে মোদীর জাঁকজমক পূর্ণ জি-২০ শিখর সম্মেলন আয়োজন ও নিজেকে “বিশ্বগুরু” প্রতিপন্ন করার প্রচেষ্টার ফাঁপা দিকটা প্রকট হয়েছে যা বিদেশমন্ত্রক এখন চাপা দিতে চেষ্টা করছে। ভারত বারবার কানাডার কাছে নিজের মাটি ভারত-বিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্যে ব্যবহৃত না হতে দেওয়ার দাবি জানিয়ে এসেছে, বিশেষ করে ভারতীয় দূতাবাসের সামনে খালিস্তানি বিক্ষোভের পর থেকে। কিন্তু কানাডা মত প্রকাশের স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে ভারতের আর্জি কে খারিজ করেছে, যা ট্রুডো তাঁর জি-২০ সম্মেলনে দেওয়া সাংবাদিক বৈঠকে স্পষ্ট করে দেন।

প্রধানমন্ত্রী মোদীর কাছে কানাডার মতন পশ্চিমা দেশ, যেখানে অসংখ্য পাঞ্জাবি ও গুজরাটি জাতির মানুষ বসবাস করেন, খুবই একটি জরুরি দেশ। বিশেষ করে যখন প্রতিবেশী চীন কে জব্দ করতে নয়া দিল্লী ক্রমশ পশ্চিমাদের গা ঘেঁসে চলছে। সেই পশ্চিমা বিশ্বের এক গুরুত্বপূর্ণ দেশের সাথে খালিস্তানি আন্দোলন নিয়ে কূটনৈতিক সংঘাত যে এমন পর্যায়ে পৌঁছাবে যে ভারতীয় সরকারকে কানাডা তার দেশে গুপ্তহত্যা চালাবার দায়ে সরকারি ভাবে অভিযুক্ত করবে ও কূটনৈতিক অধিকারী কে বরখাস্ত করবে, সেটা ভারতীয় বিদেশমন্ত্রক “বিশ্বগুরু” হওয়ার দৌড়ে বুঁদ থাকায় আগের থেকে ভাবতে পারেনি। যদিও ভারতের খালিস্তান সমর্থকদের নিয়ে উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ আছে, তবুও ভারত-কানাডা কূটনৈতিক দ্বৈরথে কিন্তু ভারতেরই দায় বেশি।

বিক্ষোভের অধিকার

একটি গণতান্ত্রিক দেশের ভিতর সে দেশের নাগরিকদের বিক্ষোভ আর আন্দোলন করার অধিকার থাকে। যদিও মোদী জমানায় ভারতে সেই অধিকারগুলো কে নিষ্ঠুর ভাবে দমন করা হচ্ছে বলে বিরোধী দলগুলো সর্বদাই অভিযোগ করে থাকে। কিন্তু একটি দেশের নাগরিকদের কোন কোন আন্দোলন করা চলবে না সেটা কোনো দ্বিতীয় দেশের সরকার গায়ের জোরে চাপিয়ে দিতে পারে না।

হতে পারে ভারতের আইনে পাঞ্জাবের বিচ্ছিন্নতাবাদী খালিস্তানি আন্দোলন নিষিদ্ধ। হতে পারে ভারতে এই আন্দোলনের সমর্থকদের জঙ্গী হিসাবে দেখা হয় অতীতে পাঞ্জাবের রক্তাক্ত ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে অন্য দেশের সরকারকেও ভারতের নীতি গ্রহণ করতে হবে, যখন এই খালিস্তানের দাবি তার নিজের সার্বভৌমত্ব কে আঘাত করছে না। 

যেমন চীনে তিব্বতের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নিষিদ্ধ হলেও ভারতে আশ্রয় নেওয়া পশ্চিমাপন্থী তিব্বতের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সেই দাবি প্রকাশ্যে তুলে থাকে বা সেই নিয়ে প্রকাশ্যে আন্দোলন ও বিক্ষোভও করে থাকে। অতীতেও চীনের রাষ্ট্র নেতারা ভারতে আসার সময় এই রকম বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়। কিন্তু ভারত কী চীনের দাবি মেনে তিব্বতী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের গ্রেফতার করে তাদের উপর মোকদ্দমা করে?

যখন ভারত নিজে এই কাজ করে না, তখন সে কী করে আশা করে অন্য দেশগুলো তার দাবি মেনে চলবে? ভারতে কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নিষিদ্ধ হলেও যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমের বহুদেশে কাশ্মীরের মানুষ নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিয়ে আন্দোলন করে থাকেন, বিক্ষোভ দেখিয়ে থাকেন। কিন্তু তাঁদের বেশির ভাগ যেহেতু সেই সব দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন তাই তাঁদের উপর ভারতীয় আইন হিসাবে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেমন যায় না তেমনি সেই দেশের নির্দিষ্ট কোনো আইন না ভাঙলে, শুধু প্রতিবাদ করার জন্যে সরকার সেখানে তাঁদের গ্রেফতার করতে পারে না, ভারতের শত বিরোধ সত্ত্বেও। 

অন্য দিকে ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায়, বামপন্থী আন্দোলনের একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে, যার একটা বড় অধ্যায় জুড়ে আছে মার্কিন আধিপত্য বিরোধী আন্দোলন। বিশ্বের যে কোনো জায়গায় মার্কিন আগ্রাসনের বিরোধিতা করে মিছিল করার, মার্কিন পতাকা জ্বালানোর ও কনস্যুলেটের বাইরে বিক্ষোভ দেখানোর, যা অনেক সময় হিংস্র হয়ে উঠেছিল অতীতে, নজির রয়েছে। সেখানে যদি যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ভারতের উপর বিক্ষোভকারীদের দমন করার দাবি করতো তাহলে কি সেটা ভারতের সার্বভৌমত্ব কে আঘাত করতো না? বা ভারতীয় নাগরিকদের অধিকার কে খর্ব করতো না?

সকল দেশের নাগরিকদের যে নিজেদের দেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলন করার অধিকার আছে সে কথা নয়া দিল্লী না মানতে চাইলেও, সেটাই সত্য। ফলে অন্য কোনো দেশই নিজের দেশের নাগরিকদের উপর ভারতের দাবিতে যে দমন পীড়ন করবে না সেটা ভারতের জেনে রাখা উচিত, এবং নিজের দেশেও সেই ব্যবস্থা বহাল রাখা উচিত। এর অন্যথা হলে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার যেমন খর্ব হয় তেমনি অন্য দেশের হুকুম তামিল করলে নিজের দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বও বিনষ্ট হয়।

খালিস্তান, কানাডা ও বাক স্বাধীনতা

কানাডা বাক স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে খালিস্তান সমর্থকদের পক্ষে যতই যুক্তি দিক, ঘটনা হল ট্রুডো সরকার পাঞ্জাবি শিখদের দাবির প্রতি কোনো সমর্থন নেই, তেমনি এই সম্প্রদায়ের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতাও নেই। বর্তমানে ট্রুডোর লিবারেল পার্টির সরকার একটি সংখ্যালঘু সরকার ও তাঁর সরকার বাঁচানোর জন্যে দরকার নিউ ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সমর্থন। সেই নিউ ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতা জগমিত সিংহ একজন খালিস্তান সমর্থক হিসেবে পরিচিত এবং তাঁর ভোট ব্যাঙ্কের একটা বড় অংশ হল শিখ সম্প্রদায়। ভারতের পরে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি শিখ সম্প্রদায়ের মানুষের বাস কানাডায়, ফলে কোনো ভাবেই এই সম্প্রদায়ের ভোট ব্যাঙ্ক সিংহ বা ট্রুডো উপেক্ষা করতে পারেন না।

এর ফলে, নিজ দেশে অন্যান্য নানা বিষয়ে, বিশেষ করে রাশিয়ার ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযানের ঘটনায়, বা চীন-বিরোধী প্রচারের ঘটনায় ট্রুডোর লিবারেল পার্টির সরকার স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার কে খর্ব করতে কার্পণ্য বোধ করে না, কিন্তু খালিস্তান নিয়ে, বা ভারতের ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন নিয়ে সেই সরকার ও প্রধানমন্ত্রী একেবারে ১৮০ ডিগ্রি উল্টো অবস্থান নেন। এখানেই ব্যক্তি স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বা বাক স্বাধীনতা নিয়ে পশ্চিমা শক্তিগুলোর দ্বিচারিতা প্রকাশ পায়।

ভারতের উভয় সঙ্কট

যদিও মোদী সরকার বেশ তেড়েফুঁড়ে ভারত-কানাডা কূটনৈতিক দ্বৈরথে নেমেছে, কিন্তু এই সরকারও জানে যে এই বিষয়ে দুই পক্ষই বেশি দূর এগোতে পারবে না। এর কারণ যেমন ভূ-রাজনৈতিক তেমনি অর্থনৈতিক। 

বর্তমান বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে চীন কে টেক্কা দিতে পশ্চিমা শক্তির তরূপের তাস হল ভারত। ফলে ভারতের মতন দেশের সাথে কোনো রকম সামরিক জোট ছাড়াই ঢালাও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি বিক্রি করার ছাড়পত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের জো বাইডেন সরকার। ভারত আবার আগামী ২৬শে জানুয়ারি, প্রজাতন্ত্র দিবসে বাইডেন কে মুখ্য অতিথি হিসাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। ভারত বর্তমানে জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীন-বিরোধী সামরিক অক্ষ শক্তি কোয়াড গোষ্ঠীর সদস্য।

ফলে ভারতের বিরুদ্ধে কোনো পশ্চিমা শক্তির সরাসরি সমর্থন পায়নি ট্রুডোর কানাডা সরকার। আর কানাডাও চীন-বিরোধী ও রুশ-বিরোধী অক্ষ শক্তির সাথে হাত মিলিয়ে ভারত কে সরাসরি নিজেদের শিবিরে টানার প্রয়াসে জড়িত। তাই মুখে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার সরিতে হওয়া নিজ্জর হত্যাকাণ্ডে ভারত কে অভিযুক্ত করলেও এই সাময়িক দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক দ্বৈরথের চেয়ে বেশি কিছু ট্রুডো করবেন না, বা করতে পারবেন না অন্য পশ্চিমা শক্তির চাপ থাকায়। 

এহেন অবস্থায় দর কষাকষি করে ভারত-কানাডা বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করার উপরই নজর দেবে দুই পক্ষ সাময়িক বিরতির পরে। কানাডা কোনো ভাবেই যেমন ভারতের মতন সস্তা শ্রম, খনিজ সম্পদ ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের লোভ কাটিয়ে উঠতে পারবে না। ২০০০ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ভারতে ৩৩০ কোটি মার্কিন ডলার লগ্নি করেছে কানাডা। সেই দেশের নবম বৃহৎ বাণিজ্যিক মিত্র হল ভারত, এবং ভারতের পরিষেবা ও পরিকাঠামো ক্ষেত্রে কানাডার মোট বাহ্যিক লগ্নির ৪০.৬৩% ভারতে করা আছে। কোনো ভাবেই খালিস্তান নিয়ে ভারত-কানাডা কূটনৈতিক দ্বৈরথ কে এই বাণিজ্যের উপর প্রভাব বিস্তার করতে ট্রুডোর সরকার দেবে না।

ভারতও এই পরিস্থিতির কারণে কানাডার থেকে আগত লগ্নির ও সেই দেশ থেকে ভারতে পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা আটকাতে চাইবে না। ভারতের অসংখ্য মানুষ কানাডায় বসবাস করে বলে সেই দেশের সাথে চিরতরে সম্পর্ক অবনতি করার অভিপ্রায় ভারতের কোনো দিনই হবে না। কিন্তু ট্রুডোর মতন মোদীর ভোটব্যাঙ্ক আছে। সেই ভোটব্যাঙ্ক উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী এবং শিখ সহ সমস্ত ধরনের সংখ্যালঘুর তীব্র বিরোধী ভোটব্যাঙ্ক।

ফলে যদি মোদী আজ জাতীয়তাবাদী উন্মাদনার পথে না হেঁটে ট্রুডোর সাথে সন্ধি করেন, তাহলেও সেই ভোটব্যাঙ্ক চটে যাবে, আবার গুজরাটি সাবর্ণ হিন্দুদের একটা বড় অংশ কানাডায় বাস করে বলে তাঁদের স্বার্থও, বিশেষ করে ব্যবসায়িক স্বার্থও মোদী কে দেখতে হবে।

ফলে, এই ভারত-কানাডা দ্বৈরথে সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক সঙ্কটে পড়েছেন মোদী। এখন এই উভয় সঙ্কট থেকে বের হওয়ার একমাত্র উপায় হল সমস্ত বিষয় নিয়ে কানাডার সাথে আলোচনা চালানো ও ভারতের বক্তব্য যেমন জানানো তেমনি কানাডার পরিস্থিতিও উপলব্ধি করা। কিন্তু মোদী আমলে “বিশ্বগুরু” হওয়ার আকঙ্ক্ষায় চালিত ভারতের বিদেশমন্ত্রক সেই প্রচেষ্টা করবে কিনা সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।

Leave a comment
scroll to top