Close

এশিয়ায় ন্যাটো: ইউরোপের ভোগান্তি থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিৎ 

এশিয়ায় মার্কিন-নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর প্রবেশ নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হচ্ছে জোটের মধ্যেই। ইউরোপের অভিজ্ঞতার থেকে কী শিখতে পারি আমরা এই বিপদ নিয়ে?

এশিয়ায় ন্যাটো: ইউরোপের ভোগান্তি থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিৎ 

সোমবার, ৫ই জুন, ফিনান্সিয়াল টাইমস জানিয়েছে ফরাসি রাষ্ট্রপতি এমানুয়েল মাক্রোঁ এশিয়ায় উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংগঠন (ন্যাটো) নামক মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের বিস্তারের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছেন।  

ফিনান্সিয়াল টাইমস জানিয়েছে “গত সপ্তাহে একটি সম্মেলনে মাক্রোঁ বলেছেন ‘যদি আমরা ন্যাটোকে স্পেকট্রাম এবং ভৌগোলিক অঞ্চল বড় করার জন্য চাপ দিই, তাহলে আমরা একটি বড় ভুল করব’।”

এর আগে ৩রা মে নিকেই এশিয়ার একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ ইঙ্গিত করেছিলেন যে, চীন ও রাশিয়ার মোকাবিলায় ন্যাটোর মধ্যে আলোচনা চলছে যে এই সংগঠনটি জাপানের রাজধানী টোকিওতে একটি দফতর খুলবে। জাপানে এই ন্যাটোর ফাঁড়িটি প্রতিষ্ঠিত হলে তা হবে এশিয়ায় প্রথম।

নিকেই এশিয়া লিখেছে ন্যাটোর এই ফাঁড়িটি জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের সাথে পর্যায়ক্রমে পরামর্শ করবে, তা ছাড়াও পুরনো প্রতিপক্ষ রাশিয়া এবং উঠতি শক্তি চীনের উপর মনোনিবেশ করবে।

যদিও ন্যাটোর সংবিধি অনুযায়ী উত্তর আটলান্টিক ভৌগোলিক অঞ্চলের মধ্যেই ন্যাটোর এক্তিয়ার সীমাবদ্ধ। স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর আটলান্টিকের বাইরে ন্যাটোর পদার্পণ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বড়সর বিতর্ক ডেকে এনেছে।

প্রসঙ্গত ১৯৪৯ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব খর্ব করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে উত্তর আটলান্টিক অঞ্চলের ১২টি দেশকে নিয়ে গঠিত হয় ন্যাটো। বর্তমানে ন্যাটোর সদস্য সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১টি। ন্যাটোর মোকাবিলায় সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে ১৯৫৫ সালে গঠিত হয় “ওয়ারশ প্যাক্ট”। 

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্যে দিয়ে ওয়ারশ প্যাক্ট এর স্বাভাবিক মৃত্যু হওয়ার পরেও ন্যাটোকে বিলুপ্ত করা হয়নি। প্রথম এবং শেষ সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপতি মিখাইল গর্বাচভের সাথে সমঝোতা লঙ্ঘন করে রুশ প্রতিবেশী দেশগুলোতে ন্যাটো নিজেকে বিস্তার করেছে। ইউরোপের বিস্তারই রাশিয়াকে ইউক্রেনে “বিশেষ সামরিক অভিযানে” বাধ্য করেছে বলে বার বার দাবি করেছে রুশ কতৃপক্ষ।

সাবেক যুগোস্লাভিয়ার যুদ্ধ-আফগান যুদ্ধ হোক বা লিবিয়ার রাষ্ট্রপতি মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে হত্যা সমস্ত আগ্রাসী অভিযানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো-ভুক্ত দেশগুলোকে জড়িয়ে ফেলতে এবং অর্থনৈতিক ও সামরিক বোঝা ইউরোপীয় দেশগুলোর উপর চাপাতে সক্ষম হয়েছে বলে অভিযোগ। এবার চীনকে ঘিরতে নিজের এক্তিয়ারের বাইরে ভারত- প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ন্যাটোর বিস্তার ঘটাতে চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। নিজের স্বার্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো জোটকে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে টেনে এনে, অন্য ন্যাটো-ভুক্ত দেশগুলোর উপর অতিরিক্ত অর্থনৈতিক এবং সামরিক বোঝা চাপাতে চায় কিনা সেই নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে।

এপ্রিল মাসে চীনা রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং এর সাথে বৈঠকের পর মার্কিন সংবাদমাধ্যম পলিটিকোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মাক্রোঁ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর থেকে ইউরোপের নির্ভরশীলতা কমাবার পক্ষে সওয়াল করেন। ফরাসি রাষ্ট্রপতি বলেন, ইউরোপ যে “মহা বিপদের” সম্মুখীন হয়েছে, সেটা হল “এমন সমস্যায় জড়িয়ে পড়া যা আমাদের নয়।”

ইউক্রেনে রাশিয়ার “বিশেষ সামরিক অভিযান” শুরুর পর, জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস তাঁর দেশের জিডিপির ২% সামরিক খাতে ব্যয়ের কথা ঘোষণা করেন। কিন্তু ৫ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে জার্মান সরকারের মুখপাত্র সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়ে দেন যে ২০২৫ এর আগে সামরিক খাতে ২% ব্যয় বরাদ্দ সম্ভব হবে না।

সামরিক খাতে ব্যয় বাড়াতে জার্মানির ব্যর্থতা সম্পর্কে সম্ভ্রান্ত মার্কিন সংবাদ মাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে এই মত ব্যক্ত করা হয় যে, জার্মানি তার প্রতিরক্ষা ব্যয়ের প্রতিশ্রুতি এড়িয়ে যাচ্ছে, যা এশিয়ার ন্যাটোর বিস্তারকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

২৪শে এপ্রিল প্রকাশিত স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউট এর প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে ২০২২ সালে  ইউরোপের সামরিক খাতে ব্যয় সোভিয়েত পতনের পূর্বে ১৯৮৯ সালের সামরিক ব্যায়ের পর ১৩% বেড়ে সর্বোচ্চ হয়েছে। এই রিপোর্টে এই অত্যধিক সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির কারণ হিসেবে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ, মুদ্রাস্ফীতি ছাড়াও চীনকে রুখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টাকে দায়ী করা হয়েছে।

এশিয়ায় ন্যাটোর বিস্তারের পরিকল্পনা আঞ্চলিক দেশগুলোতেও চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এশিয়ায় ন্যাটোকে স্বাগত জানাচ্ছে মূলত জাপান। ফিনান্সিয়াল টাইমসকে আইআইএসএস থিঙ্ক-ট্যাঙ্কের জাপান বিশেষজ্ঞ ইউকা কোশিনো বলেছেন, টোকিওয় একটি অফিস ন্যাটোর ইন্দো-প্যাসিফিক অংশীদারিত্বকে আনুষ্ঠানিক এবং টেকসই করে তুলবে।

ফিনান্সিয়াল টাইমসকে জাপানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে প্রশাসনের একজন প্রাক্তন শীর্ষ কর্মকর্তা নোবুকাতসু কানেহারা বলেছেন, জাপান ইউক্রেনকে সমর্থন করছে কারণ তারা বিশ্বাস করে যে ইউরেশিয়ার উভয় প্রান্তের সমস্যাগুলি সংযুক্ত। “জাপান এবং ন্যাটোর মধ্যে সম্পর্ক দ্রুত ঘনিষ্ঠ হয়েছে কারণ তাদের মাথায় চীন রয়েছে”, কানেহারা বলেন।

মাক্রোঁর এশিয়ায় ন্যাটোর সম্প্রসারণের বিরোধিতা কে “সাহসী পদক্ষেপ” বলে প্রশংসা করেছে চীনা বিশেষজ্ঞরা। চীনা বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন বলেন “বেশিরভাগ দেশের অবস্থান খুবই স্পষ্ট: তারা এ অঞ্চলে বিভিন্ন সামরিক ব্লকের একীভূতকরণের বিরোধিতা করে, তারা এশিয়ায় ন্যাটোর সম্প্রসারণকে স্বাগত জানায় না, তারা এশিয়ায় ব্লক সংঘর্ষের স্থানান্তরকে মেনে নেয় না।”

ওয়াং আরো বলেন, আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলো “এশিয়ায় শীতল যুদ্ধ বা গরম যুদ্ধের অনুমতি দেবে না।”

অন্যদিকে মিডিয়া সূত্রে জানা যাচ্ছে কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন এশিয়ায় ন্যাটো বিস্তারের বিরোধিতা করে বলেছেন, “ন্যাটো শুধুমাত্র পশ্চিমে বিদ্যমান, এবং এখন এটি এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িত বলে মনে হচ্ছে, যা আসিয়ানের (ASEAN) জন্য উদ্বেগ নিয়ে আসছে।”

ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং অন্যান্য বেশ কয়েকটি দেশের প্রতিনিধিরা সিঙ্গাপুরে ২-৪ জুন অনুষ্ঠিত শাংরি-লা ডায়ালগ আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সম্মেলনে একটি নতুন শীতল যুদ্ধ দেখতে তাদের অনীহা প্রকাশ করেছে।

মাক্রোঁর এই বেঁকে বসা ভারত প্রসান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রথম ফাঁড়ি স্থাপন নিয়ে ন্যাটো জোটের ভিতরে চলা মাস খানেকের আলোচনায় জল ঢেলে দিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। জাপানে একটি অফিস খোলার জন্য উত্তর আটলান্টিক কাউন্সিলের সর্বসম্মত অনুমোদনের প্রয়োজন হবে, যেখানে ফ্রান্স তার ভেটো ব্যবহার করে পরিকল্পনাটি বাতিল করতে পারে।

ইউরোপীয়রা জানে চীনকে ঘিরতে ভারত প্রশান্ত মহাসাগরে ন্যাটোর উপস্থিত চীন এবং ইউরোপীয়দের পারস্পরিক সমঝোতা ভেস্তে দিতে পারে। যার ফলে হয়তো রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে চীন সরাসরি রাশিয়ার পক্ষ নিয়ে অস্ত্র পাঠাবে। ফলত পরিস্থিতি আরো জটিল হবে।

ইতিমধ্যে “ন্যাটো প্লাস পাঁচ” গঠন করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই অতিরিক্ত পাঁচটি দেশ হল অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপান, ইজরায়েল ও দক্ষিণ কোরিয়া। এই ন্যাটো প্লাসে ভারতকেও জুড়ে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। জুন মাসের শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরের আগে ভারতকে ন্যাটো প্লাসে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফে। প্রসঙ্গত এই সফরে এই মার্কিন কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে দ্বিতীয় বার ভাষন দেবেন মোদী। যা বিরল সম্মান বলে জানিয়েছে মার্কিন সংবাদ মাধ্যম।

যদিও বৃহস্পতিবার, ৮ই জুন, এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ভারতের ন্যাটো প্লাসে যুক্ত হওয়ার সম্ভবনা খারিজ করে দেন। জয়শঙ্কর বলেন, ন্যাটোর টেমপ্লেট ভারতের জন্য প্রযোজ্য নয়। ভারত নিজেই চীনের আগ্রাসন প্রতিহত করতে সক্ষম।

স্পষ্টতই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে ন্যাটো প্লাসে যুক্ত করে চীন বিরোধী তৎপরতার আর্থিক এবং সামরিক বোঝা ভারতের ঘাড়ে চাপাতে চাইবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ এর ইতিহাস বলছে সমস্ত অশুভ পদ্ধতি সহযোগে এ যেন তেন প্রকারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে নিজের জোটে নিতে চাইবে। সফল হনে কিনা সেটা অন্য কথা।

যদি কোনো ভাবে মার্কিনীরা সফল হয়, তবে বিভিন্ন বিষয়ে ভারত-চীন সমস্যা দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মধ্যে সমাধান দুরূহ হয়ে উঠবে। যা ভারতের রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্য এবং আর্থিক অগ্রগতির জন্য হবে বিপদজনক।

লেখক

  • সৌম্য মন্ডল

    সৌম্য মন্ডল একজন আর্থ-সামাজিক এবং ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তিনি ইস্ট পোস্ট বাংলায় মুখ্য সম্পাদক হিসাবে কর্মরত। মূলত উদীয়মান বহু-মেরুর বিশ্বের নানা ঘটনাবলীর তিনি বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করেন।

    View all posts

সৌম্য মন্ডল একজন আর্থ-সামাজিক এবং ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তিনি ইস্ট পোস্ট বাংলায় মুখ্য সম্পাদক হিসাবে কর্মরত। মূলত উদীয়মান বহু-মেরুর বিশ্বের নানা ঘটনাবলীর তিনি বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করেন।

Leave a comment
scroll to top