আবার বিতর্কিত মন্তব্য করে আলোড়ন ফেললেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। এবার তিনি সরাসরি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ‘অশিক্ষিত’ বলে দাবি করলেন। এই বিষয়টি শিক্ষার্থী থেকে অধ্যাপক কেউ মেনে নিতে পারছেন না। পড়ুয়াদের বক্তব্য যে মাটিতে দাঁড়িয়ে বিদ্যুৎ এই মন্তব্য করলেন সেটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরই জমি। এই উপাচার্যের আমলে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় সবসময় তেতে থাকে। এমনকী উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীকে একাধিকবার ঘেরাও পর্যন্ত করা হয়েছে।
এর আগেও একাধিকবার বিতর্কে নাম জড়িয়েছে উপাচার্যের। একাধিক মামলাও হয়েছে। বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর নামে অভিযোগ জমা পড়েছে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রক এবং রাজ্যপালের কাছে। গত বুধবার বিশেষ উপাসনায় শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্যবাহী উপাসনা মন্দিরে ভাষণ দিতে গিয়েই এমন বিতর্কিত মন্তব্য করেন তিনি বলে অভিযোগ। ইতিমধ্যেই সেই বিতর্কিত মন্তব্যের ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক মাধ্যমে। এই মন্তব্যের জেরে সর্বস্তরে সমালোচনা তুঙ্গে উঠেছে।
ঠিক কী বলেছেন বিদ্যুৎ চক্রবর্তী? উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী বলেন, “রবীন্দ্রনাথ-এর নাম নিয়ে শান্তিনিকেতন এখন স্বার্থসিদ্ধির সোপান হয়েছে। যাঁরা অন্যায় কাজ করেন তাঁরা নিজেদেরকে বলে ওঠেন রাবীন্দ্রিক। রবীন্দ্রনাথ নিজেই অশিক্ষিত। প্রথাগত শিক্ষা তিনি নেননি। বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থাকেই তিনি প্রাধান্য দিতেন। শিক্ষা দু’রকমের হয়। এক ধরনের শিক্ষা কেজি থেকে পিজি পড়াশোনা করলাম, ডিগ্রি লাভ করলাম এবং চাকরি করলাম। আর অন্যটি বিকল্প শিক্ষা। রবীন্দ্রনাথের সামাজিক ভাবনাচিন্তা আজও প্রাসঙ্গিক। যে শিক্ষা মানুষকে মানুষ তৈরি করে। সেই শিক্ষায় তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। এখন বিশ্বভারতীতে বিকল্প ভাবনা চিন্তায় আঁধার তৈরি হয়েছে।”
এই মন্তব্যের পরই শোরগোল পড়ে যায়। শান্তিনিকেতনে দাঁড়িয়ে কেউ এমন কথা বলতে পারেন তা ভাবতে পারছেন না রবীন্দ্রনাথ অনুরাগীরা। বিশ্বভারতীর পড়ুয়ারা বলেছেন, উপাচার্য মহাশয় যতই বিকল্প শিক্ষার কথা বলুন না কেন, তিনি আদতে প্রথাগত বাণিজ্যিক শিক্ষারই কান্ডারী। অনেকে তাঁকে এর আগেও, ‘হিন্দুত্ববাদী’, বিজেপি-আরএসএস সহ গেরুয়া শিবিরের ‘এজেন্ট’ বলে সমালোচনা করেছেন। বরাবরই শিক্ষার্থী থেকে অধ্যাপক তার মন্তব্য এবং চিন্তাধারার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন এবং বলেছেন তার কার্যকলাপ রবীন্দ্র চিন্তার পরিপন্থী। রবীন্দ্রনাথ যে মুক্ত চিন্তার কান্ডারী, তিনি সেই মুক্তচিন্তার গোড়ায় বার বার আঘাত করছেন; এমন অভিযোগ আজ নতুন নয়।
এদিকে আগেও শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক, প্রাক্তনী থেকে রাবীন্দ্রিকদের ভোগবাদী বলেছিলেন বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। অর্ধশিক্ষিত বলেও কটাক্ষ করেছিলেন। ছাত্রছাত্রী থেকে অধ্যাপকদের সাসপেন্ড করে তিনি বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তাঁর কথায়, শান্তিনিকেতনের জমি দখল করে রাখলেই রাবীন্দ্রিক। অন্যায় করলেই রাবীন্দ্রিক। বিশ্বভারতীকে অপমান করতে পারলে সেই ব্যক্তিও রাবীন্দ্রিক। যদিও এই ‘অন্যায়’ বা ‘অপমান’ আদতে কী সে ব্যাখ্যা কোনোদিনই দেননি তিনি। বেশ কিছু মাস আগে জমি বিতর্কে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের সঙ্গে সংঘাত চরমে উঠেছিল। এই বিষয়ে হাওয়া এখনও গরম শান্তিনিকেতনে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মামলা পর্যন্ত হয়েছে।
অমর্ত্য সেনের পাশে দাঁড়ানোয় রাজ্য সরকার এবং মুখ্যমন্ত্রীকেও আক্রমণ করতে ছাড়েননি বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। এর আগে মেলার মাঠ ঘিরে দেওয়ার বিতর্কের সময় বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগও আসে। যদিও জানা যায়নি তার উক্ত ‘ভোগবাদ’-এর সংজ্ঞা এর সাথে সম্পৃক্ত কি না। তাছাড়া, পৌষ মেলা কার্যত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অ-বিশ্বভারতীয় মানুষজনও বেশ ক্ষুদ্ধ তার উপর। কারণ পৌষ মেলা বাংলা তথা ভারতের অন্যতম ঐতিহ্যশালী মেলা ছিল। এছাড়াও ২০২০ সালে তিন পড়ুয়াকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করার ঘটনায় উত্তেজনা চরমে ওঠে। যদিও ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হচ্ছে বলে খবর। হাতে আছে আর মাত্র তিন মাস। তবে কি বিতর্কিত ব্যক্তিত্বের শিরোপা নিয়েই বিশ্বভারতী ত্যাগ করবেন তিনি? দেখা যাক।