Close

‘গে ইন্ডিয়া ম্যাট্রিমনি’ দেখানো হলনা স্কটিশ চার্চে: কী বলছে পড়ুয়ারা?

কলকাতার নামজাদা কলেজ স্কটিশ চার্চ। সেখানে রূপান্তরকামী নিয়ে দ্বিমত পড়ুয়াদের। বন্ধ হল সেমিনার। সরাসরি ইস্ট পোস্ট বাংলার খবর।

সমকামীদের নিয়ে ছায়াছবি দেখানোর কথা ছিল স্কটিশ চার্চ কলেজে। তবে কয়েক জন পড়ুয়ার আর্জিতে কলেজ কর্তৃপক্ষকে নাকি এমনই নির্দেশ দিয়েছে চার্চ। সেই কারণেই মঙ্গলবার প্রায় বিনা নোটিসেই বন্ধ হল ছবি প্রদর্শন ও আলোচনাসভা। এমনই অভিযোগ উঠেছে স্কটিশ চার্চ কলেজের বিরুদ্ধে। শহরের এমন ঐতিহ্যবাহী কলেজে এ বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ায় বিস্ময় এবং ক্ষোভ দেখা দিয়েছে নানা স্তরে। কলেজ কর্তৃপক্ষ অবশ্য দাবি কছেন, বাতিল নয়, পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে অনুষ্ঠান।

এক মাস ধরে চলছিল ছবি প্রদর্শনের আয়োজন। সমকামীদের নিয়ে তৈরি চলচ্চিত্রকার দেবলীনা মজুমদারের ছবি ‘গে ইন্ডিয়া ম্যাট্রিমনি’ দেখানোর কথা ঠিক হয়। তার পর ছিল আলোচনাসভা। তাতে ছবির পরিচালক দেবলীনার সঙ্গে যোগ দেওয়ার কথা ছিল ‘সাফো ফর ইকুয়ালিটি’-র দুই সদস্য সমাজকর্মী মীনাক্ষি সান্যাল এবং কোয়েল ঘোষের। স্কটিশ চার্চ কলেজের মনোবিদ্যা বিভাগ এবং ‘দ্য উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার ডেভেলপমেন্ট সেল’-এর সঙ্গে এই আয়োজনে হাত মিলিয়েছিল ইতিহাস, দর্শন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগও। এমএল ভৌমিক অডিটোরিয়ামে দুপুর ১.৩০ থেকে শুরু হওয়ার কথা ছিল অনুষ্ঠান। দিকে দিকে ছড়িয়ে গিয়েছিল পোস্টার। কিন্তু সকালে সুর বদলাল কলেজ। হঠাৎই ফোন এল, অনুষ্ঠান বাতিল। দেখানো যাবে না ছবি।

মঙ্গলবার রাত ১২:৫৯ নাগাদ ছাত্রদের তরফ থেকে একটি মেইল করা হয় স্কটিশ চার্চ কলেজের অধ্যক্ষকে। সেই মেইল মারফৎ জানতে চাওয়া হয় মূলত তিনটি বিষয়।



১) স্কটিশ চার্চ কলেজ, একটি সংঘবদ্ধ প্রোটেস্ট্যান্ট সংঘ নর্থ ইন্ডিয়ান চার্চ মারফৎ পরিচালিত হয়। এই সংঘের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রূপান্তরকামী প্রশ্ন এবং যৌনতা পুনর্রূপান্তরিতকরণ অস্ত্রোপচার সম্পর্কে ভিন্ন মত রয়েছে। ভারতের বিভিন্ন খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মধ্যেও এই নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ কোনাও ধর্মীয় প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে এই অনুষ্ঠান আয়োজন করছে কি না?
২) যদি তা না হয়ে থাকে এবং এই সেমিনার আসলেই মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর ভিত্তি করে আয়োজিত হয় তবে যেন অন্যান্য সামাজিক বিষয়ের সেমিনার আয়োজন করতেও বাকী ছাত্রছাত্রীদের ছাড় পত্র দেওয়া হয়।
৩)এর আগে আসামের বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা আন্দোলনের বিষয়ে একটি সেমিনার আয়োজন করার কথা কলেজ কর্তৃপক্ষকে জানানো হলে তারা তা নাকচ করে দেন এই মর্মে যে সেক্ষেত্রে ব্যায়ভার আয়োজকদের বহন করতে হবে কারণ কলেজের কাছে ফান্ড ছিল না। তার পরেই এই তথ্যচিত্রটি দেখানোর উদ্যোগ যখন কর্তৃপক্ষ নিজেই বহন করছেন তখন কি পরবর্তীতে অন্যান্য সেমিনারের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সময় বরাদ্দ করা সহ এইভাবে কর্তৃপক্ষ আর্থিক সাহায্য করবে?

উক্ত মেইলের প্রেরক ছিলেন ইন্দ্রানুজ রায় এবং সৈকত বিশ্বাস। উভয়েই কলেজের পদার্থবিদ্যার স্নাতক স্তরের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। এই মেইলের বিষয়ে ইন্দ্রানুজের সাথে যোগাযোগ করা হলে তার বক্তব্য, “বিজ্ঞান সবসময় অবজেক্টিভিটিকে সামনে রাখে, কে কী বলল তার উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানের বাস্তবতা বদলে যায়না। ট্রান্স ইস্যুকে নিয়ে যে তর্ক বিতর্ক চলছে তাতে ট্রান্স পক্ষের ব্যক্তিরা মূলত নিজে কী মনে করে সেটাই প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়াছে। স্রেফ আপেক্ষিক এই ভাবনাকে আমরা ভুল মনে করি এবং আমরা মনে করি একটি অবৈজ্ঞানিক চেতনা কে যুব সমাজের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা চলছে এর মাধ্যমে। দ্বিতীয়তঃ, আমাদের মনে হয় নন অ্যাকাডেমিক বা অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের একটি পক্ষপাতিত্ব থেকে যাচ্ছে। এর আগে ১৯শে মে, বরাক উপত্যকার গণহত্যা নিয়ে, যেটি মূলতঃ বাংলার তিন ভাষা দিবসের এক ভাষা দিবস উল্লেখ করে আমরা প্রোগ্রাম করতে চাই‌। সেটি আমাদের করতে দেওয়া হয়নি। তখন কর্তৃপক্ষের তরফে জানাও হয় ফান্ড নেই এবং করতে হলে নিজেদের টাকা পয়সা খরচ করে করতে হবে। অথচ এই ইস্যুতে দেখা যাচ্ছে এতগুলো ডিপার্টমেন্ট মিলে এবং সেল থেকে ফান্ডিং করা হচ্ছে এবং এক্স্ট্রা টাইমিংও বরাদ্দ করা হচ্ছে। এই রকম ফান্ডিং এর রিসোর্স আমাদের অন্যান্য ইস্যুতে দেওয়া হচ্ছে না। এই বৈষম্যের পেছনে কারণ কী?”

ইস্ট পোস্ট বাংলার তরফ থেকে ইন্দ্রানুজ রায় কে জিজ্ঞাসা করা হয় যে তারা সমকামী বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের বিরুদ্ধে কি না। তার উত্তরে ইন্দ্রানুজ বলেছে, “না। একটা কমন মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং কাজ করে, সেটা হচ্ছে, মেল ফিমেল ও ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে লিঙ্গ ভিত্তিক বিভাজন করা হয়। এখান থেকে যে ধারণা প্রচলিত হয়েছে যে ট্রান্সজেন্ডার এবং ‘হিজরা’ কমিউনিটি আসলে এক। কিন্তু আসলে ‘হিজরা’ কমিউনিটির মানুষজন বা যারা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ তারা ট্রান্স নয়, তারা ইন্টারসেক্স। এবং আমরা সমকামী, উভকামী ও ইন্টারসেক্সদের পক্ষে। তাদের উপর সামাজিক অবমাননার বিরুদ্ধে আমরা, তাদের অধিকারের জন্যই আমরা বক্তব্য রাখি। কিন্তু ট্রান্স বলে যে বিষয়টি চলছে এটি একটি সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক এবং ভাববাদী বিষয়। এর মাধ্যমে অপবিজ্ঞান প্রচার করা হচ্ছে। এই ডক্যুমেন্টারিটায় যে ‘প্রাইড’ বলে শব্দবন্ধটি ব্যবহৃত হচ্ছে, যার ছত্রছায়ায় LGBTQIA সবাই পড়ছে। আমরা নির্দিষ্টভাবে এই ক্যুইয়ার বা ট্রান্সের বিরুদ্ধে।”

আরও পড়ুন: ট্রান্স নারীর কাছে ২০ বার দৌড়ে হার। অতঃপর জয়ী নারী অ্যাথলিট

ইন্দ্রানুজ আরও বলেছেন, “এছাড়াও সেক্স রিঅ্যাসাইনমেন্ট সার্জারির মাধ্যমে যে ক্ষতিটা হচ্ছে সমকামীদের সামাজিক নিরাপত্তাহীনতাকে কাজে লাগিয়ে, তারপর সার্জারির বিষয়ে ব্যাপক খরচ ও হরমোন ট্রিটমেন্টে কিন্তু আয়ুও অনেক কমে যাচ্ছে মানুষের। তারা যে একপ্রকার প্রতাড়িত হচ্ছে আমরা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে। এই সার্জারিকে যদি একটা সার্ভিস হিসেবেই দেখা হয় তাহলে এটা ক্রেতা অধিকারের প্রশ্ন। এই প্রতারণার বিরুদ্ধে আমরা এই মানুষদের সাথেই দাঁড়াতে চাইছি। এছাড়াও দীর্ঘ নারী আন্দোলনের মাধ্যমে নারী প্রশ্নে যে অধিকারগুলো অর্জন করা হয়েছিল, তা আজ বিপদের মুখে। কারণ যারা বায়োলজিক্যাল মেল কিন্তু নিজেদের ট্রান্স বলে দাবী করছেন তারা এই পরিসরে ঢুকে পড়ছেন। যদিও ব্যাপক অর্থে এটি আমেরিকায় দেখা গিয়েছে কিন্তু ভারতেও অ্যাকাডেমিক অংশে বা সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সারদের দ্বারা এটা যেভাবে প্রোজেক্ট করা হচ্ছে তাতে সমস্যা গভীর। আমরা এ বছর মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিকের ফল ঘোষণার সময়ই এর একটা বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাচ্ছি।”

আরও পড়ুন: ট্রান্সজেন্ডার চিন্তার সমালোচনা করায় চাকরি থেকে বরখাস্ত নারী কর্মী। সমর্থন করলেন জে কে রাউলিং। পুরষ্কৃত করলেন বৃটিশ সরকার

এরপর সৈকত বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও জানিয়েছেন,”প্রথমত এই বিষয়টায় মানুষের ধর্মীয় ভাবনায় আঘাত লাগে। এছাড়াও, বৈজ্ঞানিকভাবে পরিবারের যে ধারণা, যা নারী এবং পুরুষ বাইনারি দিয়ে তৈরি তার বিরুদ্ধে যাচ্ছে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি আঘাত করছে সামাজিক সমানাধিকারের উপর। লিঙ্গ ভেদে নারী ও পুরুষ নিয়ে যে দুটি সেক্টর আছে সেখানে যে যা চায় তাই তো হতে পারে না। আজ একটা জৈবিকভাবে পুরুষ যদি নিজেকে রূপান্তরকামী ঘোষণা করে লেডিস টয়লেটে ঢুকে পড়ে তাহলে নারী সুরক্ষার কী হবে? তাছাড়া ইন্টারসেক্স কমিউনিটির জন্যও আলাদা করে কোনও আইন নেই। আমি একটা কিন্নর সেজে কোনও মেয়েকে উত্তক্ত করলে কিন্তু আমার সাজা হবে না। হয়তো বেশ কিছুদিন আটক করে রাখতে পারে। এইসব জিনিস নারী অধিকারের উপর বেশি আঘাত আনছে।” যদিও এই মর্মে কলেজের অধ্যক্ষর সাথে ইস্ট পোস্ট বাংলা যোগাযোগ করলে তিনি জানান যে প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করা হয়েছে কিন্তু কোনও নির্দিষ্ট কারণ তিনি দেখাননি। সরাসরি বলেছেন, “আপনাদের বলবো না।”

অন্যদিকে অনুষ্ঠান বাতিল প্রসঙ্গে মতামত জিজ্ঞাসা করা হলে ইন্দ্রানুজ বলেন “আমরা চাইনি অনুষ্ঠান বাতিল হোক, আমরা শুধু এই বিষয়ে বিরুদ্ধ মত রাখার সুযোগ চেয়েছিলাম, LGBTQ প্রচারে অথরিটি যে সুযোগ সুবিধা দিয়েছে, একাডেমিক বা অন্যান্য সামাজিক বিষয়ে অনুষ্ঠানে আমরা সম সুযোগ চেয়েছিলাম। LGBTQ বা প্রাইডের নামে ভাববাদ, অপবিজ্ঞান প্রচার করুক আমাদের আপত্তি নেই, কিন্তু আমরাও বিজ্ঞানের ছাত্র, আমরা অবজেক্টিভিটিতে বিশ্বাস করি, বস্তুবাদী মতামত প্রচারের অধিকার আমাদেরও আছে। সেই সুযোগটুকু চেয়েছিলাম মাত্র।”

ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর সাংবাদিকতার ছাত্রী ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, যিনি শ্রম, কৃষি ও রাজনীতি নিয়ে রিপোর্টিং করেন।

Leave a comment
scroll to top