শুক্রবার, ৪ঠা আগস্ট, বোম্বে হাইকোর্টের নাগপুর বেঞ্চের দ্বিতীয় বরিষ্ঠ বিচারপতি রোহিত দেও প্রতিদিনের মতন যথা সময়ে এজলাসে এসেছিলেন। আসার পরে তিনি নজিরবিহীনভাবে নিজের পদত্যাগ ঘোষণা করেন। কিন্তু কেন? বিচারপতি দেও ২০১৭ সালে জুন মাসে বোম্বে হাইকোর্টে নিযুক্ত হন, ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে তার অবসর গ্রহণের কথা ছিল। এর আগে তিনি মহারাষ্ট্র সরকারের এডভোকেট জেনারেল নিযুক্ত হয়েছিলেন।
আদালতে উপস্থিত আইনজীবীরা জানিয়েছেন, বিচারপতি দেও বলেন, “আদালতে যাঁরা উপস্থিত আছেন, আমি আপনাদের প্রত্যেকের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আমি আপনাদের বকাঝকা করেছি কারণ আমি আপনাদের উন্নতি করতে চাই। আমি আপনাদের কাউকে আঘাত করতে চাই না, কারণ আপনারা সবাই আমার পরিবারের মতো এবং আমি দুঃখিত যে আমি আমার পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছি। আমি আমার আত্মসম্মানের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারি না। আপনারা কঠোর পরিশ্রম করেন”।
বিচারপতি দেও সম্প্রতি দুটি গুরুত্বপূর্ণ রায় দিয়েছিলেন, প্রথমটি হল গত বছর অক্টোবরে নিষিদ্ধ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী) [সিপিআই (মাওবাদী)] সাথে সংযোগ থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত যাবজ্জীবন সাজাসাজা প্রাপ্ত দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জিএন সাই বাবা কে বেকসুর খালাস করেন।
অধ্যাপক সাইবাবা ২০১৭ সালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। এ ছাড়াও বিচারপতি দেও এবং অনিল পানসারের ডিভিশন বেঞ্চ অন্য পাঁচ অভিযুক্ত মহেশ তিরকি, পান্ডু পোরা নরোটে, হেম কেশবদত্ত মিশ্র, প্রশান্ত রাহি এবং বিজয় নান তিরকিকে ঐ মামলা থেকে অব্যবহি দেন।
যদিও বিচারপতি দেও-এর আদেশের ঠিক পরের দিনই রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টে যায়, এবং পরবর্তীকালে, সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের রায় কে স্থগিত করে। সুপ্রিম কোর্ট পর্যবেক্ষণ করেছিল যে হাইকোর্ট সাইবাবা এবং অন্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগের গাম্ভীর্যে গুরুত্ব দেয়নি।
এই বছরের এপ্রিলে, শীর্ষ আদালত হাইকোর্টের আদেশ বাতিল করে এবং মামলাটিকে আবার হাইকোর্টে ফেরত পাঠানো হয়। তবে মামলাটি নতুন বেঞ্চে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। মাত্র এক সপ্তাহ আগে, নাগপুর বেঞ্চ এই বিষয়ে একটি আপিলের শুনানি শুরু করে।
দ্বিতীয়টি হল, জুলাই মাসের শেষের দিকে তিনি ৩রা জানুয়ারী তারিখের মহারাষ্ট্র সরকারের প্রস্তাব বাস্তবায়নে স্থগিতাদেশ জারি করেন। এই প্রস্তাবটি রাজ্য সরকারকে নাগপুর-মুম্বাই সমৃদ্ধি এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের সাথে জড়িত ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে গৌণ খনিজগুলির বিনা অনুমতিতে উত্তোলনের সাথে সম্পর্কিত রাজস্ব বিভাগ কর্তৃক গৃহীত শাস্তিমূলক পদক্ষেপ প্রত্যাহার করার ক্ষমতা দিয়েছিল।
উক্ত দুই ঘটনাই ঘটে গেছে গত দুই সপ্তাহের মধ্যে। যদিও বিচারপতি সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন যে পদত্যাগের কারণ “ব্যক্তিগত”। তবুও এই প্রশ্ন উঠবেই যে, একদিকে মহাসড়ক নির্মাণের সাথে জড়িত ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, অন্য দিকে র্যাডিক্যাল বাম আন্দোলন এবং মানবাধিকার আন্দোলনের সাথে জড়িত ব্যাক্তিদের মামলা থেকে খালাস করার জন্যেই কি প্রশাসনের চাপে পড়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন বিচারপতি দেও?
প্রসঙ্গত ২০১৪ সালে ১লা ডিসেম্বর হৃদয় রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় বোম্বে হাইকোর্টের নাগপুরের বিচারপতি ব্রিজগোপাল হরকিষণ লোয়া-র। বিচারপতি লোয়া বর্তমানে ইউনিয়নের গৃহমন্ত্রী অমিত শাহের বিরুদ্ধে ওঠা একটি খুনের মামলার বিচার করছিলেন। ২০১৭ সালে এক অনুসন্ধানী সাংবাদিক দাবি করেন বিচারপতি লোয়া-র মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। অভিযোগ করা হয় যে লোয়া-কে হত্যা করা হয়। অভিযোগের আঙুল ওঠে খোদ শাহের বিরুদ্ধে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী-র আমলে ১২ই জানুয়ারি ২০১৮ সালে আরেকটি নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে। প্রকাশ্যে সাংবাদিক সম্মেলন করেন সুপ্রিম কোর্টের চার বিচারপতি। তাঁরা দাবি করেন “হুমকির মুখে ভারতীয় গণতন্ত্র” তাই তাঁরা প্রকাশ্যে আসতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁদের অভিযোগ ছিল পদ্ধতি অনুযায়ী কেস বন্টন হচ্ছে না, বিচার ব্যবস্থায় প্রশাসনের হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত করেছিলেন তাঁরা।
ফরাসি দার্শনিক মন্তেস্কু আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মৌলিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিচার, শাসন আর আইন বিভাগের স্বাতন্ত্র্যতার কথা বলেছিলেন। এই স্বাতন্ত্র্যতা না থাকাটাকেই অনেক রাষ্ট্র তাত্ত্বিক ফ্যাসিবাদ বলে মনে করেন। ভারতেও কি বিচার বিভাগে প্রশাসনের হতক্ষেপ ঘটছে, যার জন্য নজিরবিহীন ভাবে সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিরা প্রকাশ্যে সাংবাদিক সম্মেলন করেছিলেন? বা হাইকোর্টের বিচারপতি দেও পদত্যাগ করলেন? ভারতে কি বিচার, আইন, শাসন বিভাগের স্বাতন্ত্র্যতা বিলুপ্তির পথে? এই প্রশ্নগুলো অবশ্যই রাষ্ট্র গবেষণা বিষয় হতে বাধ্য।