এখন যে চাকরিটি করছি, সেটা দুই বছর আগে খুবই লোভনীয় মনে হয়েছিল। ভারতে চাকরি করে খুব একটা সুবিধা হবে না, এমন আরও লক্ষ লক্ষ “NRI শ্রমিক” এর মত আমারও তাই মনে হয়েছিল সেই সময়ে। এখানে অনেক বাঙালি শ্রমিক সেই যাত্রা শুরু করার মূহুর্তের কথা মনে করে ঠাট্টা করে বলে ওঠে, “চাচা আমি বিদ্যাস যাইতাসি, আমার জইন্যা দূয়া কইরো!” কেউ কারুর ঘর, কেউ কারুর বাসা ছেড়ে এত দূরদেশে পাড়ি দিয়ে এসছে একটাই স্বপ্ন নিয়ে – বেশি টাকা পাবো। এবং সেই আশা পূরণ হতে সময় লাগেনি একদমই।
আমার সঙ্গে কাজ করা কয়েকজন নেপালি “দাই” দের ন্যূনতম বেতন দেওয়া হয় ১,২০০-১,৩০০ সৌদি রিয়াল, বর্তমানে যা ভারতীয় টাকার হিসাবে ২৫,০০০ টাকার বেশি। নেপালি রুপিতে হয়তো ৪০,০০০-এরও ওপরে পৌঁছাতে পারে। অর্থাৎ সেই নেপালি বন্ধুরা হোটেলে ক্লিনারের কাজ করে যা রোজগার করছে, ভারতে আমি কলেজ ডিগ্রি নিয়ে হোটেলে কুক হিসেবে তার অর্ধেক আয় করতে পারি!
এখানে মনে পড়ে গেল, সেদিন এক জায়গায় পড়লাম যে এক নতুন সমীক্ষায় জানা গিয়েছে যে ভারতে যদি আপনার মাইনে ২৫,০০০ টাকা হয়, তাহলে অভিনন্দন, আপনি ভারতীয় জনসংখ্যার আর্থিক আঙ্গিকে প্রথম ১০ শতাংশের মধ্যে স্থান অর্জন করেন! খুবই গৌরবের বিষয় বলতে হবে, দেশে ফিরে বুক বাজিয়ে সবাইকে বলতে হবে! এহেন পরিস্থিতিতে মনেই হবে যে খুব সুখী জীবন কাটাচ্ছি। “মিড্ল ইস্টার্ন ড্রিম” বলতে গেলে যা বোঝায়!
আমি যেখানে এই মূহুর্তে কর্মরত, সেটি এক রেস্টুরেন্ট গ্রুপ, যার জেড্ডায়ে অবস্থিত এক রেস্টুরেন্টে আমি শেফ হিসেবে কাজ করি। এই ক্ষেত্রে এক আজব বিষয় জানিয়ে রাখি, আমার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী আমার সাথে এই ধরনের কাজে লোকাল সৌদি কর্মচারী পাওয়া মুশকিল। প্রথম-প্রথম যখন এসেছিলাম, তখন ভীষণ অবাক হতে হয়েছিল পথে ঘাটে দোকানে বাজারে সব জায়গায় বাঙালি দেখে। ভারতীয়, পাকিস্তানি, নেপালি কর্মীও কম নেই কিন্তু বাঙালি সবচেয়ে বেশি।
আমার এক বাঙালি সহকর্মী এবং বন্ধু তখন আমায় জানিয়েছিল যে সৌদি আরবে এই মূহুর্তে ৩০ লক্ষ বাঙালি থাকেন। অনেকের মনে এই চিন্তা ছিল যে এই দেশে কাজ করতে এসে আরেকটু বেশি বেতন লাভের সাথে সাথে মক্কা মদিনা ঘুরে আসার সুযোগও হয়ে যাবে। শুধু বাংলাদেশের মানুষের নয়, আমার পরিচিত অনেক পাকিস্তানি মুসলমান এবং আমার কয়েকটি উজবেকিস্তানের সহকর্মীরও একই চিন্তা।
মক্কায় উমরাহ করতে যাওয়ার আশায় এই রকম লক্ষ লক্ষ মানুষ এখানে কর্মচারী হিসেবে এসে তুলনামূলক ভাবে ভাল চাকরির সুযোগ করে নিচ্ছেন। কিন্তু তার পরেই এই সুন্দর পরিকল্পনার অন্যদিকটাও জানতে পারলাম। আমার যে বন্ধুটি ওই বাঙালি, ইন্ডিয়ান, ইত্যাদির পরিসংখ্যান বোঝাচ্ছিল, সে জানালো, সৌদি তে আসার পর দীর্ঘ “আড়াই বছর ফ্রি তে কাজ” করেছে। আমার তো মাথায় হাত; এমন কেন হলো?
কথোপকথনগুলি একটু তুলে ধরি না হয়-
“দাদা আমি ১৯ বছর বয়সে এসেছিলাম, এমন নয় যে বাসায় খুব অভাব তার জন্য… নিজের ইচ্ছাতেই গ্রাম পরিবার সব ছেড়ে, নতুন দেশ, মক্কা দেখবো বলে।”
“তা সেই ক্ষেত্রে তোমার নিজের খরচা ছিল নাকি এখানে কোম্পানি ডায়রেক্ট চাকরি দিয়ে নিয়ে এসেছিল?”
“হাঃ হাঃ কি বলছো গো দাদা, খরচা মানে খরচা! সমস্ত বাঙালি, অর্থাৎ বাংলাদেশি লেবার এখানে টাকা দিয়েই তো আসে!”
“এ বাবা, তাই নাকি? কত দিতে হয়েছিল?”
“বাংলাদেশিদের ৫ লক্ষ বাংলাদেশি টাকা দিতে হয় এখানে কর্মী হিসেবে আসার জন্য…”
“…….কি বললে ভাই?”
“হ্যাঁ ঠিকই শুনেছো। সরকার থেকে বারণ করে কিন্তু দালাল পেরিয়ে তো আর আসতে পারবে না দাদা!”
“কিন্তু… অত যদি ডিপোজিট দাও, তাহলে তোমার মাইনে কত হবে?”
“শুরু করেছিলাম ৬৫০ রিয়াল (তখন যা ছিল ১৬,০০০-১৭,০০০ বাংলা টাকা), এখন কোম্পানি বদলে বদলে সেটা ১,৪০০ রিয়াল (প্রায় ৩৮০০০ বাংলা টাকা) দাঁড়িয়েছে।”
“সেকি, এটা আবার কী রকম অঙ্ক হলো?”
মধ্যবিত্ত পরিবারে বেশ আদরে বড়ো হয়েছি তো, মাধ্যমিক পরীক্ষায় অঙ্কে ৯৬ পাওয়া সত্ত্বেও এখনও পৃথিবীর অনেক প্যাঁচানো অঙ্ক ঠিক ধর্তব্যে আনতে পারিনি।
“ধার হিসেবে ৫ লক্ষ ডিপোজিট করেছিলাম দাদা, মাস গেলে মাইনে থেকে কেটে নেবে এই চুক্তিতে। শুধু খাওয়ার জন্য একটুখানি রাখতে পারতাম, তা ছাড়া প্রথম আড়াই বছর ফ্রি তে বাসন মাজার কাজ করেছি মদিনায়…।”
“তাহলে… দেশেও ফেরত যাওনি এতদিন?”
“ওরে বাবা, হাঃ হাঃ হাঃ ! কী বলছো গো! এখন টাকা পাঠাতে পারি তিন-চার মাস পর পর, দেশে তো পাঁচ বছর হয়ে গেল যাইনি!”