Close

সৌদির চিঠি: “পাওনা টাকা তুই রাখ” পালিয়ে গেল দুজনে, পর্ব ২

আমি দিল্লিতে হোটেল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে কলেজ পাশ করেছি। সেই কারনেই সৌদিতে আমার চাকরির এখানে,আমার গুরুত্ব একটু বেশি।

সৌদির চিঠি: "পাওনা টাকা তুই রাখ" পালিয়ে গেল দুজনে, পর্ব ২

সৌদির চিঠি: NRI শ্রমিকের চাকরিটা লোভনীয় মনে হয়েছিল, কিন্তু তার পর? – পর্ব ১

আমি দিল্লিতে হোটেল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে কলেজ পাশ করেছি। সেই কারনেই সৌদিতে আমার চাকরির এখানে,আমার গুরুত্ব একটু বেশি, অনেক ক্ষেত্রে বাকি নিরক্ষর অথবা ইংরেজি না জানা শ্রমিকদের জন্য দোভাষীর কাজ করতে হয় ম্যানেজমেন্টের পক্ষ থেকে।

শ্রমিকরা মনে করেন, তাঁরা ইংরেজি বলতে পারেন না বলে তাঁদের উন্নতি আটকে, এবং ম্যানেজমেন্ট এই সুযোগেরই ফায়দা লুটছে সবরকম ভাবে। যাই হোক, এই কাজ টা করতে গিয়েই সেদিন বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো।

আমাদের সবচেয়ে সিনিয়র অর্থাৎ একজিকিউটিভ শেফ সমস্ত কর্মচারীদের ট্রেনিং এবং ব্রিফিং করাচ্ছিলেন কাজের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি খামতি মেটানোর জন্য। সেই সময়ে, একজন নতুন নেপালি “কাঞ্চা”, অনিমেষ(নাম পরিবর্তিত) প্রথমবার বিদেশে এসে এরকম একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানের কাজ না বুঝতে পেরে পিছিয়ে থাকছিল বাকিদের তুলনায়।

শেফ বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও যখন দেখলেন যে ও এখনি বিদেশে এসে দুই সপ্তাহের মধ্যেই আমাদের “ফাইন ডাইন শেফ” হিসেবে রেজাল্ট দিতে পারবে না, তখনই আমাকে অর্ডার দিলেন, “ট্রান্সলেট টু হিম, আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু সি হিম ফ্রম টুমোরো”।

এতক্ষন আমি সমস্ত কথা নির্দ্বিধায় দু তরফে বুঝিয়ে যাচ্ছিলাম, এবার আমি কী করে এই কথা টা ওকে বলবো… শেফ আমাকে হুকুম করছেন একটা সর্বশান্ত, রীতিমতো ছেলেমানুষ শ্রমিককে ফায়ার করার কথা জানাতে, সবার সামনে, সেই মূহুর্তে।

হিন্দিতে পুরো বাক্য টা বলতে গিয়ে আমার গলায় যেন আর জোর পাচ্ছিলাম না। আমার মতোই ২৩ বছর বয়সী একটি ছেলে, অনিমেষ সারাক্ষণ একটা ভয় ভয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে যেন। গ্রামীন অঞ্চলে অল্প বয়সেই বিয়ে-পরিবার একরকম বাধ্য হয়েই করে ফেলতে হয় এবং পরিবার সামলানোর জন্য আরেকটু ভালো মাইনের আশায় দালাল কে মোটা টাকা দিয়ে সেই পরিবার ছেড়েই বিদেশ পাড়ি দিতে হয়।

অনিমেষেরও একই বাধ্যতা। সেই দালাল রা কোনো কিছু বিচার না করে বেশি মুনাফার লোভে ওকে কম মাইনেতে দামি একটি পোস্টে পাঠিয়ে দিয়েছে, যেটার দায়িত্ব সম্বন্ধে ওর কোনো ধারণাই ছিল না, পুরোনো অভিজ্ঞতা তো দূর। শুধু ক্লায়েন্ট এবং শ্রমিকদের থেকে মোটা অঙ্ক নেওয়ার উদ্দেশ্যে যে কাউকে যেকোনো পোস্টে নামিয়ে দিয়েই খালাস যেন। তার পূর্ব অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, চরিত্র কিছুই বিচারের প্রয়োজন নেই। অনিমেষ প্রথম যেদিন এসেছিল, পকেটে একটি টাকাও ছিল না। আমি খেতে বসিয়েছিলাম নিজের সাথে, নাহলে নাকি খালি পেটেই ঘুমিয়ে পড়তো। দুই সপ্তাহ আগে সেদিন ভীষণ খুশি হয়ে অরম শিশুসুলভ চোখে আমার দিকে কৃতজ্ঞতা ভরে তাকিয়েছিল, সেদিনই মায়া লেগে গেছিলো ছেলেটার জন্য। ভীষণ স্বল্পভাষী, একটি শিশুর মতোই দুচোখ ভরে এই নতুন দেশ দেখতো। চলে যাওয়ার সময়ে আমার দিকে এক পলক চেয়ে চোখ সরিয়ে নিল।

এর পরেরদিন আবার আরেক কান্ড। হোটেলের দুজন ভারতীয় সাফাইকর্মী মাইনে আসার সঙ্গে সঙ্গে পালিয়েছে! অনেকদিন ধরেই হুমকি দিচ্ছিল যে এরম পরিস্থিতিতে কাজ করবে না, চলে যাবে সুযোগ পেলেই , অবশেষে সেটাই করে বসলো। দুজনে একসাথে কাজ বন্ধ করলো, যাতে ওই কিচেনের ওই রাতের জন্য কোমর ভেঙে যায়। হোটেল থেকে কতবার ফোন করল, ওদের দালাল নিজে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো দেখা করতে, কত আশ্বাস দিল যে বাকি সমস্ত পাওনা মেটাবে‌, কিছু তেই বরফ গললো না।

উত্তর প্রদেশের সেই দুই শ্রমিক,যার মধ্যে একজনের বয়স মাত্র ১৯, সাফ জানিয়ে দিল, “এসব পাওনা টাকা তুই রাখ! চাইনা এসব আর!এত মাস ধরে বলছি কাজ স্বাভাবিক ৮ ঘন্টা করাতে হবে এবং কাজের সময়ে ভদ্রলোকের মতো সম্মান দিতে হবে, এতদিন যখন কানে যায়নি তখন এভাবেই তোদের মাথায় ঢুকবে। রাখ তোর টাকা, রাখ তোর হোটেল, আমরা চললাম!” এছাড়াও আরও অনেক রকম ভাষা ব্যবহার হয়েছিল, সেসব না হয় নাই বললাম!

রাতে আমার সাথে একবার দেখা করতে এসেছিল আমার সেই দুই বীর। জানিয়ে গেল, “দাদা আমরা মদিনা চলে যাচ্ছি, কাজের অভাব নেই কোথাও!যা বলেছিলাম করে দেখালাম! দেখি কার ক্ষমতা আমাদের আটকায়!” হাঁ করে ওইটুকু ছেলেটার মিনমিনে গলায় এই হুঙ্কার শুনলাম। একটুও বাড়িয়ে বলছি না, ওর শেষ একটা কথা এখনও কানে বাজছে, “ভাইয়া, অব হাম আজাদ হো গ্যেয়ে, কিসি কা গুলাম নহি রাহে!!”

সৌদির চিঠি; জুম্মায় এক অভাবনীয় কান্ড ঘটে গেল! পর্ব-৩

Leave a comment
scroll to top