গত সপ্তাহে হাওড়ার শিবপুরে রাম নবমীর মিছিল কে কেন্দ্র করে হওয়া সাম্প্রদায়িক অশান্তির রেশ মিটতে না মিটতেই রবিবার, ২রা এপ্রিল, আবার সেই রাম নবমীর নামে অশান্তির আগুন লাগলো পার্শ্ববর্তী হুগলী জেলার রিষড়ায়। হাওড়া-বর্ধমান মেন লাইনে অবস্থিত রিষড়ায় রাম নবমীর মিছিল সংক্রান্ত সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের পরে, বর্তমানে পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। রিষড়ায় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের পরে সরকার সেখানে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্যে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।
রবিবারের পরে সোমবার, ৩রা এপ্রিলও সকাল থেকে রিষড়ার জিটি রোড সংলগ্ন অঞ্চল জুড়ে বিক্ষিপ্ত আকারে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ হয় এবং রাত ৯.৩০ থেকে রিষড়া স্টেশন চত্বরেও ব্যাপক বোমাবাজি শুরু হয়, যার ফলে হাওড়া-বর্ধমান মেন লাইনে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। মাঝরাত পর্যন্ত ব্যাপক বোমাবাজি চলতে থাকে রিষড়া স্টেশন অঞ্চলে।
রিষড়ায় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের সূত্রপাত ও ঘটনাবলী
রিষড়ায় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় রবিবার বিকাল নাগাদ, যখন ইউনিয়নের শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সাংসদ দিলীপ ঘোষের উপস্থিতিতে একটি বিশাল রাম নবমীর সশস্ত্র মিছিল রিষড়া স্টেশন সংলগ্ন বাঙুর পার্ক থেকে শুরু হয়ে জিটি রোড পৌঁছায় এবং সেখান থেকে মাহেশের মন্দিরের দিকে অগ্রসর হয়। কয়েক হাজার বিজেপি সমর্থক, যাদের বেশির ভাগই অবাঙালি হিন্দু, এই মিছিলে অংশগ্রহণ করেন বলে জানা গেছে।
হাওড়া-বর্ধমান মেন লাইন রিষড়া কে দুই ভাগে বিভক্ত করে। রেল লাইনের পশ্চিম দিকে মূলত বাঙালি হিন্দু ও মুসলিমদের বাস আর পূর্ব দিকে মূলত অবাঙালি হিন্দু ও মুসলিমদের বাস। এই পূর্ব দিকেই জিটি রোডের ধারে, গঙ্গার তীরে অবস্থিত বিগত ২৫ মাস ধরে বন্ধ ওয়েলিংটন জুট মিল। এ ছাড়াও এখানে আছে হেস্টিংস জুট মিল।
ওয়েলিংটন জুট মিলের উল্টো দিকে, জিটি রোড আর মসজিদ লেনের সংযোগ স্থলে অবস্থিত রিষড়া জামা মসজিদ। এই মসজিদে রবিবার সন্ধ্যা ৬.৩০ নাগাদ নামাজ পড়তে জড়ো হন মুসলিমেরা। সেই সময় ঘোষের নেতৃত্বে বিজেপির রাম নবমীর মিছিল সেখানে পৌঁছায় এবং তারস্বরে ডিজেতে গান বাজাতে থাকে ও প্ররোচনামূলক স্লোগান দেয়। তখন অঞ্চলের মুসলিমেরা মিছিলকারীদের মাইক বন্ধ করার অনুরোধ জানালে বাকবিতন্ডা শুরু হয় আর তারপর সেটা সংঘর্ষের রূপ নেয়।
এর পরে এই অশান্তি জিটি রোডের ধারে মসজিদ লেন, মৈত্রী লেন, এনএস রোড, প্রভৃতি জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। পাথর ছোড়াছুড়ি শুরু হয় এবং তারপরে দেশি বোমা পড়া শুরু হয়। গুলি চলে বলেও অভিযোগ। হিংসায় লিপ্ত সমাজবিরোধীরা রাস্তায় দাঁড়ানো গাড়ি ও দুই চাকার বাহন ভাঙচুর করে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। বাদ যায়নি পুলিশ আর দমকলের গাড়িও।
বিজেপি বিধায়ক বিমান ঘোষ ও রিষড়া থানার অফিসার ইনচার্জ পিয়ালী বিশ্বাস সহ অনেকে আহত হন, তবে কারুর নিহত হওয়ার খবর নেই। পুলিশ সোমবার সকাল পর্যন্ত রিষড়ায় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ১২জন কে গ্রেফতার করেছে ও এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে।
অবস্থা বেগতিক দেখে ঘোষ উপদ্রুত অঞ্চল থেকে সরে পড়েন। তিনি অভিযোগ করেন যে এই অশান্তি রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের কারসাজি এবং পুলিশ হিংসা দমন করতে ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে, তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য সভার সাংসদ শান্তনু সেন অভিযোগ করেন যে এই অশান্তি বিজেপি চক্রান্ত করে লাগিয়েছে এবং এর সাথে বিহার, মহারাষ্ট্র, প্রভৃতি রাজ্যে চলমান রাম নবমীর মিছিল কে কেন্দ্র করে হওয়া হিংসার ঘটনার তিনি তুলনা করেন।
এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের অভিযোগ পুলিশ তৎপর হলে রবিবারে হিংসার ঘটনা ঘটতো না। অভিযোগ উঠেছে যে রাম নবমীর মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের সাথে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের বাকবিতন্ডা শুরু হয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে হিংসাত্মক লড়াই শুরু হতেই পিছু হটে পুলিশ। এর পরে অবশ্য বিশাল বাহিনী এসে লাঠি চার্জ করে ও কাঁদানি গ্যাসের শেল ছুড়ে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনে।
সোমবারও জারি থাকে রিষড়ায় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা
কিন্তু রবিবারেই রিষড়ায় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা বন্ধ হয়নি। চাপা উত্তেজনা থাকে সারা অঞ্চল জুড়ে। সোমবার ইস্ট পোস্ট বাংলার প্রতিবেদককে অঞ্চলের মানুষ জানান যে তাঁরা ভীষণ আতঙ্কে রয়েছেন কারণ অঞ্চলে চরম ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে মেরুকরণ চলছে এবং তার ফলে নানা অঞ্চলে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ হয়েই চলেছে।
সোমবার বিকালে ওয়েলিংটন জুট মিল সংলগ্ন অঞ্চলে গিয়ে দেখা যায় যে সেখানে জিটি রোডের ধারে সমস্ত দোকান, এমন কি খাবারের দোকানও বন্ধ রয়েছে। জিটি রোডের সাথে যুক্ত ছোট রাস্তা ও গলিগুলোয় কিছু দোকান খোলা থাকলেও লোকজন বিশেষ নেই। মসজিদ লেনের জামা মসজিদ ও মৈত্রী পথের রুহানি মসজিদের সামনে ব্যাপক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। নানা হিন্দু মন্দিরের সামনেও পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। জিটি রোড জুড়ে বারবার রুট মার্চ করছে র্যাপিড অ্যাকশন ফোর্স (র্যাফ)।
এর পরেই, সন্ধ্যা ৬.৩০ থেকে মৈত্রী পথ, মসজিদ লেন, গান্ধী সড়কের নানা গলিতে বিক্ষিপ্ত হিংসার ঘটনা ঘটার খবর পাওয়া যায়। ইস্ট পোস্ট বাংলার প্রতিবেদক জানাচ্ছেন এর পরে কাউকেই আর রাস্তায় দেখা যায়নি। নানা জায়গায় পাথর ছোড়া ও বোমাবাজির ঘটনা ঘটে। প্রতিবেদক আরও জানালেন মৈত্রী পথ সংলগ্ন নানা গলিতে পুলিশ বাহিনী ঢুকে সেখানে জড়ো হওয়া ভিড় কে ছত্রভঙ্গ করা শুরু করে। রাত ৯.১৫ নাগাদ রাস্তাগুলো একদম শুনশান হয়ে যায়। কাউকেই আর পথে দেখা যায়নি। তবে স্টেশনের কাছে গেরুয়া পতাকা লাগানো মোটরসাইকেলে বেশ কিছু যুবককে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়।
ইস্ট পোস্ট বাংলার প্রতিবেদক জানাচ্ছেন যে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে একে অপরের প্রতি সন্দেহ বেড়ে গেছে জিটি রোড সংলগ্ন অঞ্চলগুলোয়। তাঁরা একে অপরের অঞ্চলে যেতে ভয় পাচ্ছেন। জয়শ্রী টেক্সটাইল ও অন্যান্য কারখানার শ্রমিকেরা প্রতিবেদককে জানান যে তাঁরা কাজে যেতে ভয় পাচ্ছেন রিষড়ায় সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনার কারণে।
ইফটু শ্রমিক ইউনিয়নের রাজ্য কমিটির সদস্য মাধব উপাধ্যায় সোমবার রাতে ইস্ট পোস্ট কে জানান যে জয়শ্রী টেক্সটাইলের মধ্যে অনেক শ্রমিক আটক হয়ে রয়েছেন কারণ তাঁরা ভয়ে ছুটির পরেও বাড়ি যেতে পারছেন না। তাই ইউনিয়নের তরফ থেকে কতৃপক্ষের কাছে দাবি করা হয় যে বাইরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত শ্রমিকদের কারখানায় থাকার ব্যবস্থা করা হোক। উপাধ্যায় জানালেন সেই দাবি কতৃপক্ষ মেনে নিয়েছে।
এর মধ্যেই শান্ত থাকা রেললাইনের পশ্চিম পাড়েও সোমবার রাত ৯টা থেকে ব্যাপক বোমাবাজি ও পাথর ছোড়াছুড়ি শুরু হয়। নয়া বস্তি অঞ্চলের থেকে সংঘর্ষ শুরু হয় বলে অভিযোগ করেন উপাধ্যায়।
এই বোমাবাজি ক্রমেই রিষড়া স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় এসে যায়। বোমাবাজির ফলে ৪ নং রেলগেট বন্ধ করা অসম্ভব হয়ে যায় ফলে হাওড়া-বর্ধমান মেন লাইনে ট্রেন চলাচল ৯.৩০ থেকে বন্ধ হয়ে যায়। স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বর্ধমানগামী আর স্টেশনের থেকে একটু দূরে হাওড়াগামী লোকাল ট্রেনগুলো আটকে পড়ে। বিশাল পুলিশ বাহিনী ও র্যাফ গেলেও অশান্তি চলতে থাকে। রাত ১টার পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয় এবং ট্রেন চলাচল শুরু হয়।
শ্রমিক ইউনিয়ন নেতৃত্বের বক্তব্য
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই) হুগলি জেলার সহ সম্পাদক ও জেলার অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের (এআইটিইউসি) সম্পাদক প্রাণেশ বিশ্বাস জানান যে তাঁরা চান শান্তি ফিরে আসুক। তিনি বলেন যে সিপিআই চায় যে কোনো মূল্যে শান্তি ফিরে আসুক ও প্রশাসন সঠিক তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিক। তিনি বলেন যে বন্ধ ওয়েলিংটন জুট মিলের শ্রমিকদের ঐক্য ভাঙার ষড়যন্ত্র হচ্ছে এবং সিপিআই মানুষ কে নিয়ে এই চক্রান্ত কে প্রতিহত করবে।
কংগ্রেসের শ্রমিক সংগঠন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের (ইনটাক) নেতা আঞ্জুম পারভেজ জানালেন যে যেহেতু পরিস্থিতি ভাল নয় তাই তিনি কথা বলার অবস্থায় নেই।
ইফটুর নেতা উপাধ্যায় জানান শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। তিনি অভিযোগ করেন ৩০-৩৫ বছরে রিষড়ায় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের এই রকম ঘটনা ঘটেনি। তিনি অভিযোগ করেন যে রিষড়ায় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির “গটাপ” এর কারণে সম্ভব হয়েছে। তিনি বললেন তাঁর সংগঠনের প্রাথমিক লক্ষ্য হল শ্রমিকদের সুরক্ষার বন্দোবস্ত করা।
সাধারণ মানুষের কথা
ইস্ট পোস্ট বাংলার প্রতিবেদক জানালেন যে রিষড়ায় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা নিয়ে সোমবার সাধারণ মানুষ বারবার তাঁদের ক্রোধ ব্যক্ত করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শ্রমিক অভিযোগ করেন যে পরিকল্পিত ভাবে এই অঞ্চলে উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয়েছে যার ফলে রাজনৈতিক নেতাদের লাভ হলেও চরম ক্ষতি হচ্ছে তাঁদের মতন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের।
ওয়েলিংটন জুট মিল সংলগ্ন অঞ্চলের উভয় সম্প্রদায়ের স্থানীয় মানুষের অভিযোগ তাঁরা হিংসার ঘটনায় জড়িত নন তবে তাঁদের অঞ্চলে ধর্মীয় মেরুকরণ করা হচ্ছে রাজনৈতিক স্বার্থে। কারা মেরুকরণ করছে জানতে চাইলে তাঁরা সকলেই উত্তর দিতে অস্বীকার করেন।
রেল লাইনের পশ্চিম পাড়ের বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলের বাসিন্দা সুকেশ মালী নামক স্কুল শিক্ষক জানালেন যে তিনি রবিবার বিকাল ৪টা নাগাদ উত্তরপাড়ার থেকে ট্রেনে করে ফিরে দেখেন যে স্টেশনের কাছে রাম নবমীর মিছিল। সেখানে তিনি দেখেন রাস্তায় গেরুয়া ফেট্টি বাঁধা লোকজনের ভিড়, তাঁরা ডিজে বাজাচ্ছিল ও “জয় শ্রী রাম” হুঙ্কার দিচ্ছিল। মালী বলেন সেই হুঙ্কার মানুষ কে ভয় পাইয়ে দিতে পারে। মালী জানান বাড়ি এসে তিনি জানেন যে দাঙ্গা শুরু হয়েছে।
তিনি অভিযোগ করেন যে তিনি খোঁজ নিয়ে জেনেছেন যে জিটি রোডে মসজিদের কাছে গিয়ে প্ররোচনামূলক স্লোগান দেয় মিছিলের লোকজন যার ফলে “ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গিয়ে মুসলিমেরা প্রতিবাদ করেন”। তিনি আক্ষেপ করেন যে তাঁর স্কুলের অন্তত তিনজন পড়ুয়াকে, যাঁরা এবার মাধ্যমিক দিয়েছে, তিনি এই মিছিলে অংশগ্রহণ করতে দেখেছেন।
মাঝ রাত পর্যন্ত রিষড়া স্টেশনে আটকে থাকা যাত্রীরাও ইস্ট পোস্ট বাংলার প্রতিবেদকের কাছে তাঁদের ক্ষোভ ব্যক্ত করেছেন। বর্ধমানগামী আটক লোকাল ট্রেনে আটক যাত্রীদের অভিযোগ যে পুলিশ চাইলেই কড়া হাতে রিষড়ায় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা দমন করতে পারতো, কিন্তু রাজনৈতিক কারণে পুলিশ কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না, যার ফলে ভোগান্তি ও অসুরক্ষা বাড়ছে সাধারণ মানুষের।