ব্যান্ডেলের ঠিক পরের স্টেশন বাঁশবেড়িয়া। একসময়ের শিল্প শহর, এখন রুগ্ন। আর এই ছোট্ট শহরেই ১৫ই অগাস্ট ঘটে গেছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা। কিছু মূলস্রোতের সংবাদ মাধ্যম বাঁশবেড়িয়ায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে ছোট করে খবরও করেছে, অন্যদিকে ভারতীয় জনতা পার্টি’র (বিজেপি) রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার এই হিংসা নিয়ে বিবৃতিও দিয়েছেন।
বাঁশবেড়িয়ায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ফি বছর হওয়া রামনবমীর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মত দৃষ্টি আকর্ষণ না করলেও, এর গুরুত্ব কম নয়। কারণ এই রুগ্ন শিল্প শহরে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের উৎপত্তি হয়েছে একটি বেসরকারি উচ্চমাধ্যমিক স্কুল থেকে।
বুধবার, ১৬ই অগাস্ট, তখন বিকেল পৌনে চারটে বাজছে। বাঁশবেড়িয়া রেলস্টেশন চত্বর শুনশান, মোটামুটি এরকমই থাকে সাধারণত। খানিক পরে বোঝা গেল এই শুনশান পরিবেশ অন্যান্য দিনের থেকে একটু বেশিই শুনশান। স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে মাত্র একটি টোটো এবং একটি রিকশা।
মধ্যবয়সী টোটো চালককে কলবাজার যাবে কি না জিজ্ঞাসা করায় বললেন, “ঐ দিকে যাওয়া যাবে না, ঝামেলা চলছে”। এই বলে টোটো চালক রেফার করে দিলন পক্ককেশ বৃদ্ধ রিকশা চালকের দিকে।
বৃদ্ধ রিকশা চালকও কলবাজার যেতে রাজি নন। তবে তিনি হংসেশ্বরী মন্দির অবধি যেতে রাজি হলেন। হংসেশ্বরী মন্দির থেকে কলবাজার হেঁটে যেতে প্রায় দশ মিনিট লাগে।
বৃদ্ধ রিকশা চালক জানালেন, “খুব ঝামেলা হচ্ছে, আজ বোমাবাজি হয়েছে, গুলি চলেছে; পুলিশ ঐদিকে যেতে দেবে না।” তবে কারা ঝামেলা করেছে সেই বিষয়ে কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায় বা রাজনৈতিক দলের নাম নিতে তিনি রাজি হননি।
বৃদ্ধ রিকশা চালকের নাম মানিক কর্মকার, দেখে ৭০ উর্ধ্ব মনে হলেও, তাঁর দাবি অনুযায়ী বয়স ৬২, কারণ বার্ধক্য ভাতা পাচ্ছেন না তিনি, সেই নিয়ে চর্চা করতে গিয়ে, নিজের বয়স নিয়ে নিশ্চিত হয়েছেন। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যে রিকশা চালাতে চালাতে মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এমনিতে বাজার খারাপ, তার উপর এই ঝামেলার ফলে আরো অবস্থা খারাপ হয়েছে।”
হংসেশ্বরী মন্দিরের সামনে ভাড়া নেওয়ার সময় কর্মকার জানান, সকাল ৯.৩০ নাগাদ তিনি রিকশা নিয়ে বেড়িয়েছেন, সারা দিন কোনো ভাড়া হয়নি, খাওয়াও হয়নি। প্রতিবেদকই তার প্রথম যাত্রী। এবার তিনি খেতে যাবেন।
হংসেশ্বরীর ঝিলের পাশের সিমেন্টের রাস্তা ধরে যেতে যেতে দেখা হল এক দল অবাঙালি তরুণের সাথে। কলবাজার কী ভাবে যাওয়া যায় জিজ্ঞাসা করায় তারা ঐ দিকে না যাওয়ার পরামর্শ দেয়। কারণ হিসাবে জানায়, “এখনো ঝামেলা চলছে, পুলিশ ঘিরে রেখে দিয়েছে”।
এই তরুণদের দাবি, তাদের সামনেই স্বাধীনতা দিবসে নাকি মারামারি হয়েছে, প্রথমে স্কুলের ছাত্ররা মারামারি করেছে, তার পর ঐদিকে, অর্থাৎ কলবাজারে, মারামারি শুরু হয়। বুধবারও নাকি বোমা পড়েছে, গুলি চলেছে।
“দাদা, হিন্দুদের হয়ে ভাল করে লিখুন, খালি আমাদের দোষ হয়ে যায়”
এই তরুণরা কেউই নিজেদের পরিচয় দিতে রাজি হননি। তবে তারা জানিয়েছেন যে, তারা স্থানীয়, প্রত্যেকে গ্যাঞ্জেস স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র, বর্তমানে বিধান চন্দ্র কলেজে পড়েন। তারা ইস্ট পোস্ট বাংলাকে জানালেন, মঙ্গলবার সকাল ৯টা থেকে ৯.৩০ নাগাদ এই হংসেশ্বরী মন্দিরের আশেপাশেই ঝামেলা শুরু হয়। এই ঝামেলা ক্রমে গিয়ে শীতলা মন্দিরে পৌঁছায়, যেখানে নাকি স্থানীয় তামিলরা পুজো করছিলেন, সেখানে পাথর মারামারি এবং রাতে বোমাবাজি হয়।
এই ছাত্রদের কাল ঠিক কী দেখেছে জিজ্ঞাসা করলে তারা বলেন, “আমরা শুধু ঝামেলা হতে দেখেছি, আমরা ঝামেলা থামিয়ে বাড়ি চলে গেছি”। কেন ঝামেলা হয়েছে জিজ্ঞাসা করা হলে জানানো হয় যে তারা নির্দিষ্ট ভাবে বলতে পারবে না কেন ঝামেলা হয়েছে।
বর্তমান কোনো স্কুল ছাত্রকে তারা চেনেন না বলে দাবি করে এই তরুণেরা। এদেরই একজন প্রতিবেদককে বলেন, “দাদা, হিন্দুদের হয়ে ভাল করে লিখুন, খালি আমাদের দোষ হয়ে যায়”। এই দলের কয়েকজনের আরো দাবি, স্বাধীনতা দিবসে লোহার পাইপে জাতীয় পতাকা লাগিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্কুল ছাত্ররা নাকি ঘুরছিল, এবং ওই পাইপ দিয়েই তারা নাকি হামলা চালিয়েছে। যদিও লোহার পাইপের আঘাতে আহত একজনেরও নাম ঠিকানা দিতে পারেনি তারা।
রাস্তা ধরে বাঁশবেড়িয়ায় সাম্প্রদায়িক হিংসার উৎসস্থল বলে সন্দেহ করা গ্যাঞ্জেস উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ঠিক কিছুটা আগে প্রতিবেদককে আটকালেন কয়েকজন যুবক। পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন, তার পর সামনে এগোতে সাবধান করলেন।
তাদের মধ্যে গঙ্গু মল্লিক (৩০) পৌরসভার কর্মী। মল্লিক ইস্ট পোস্ট বাংলাকে বলেন, “গতকাল স্কুল থেকে একটা ছেলে জাতীয় পতাকা লাগিয়ে বেড়িয়েছিল, কেউ তার হাত থেকে পতাকা কেড়ে নেয়, এই নিয়ে মারামারি শুরু হয়”। যদিও কে সেই ছাত্র বা কারা পতাকা কাড়লো তাদের ধর্ম জানলেও নাম বা ঠিকানা জানেন না বলে দাবি করেছেন মল্লিক।
ফাঁকা রাস্তা দিয়ে কিছু র্যাফ কর্মীকে স্কুলের গেট দিয়ে ঢুকতে দেখা গেল। তখন বাজে ৪.১০। রাস্তা ধরে এগিয়ে ধুলুনিয়া মোড়ে কল্যাণী এক্সপ্রেস ওয়েতে উঠে দেখা গেল, রাস্তা বেশ ফাঁকা ফাঁকা হলেও কিছু টোটো বা দূর থেকে আসা যানবাহন চলছে। পুলিশ বা র্যাফ নেই বললেই চলে, ব্রিজ নির্মাণ শ্রমিকরা কাজ করে চলেছেন। স্টেশন বা হংসেশ্বরীর কাছের মানুষদের যা ধারণা, তখন পরিস্থিতি একদমই সেরকম নয়।
রাস্তায় কয়েকটি টোটো চললেও যাত্রীদের তারা স্পষ্ট বলেদিচ্ছেন নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে তারা আজ যাবেন না। এই টোটো চালকদের মধ্যে দুই সম্প্রাদায়ের মানুষই আছেন, যারা প্রতিদিনের মত যাত্রী ভাগ করে নিচ্ছেন। নাম জানাতে অনিচ্ছুক বছর ৫০ এর এক টোটো চালক বললেন, “ঝামেলা কী নিয়ে জানেন? আপনার বাড়ির মেয়ে যদি মুখে ওড়না দিয়ে বা ঘোমটা দিয়ে বের হয়, তারপর যদি অন্য কেউ এসে জোর করে মুখ দেখতে চায় তবে কী হবে? আগে কখনো এইসব হয়নি।” এই টোটো চালকের মতে পুলিশ ফাঁড়ির পেছনের রাস্তায় হিজাব খুলিয়ে মুখ দেখতে চাওয়া নিয়েই নাকি ঝামেলার সূত্রপাত।
“আমরা বাঙালিরা বন্দেমাতরম বা সুভাস বোস বা রবীন্দ্রনাথের নামে স্লোগান দিই, কিন্তু ওদের তো এরকম ব্যাপার নয়। অবাঙালি হিন্দু ছাত্ররা ‘জয় শ্রীরাম’ বলে চেঁচিয়েছে। অবাঙালি মুসলিম ছাত্রদের চাপ দিয়েছে ‘জয় শ্রীরাম’ বলার জন্য।”
হুগলি জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক সুব্রত চ্যাটার্জি, যিনি রাজা চ্যাটার্জি নামেই পরিচিত, ইস্ট পোস্ট বাংলাকে বলেন, “কিছুদিন আগে থেকেই হিজাবকে কেন্দ্র করে গ্যাঞ্জেস স্কুলে গন্ডগোল হয়েছিল। সেটা একেবারেই ছোটো ছোটো বাচ্চাদের মধ্যেকার ঝামেলা ছিল। সেই ঝামেলা মিটেও গেছিল, কিন্তু গতকালের ঘটনার সূত্রপাত স্বাধীনতা দিবসের পতাকা উত্তোলনকে কেন্দ্র করে। আমরা বাঙালিরা বন্দেমাতরম বা সুভাস বোস বা রবীন্দ্রনাথের নামে স্লোগান দিই, কিন্তু ওদের তো এরকম ব্যাপার নয়। অবাঙালি হিন্দু ছাত্ররা ‘জয় শ্রীরাম’ বলে চেঁচিয়েছে। অবাঙালি মুসলিম ছাত্রদের চাপ দিয়েছে ‘জয় শ্রীরাম’ বলার জন্য। স্বাভাবিক ভাবেই মুসলিম ছাত্ররা রাজি হয়নি, এই নিয়ে ঠেলা-ঠেলি আর গুঁতোগুঁতি। সেটা নিয়ে, স্টুডেন্টদের মারামারিকে কেন্দ্র করে বাইরের পরিস্থিতি গরম হয়ে গেল”।
চ্যাটার্জি আরও বলেন, “শুনতে পাচ্ছি, হেডমাস্টার মশাইয়ের নাকি একপাক্ষিক আচরণ রয়েছে। আমরা পরে এটা পর্যালোচনা করে দেখবো হেডমাস্টারের উস্কানিমূলক ভূমিকা আছে কিনা? পুলিশ খুবই সদর্থক ভূমিকা নিয়েছে। ছাত্রদের মারামারিতে দুই সম্প্রদায়ের মানুষ জড়িয়ে পরে জুটমিল কোয়ার্টারে ইট মারামারি হয়। ইটের আঘাতে টালির বাড়ি কিছু বিধ্বস্ত হয়।”।
তিনি জানান যে বিশেষ করে ১৯ নং এবং ১০ নং ওয়ার্ডে ঝামেলা হয়েছে। যদিও ১১, ৯ বা ২০ নং ওয়ার্ডেও প্রভাব পড়েছে। তৃণমূল নেতা বলেন বাকি ওয়ার্ড গুলো, যেখানে হিন্দু হোক বা মুসলিম, বাঙালিরা থাকে সেখানে কোনো ঝামেলা হয়নি, এটা গর্বের সাথেই বলছি। আমাদের পাশেই দেখবেন গাজি দরগা মসজিদ আছে, এখানে অনেক মুসলিম আছে, এখানে কোনো ঝামেলা নেই”।
স্বাধীনতা দিবসে ইট মারামারি পর নাকি পরিস্থিতি শান্ত হয়ে যায়। কিন্তু ১৬ই অগাস্ট সকালে নাকি আবার নতুন করে ঝামেলা শুরু হয়। দুপুরে বোমা এবং গুলির আওয়াজও শুনেছেন বলে দাবি তৃণমূল নেতা চ্যাটার্জির। এছাড়াও তিনি বাঁশবেড়িয়ায় সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনায় আঙুল তোলেন বিজেপি নেতা বুটু পালের দিকে।
কালীতলায়, রাস্তার ধারে ওষুধের দোকেনে বসে ছিলেন হুগলি জেলা বিজেপির সহসভাপতি জয়রাজ পাল ওরফে বুটু পাল। প্রথমে তাঁর নাম নিয়ে খোঁজ করায় পরিচয় দিতে কিছুটা ইতস্তত করলেও, তারপর কথা বলতে রাজি হলেন। ইস্ট পোস্ট বাংলাকে বিজেপি নেতা পাল বলেন, “আমরা স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে চুঁচুড়াতে ছিলাম, ওখানে আমাদের সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায় ছিলেন, রাজ্য সভাপতি সুকান্ত দাও (মজুমদার) ছিলেন, সেখানে আমরা খবর পেলাম জাতীয় পতাকা কোনো এক সম্প্রদায়ের লোক ছিঁড়ে ফেলে দেয়। শুধু তাই নয়, স্কুল থেলে বেরনো বাচ্চা মেয়েদের হাত থেকে জাতীয় পতাকা কেড়ে ছিঁড়ে ড্রেনে ফেলে দেওয়া হয়, কেউ কেউ বলেন তার উপর নাকি পেচ্ছাপও করে দেওয়া হয়”।
পালের দাবি, ঘটনার দিন তিনি এলাকায় বারবার ঢুকতে চাইলেও পুলিশ নাকি তাঁকে বারবার আটকে দিয়েছে। ফলত তিনি এলাকায় ঢুকতেই পারেননি। তার আরো দাবি যাদের মাথা ফেটে গেছে, তাদের হসপিটালে ভর্তি করা যাচ্ছে না।
যদিও কোন ছাত্ররা জাতীয় পতাকা ছিঁড়েছে, বা যাদের মাথা ফেটেছে, তাদের নাম ঠিকানা কিছুই দিতে পারেননি বিজেপি নেতা, তার দাবি ঐ এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগ নেই, ১৪৪ ধারা জারি, কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না, তাই তাঁর কাছে কোনো তথ্য নেই। পাল আরো বলেছেন, “দলের কার্যকর্তারা ফোনে কথা বলতে ভয় পাচ্ছে। তারা হোয়াটস্যাপ-এ যোগাযোগ করছে”।
প্রসঙ্গত প্রতিবেদক দেখেছে যে, বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ফোন পরিষেবা চালু থাকলেও, ইন্টারনেট পরিষেবা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ ছিলো।
গ্যাঞ্জেস জুটমিলের গেটে পৌঁছে জানা গেল যে সংঘর্ষের জন্য মিল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দেখা গেল গোটা এলাকা নিস্তব্ধ। রাস্তার ধারে বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ টহল চলছে।
গ্যাঞ্জেস জুট মিলের শ্রমিক মহম্মদ আলি রাজা (৩০) জানান যে স্বাধীনতা দিবসে ধুলানিয়ার দিক থেকে এক দল স্কুল ছাত্র মিল গেটের কাছে এসে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিয়ে, নিউ লাইন বস্তিতে ঢুকতে গিয়ে বাঁধা পায়। তারপর, তারা পিছন দিকে যেখানে তামিলদের পুজো হচ্ছিলো, সেখানে গিয়ে নির্মাণ কাজের জন্য রাখা পাথর মুসলিম মহল্লার দিকে ছুড়তে থাকে। এর পর দু-পক্ষের পাথর ছোড়াছুড়ি শুরু হয়ে যায়।
“কোনো ছাত্র জাতীয় পতাকায় লাথি মারেনি, মারতে পারে না। এই ছাত্ররা বুকে জাতীয় পতাকার ব্যাচ লাগিয়ে স্কুলে যায়। কোনো মুসলিম ছাত্র যদি জাতীয় পতাকা ছেঁড়ে, তাহলে আমাদের প্রমাণ দিক, আমরা তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেব। মিথ্যা কথা রটিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা হচ্ছে। বাচ্চাদের ক্ষতিকারক জিনিস শেখানো হচ্ছে, তাতে ওদের জীবনই নষ্ট হবে। সমাজেরও ক্ষতি”
১৯ ওয়ার্ডের প্রাক্তন কাউন্সিলর ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) [সিপিআই (এম)] নেতা জুলফিকার আলী থাকেন গ্যাঞ্জেস জুট মিলের প্রধান ফাটকের উল্টো দিকে, নিউ লাইন বস্তিতে। আলী নিজেও শ্রমিক। তাঁর বাড়ি গিয়ে দেখা যায় তিনি বৈঠকে ব্যস্ত। তাঁর জন্যে বাইরে অপেক্ষা করার সময় প্রতিবেদককে দেখে বার বার শ্রমিকরা কথা বলার জন্য জটলা পাকানোয় রাস্তার অন্যদিক থেকে লাঠি উঁচিয়ে পুলিশ কর্মীরা ভিড় ফাঁকা করার চেষ্টা চালান।
কী নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে জিজ্ঞাসা করা হলে সিপিআই (এম) নেতা আলী বলেন, “ছাত্রদের ঝামেলা, তারপর যে যার মত গল্প সাজিয়ে নিচ্ছে। আমরা মনে করি ওরা ছাত্র। স্কুলে কেউ হিন্দু-মুসলিম হতে যায়নি। ছাত্রদের ঝামেলা হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের ঝামেলা হয়ে গেছে”।
“পুলিশের ভূমিকা ভাল, কিন্তু এখানে জনসংখ্যা অনেক, বিভিন্ন জায়গায় ঝামেলা হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আরও একটু ফোর্স বাড়াতে হবে”, আলী আরও বলেন।
আঞ্চলিক থানার অফিসার ইনচার্জ নিরুপম মন্ডল বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রতিবেদককে জানিয়েছেন যে পুলিশ এখনো পর্যন্ত প্রায় ৩০ জনকে উপদ্রবের জন্যে আটক করেছে। মন্ডল জানান যে পুলিশী প্রহরা ও টহলের ফলে অঞ্চলে আইন শৃঙ্খলা ব্যবস্থা এখন স্থিতিশীল ও পরিস্থিতি পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তিনি জানান উপদ্রব পুরোপুরি দমন করা গেছে।
প্রসঙ্গত প্রতিবেদকের কাছে দুই সম্প্রদায়ের মানুষই দাবি করেছে যে “পুলিশ শুধু আমাদের ছেলে গুলোকে তুলে নিয়ে গেছে”।
হিজাব নিয়ে সংঘাত থেকেই কি বাঁশবেড়িয়ায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত?
এই অঞ্চলেই ছাত্রীদের হিজাব পরা নিয়ে সমস্যা তৈরি হলে ২২/২৩ জুলাই সেই নিয়ে বেসরকারি স্কুলে বৈঠক হয়। এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আলী। সিপিআই (এম) নেতার বক্তব্য তাঁর প্রস্তাব সমস্ত পক্ষ মেনে নেয়। তিনি বলেন “প্রশাসন এবং স্কুল অথরিটি ঠিক ভাবে মোকাবিলা করছে না। আমার বক্তব্য ছিল, যে যার মন্দির-মসজিদে ধর্মপালন করবে, কিন্তু স্কুল সবার জন্য সমান। স্কুলের গেট অবধি হিজাব পরলেও, স্কুলে স্কুল পোষাকেই থাকতে হবে,এই প্রস্তাব মেনে নেয় সব পক্ষ”।
বাঁশবেড়িয়ায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে তৃণমূল নেতা চ্যাটার্জির মতই আলীও প্রশ্ন তুলেছেন স্কুল প্রশাসনের দিকে। আলীর দাবি, স্কুল প্রশাসন মিটিং এর সিদ্ধান্ত লাগু করতে কড়া হচ্ছে না।
ছাত্ররা কি জাতীয় পতাকা ছিঁড়েছিল?
সংখ্যালঘু ছাত্ররা যে জাতীয় পতাকা ছিঁড়েছিল, এই অভিযোগ মানতে রাজি নন সিপিআই (এম) নেতা আলী। তিনি বলেন, “সুকান্ত মজুমদার ওখান থেকে এটা সেটা বলে দিল। কী প্রমাণ আছে? কোনো ছাত্র জাতীয় পতাকায় লাথি মারেনি, মারতে পারে না। এই ছাত্ররা বুকে জাতীয় পতাকার ব্যাচ লাগিয়ে স্কুলে যায়। কোনো মুসলিম ছাত্র যদি জাতীয় পতাকা ছেঁড়ে, তাহলে আমাদের প্রমাণ দিক, আমরা তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেব। মিথ্যা কথা রটিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা হচ্ছে। বাচ্চাদের ক্ষতিকারক জিনিস শেখানো হচ্ছে, তাতে ওদের জীবনই নষ্ট হবে। সমাজেরও ক্ষতি”।
বাঁশবেড়িয়ায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে অভিযোগের আঙ্গুল যে স্কুলের দিকে, সেখানকার শিক্ষক বিশাল তিওয়ারির দাবি, “স্কুলে কোনো ঝামেলা হয়নি। আমাদের কাছে সিসিটিভি ফুটেজ আছে, স্কুলের নাম কোথা থেকে জড়ালো জানিনা”।
কেন বাঁশবেড়িয়ায় সাম্প্রদায়িক হিংসা হল?
“যাদের করোনায় দেখতে পাওয়া যায়নি, দাঙ্গায় তারা আসবে। এইভাবে বিদ্বেষের মনোভাব বাঙালি ভোটারদের মধ্যে কিছুটাও ঢুকলে বিজেপির কিছুটা স্বস্তি থাকবে”।
তৃণমূল নেতা চ্যাটার্জি বলেন, “আমার এখানেই জন্ম, এখানেই বড় হয়েছি। ২০১৪ সালের পর ধীরে ধীরে এই জায়গায় পৌঁছায়। আমার কাছে বিজেপির অভ্যন্তরের খবর আছে যে হুগলি লোকসভা এবার ওদের হাতছাড়া হতে চলেছে। আমি গ্যারেন্টি দিয়ে বলছি লকেট চট্টোপাধ্যায় যদি আবার এখানে দাঁড়ান তবে দুই থেকে তিন লাখ ভোটে হারবেন। হাতে কোনো ইস্যু না থাকলে, একটা নন ইস্যুকে ইস্যু বানিয়ে, আবার আসবে আবার মুখ দেখাবে। যাদের করোনায় দেখতে পাওয়া যায়নি, দাঙ্গায় তারা আসবে। এইভাবে বিদ্বেষের মনোভাব বাঙালি ভোটারদের মধ্যে কিছুটাও ঢুকলে বিজেপির কিছুটা স্বস্তি থাকবে”।
বাঁশবেড়িয়ায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে সিপিআই (এম) নেতা আলী বলেন, “ছাত্রদের মধ্যে ঝামেলা ছিল, তারপর সিনিয়ররা জড়িয়ে গেল, আগে এসব ছিলনা, বিগত কয়েক বছর ধরে এইসব ঝামেলা চলছে। আগে সব ধর্মীয় উৎসব সবাই মিলেমিশেই করতো, কিন্তু এখন কোনো উৎসব আসলেই দুশ্চিন্তা হয়ে যাচ্ছে। দুই সম্প্রদায়ের মানুষই কম লোক ঝামেলা করছে, কিন্তু এর জন্যে তো দুই সম্প্রদায়েরই বেশীরভাগ লোক ভুগছে”।
“কিছু মানুষ পাকিস্তানের মদদে চর হিসাবে এখানে কাজ করছে”।
বিজেপি নেতা পাল বলেন “জাতীয় পতাকা ছিঁড়েছে কোনো এক সম্প্রদায়ের মানুষ, সেই নিয়ে গোটা সম্প্রদায়কেই দোষারোপ করা হচ্ছে। আজ মাননীয়া এই সম্প্রদায়কে তোল্লাই দিচ্ছে, কিন্তু সম্প্রদায়ের তো সব মানুষ খারাপ নয়। কিছু মানুষ পাকিস্তানের মদদে চর হিসাবে এখানে কাজ করছে”।
পাকিস্তান বাঁশবেড়িয়ায় চর পাঠিয়ে কি উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে চাইছে জিজ্ঞাসা করা হলে বিজেপি নেতার জবাব দেন, “দাঙ্গা করিয়ে মোদীজির (প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী) নামে বদনাম করানোটাই উদ্দেশ্য”।
এ যাবৎ পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা মূলত গরিব অবাঙালি অঞ্চলে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যেই হয়ে এসেছে। কিন্তু বাঁশবেড়িয়ায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার খবর বৃহৎ মূলস্রোতের সংবাদ মাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ না করলেও, স্কুল পড়ুয়াদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের, পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাসের যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, সেটা কিন্তু নতুন হলেও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আগামী দিনে আরও স্কুলে সাম্প্রদায়িক হিংসা আর বিদ্বেষের ঘটনা ঘটে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।