Close

“প্রগতিশীল” বাঙালি হিন্দু মননে ইসলাম বিদ্বেষ প্রবেশ করে কী ভাবে?

"প্রগতিশীল" বলে পরিচিত বাঙালি হিন্দু মননে কী ভাবে ইসলাম বিদ্বেষ প্রবেশ করে? কোন কোন প্রতিষ্ঠান এর জন্যে দায়ী?

"প্রগতিশীল" বাঙালি হিন্দু মননে ইসলাম বিদ্বেষের বীজ রোপন করে কে?

ছবি সত্ত্ব: ইস্ট পোস্ট বাংলা ও ক্যানভা

দীর্ঘদিন ধরে মুসলিমরা পশ্চিমবঙ্গে তথা ভারতে ইসলাম বিদ্বেষের শিকার হচ্ছেন, এটা জানা কথা। কিন্তু হিন্দু মননে কী ভাবে ইসলাম বিদ্বেষ প্রবেশ করে, আর কোন বয়সে করে? পশ্চিমবঙ্গের মতন তথাকথিত প্রগতিশীল রাজ্যেও সেটা কী ভাবে হয়ে এসেছে এতকাল?

গত শতকের নয়ের দশকের শুরুর দিকে যখন অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভাঙতে উদ্ধত হয়েছিল মাথায় গেরুয়া ফেট্টি বাঁধা হাজার হাজার যুবরা, তখনো কলকাতায় ভোর হলেই আকাশ সদ্য আঁচ দেওয়া কয়লার উনুনের ধোঁয়ায় ভরে যেত। সেই কার্বন মনোঅক্সাইড মিশ্রিত বাতাস চরম বিষাক্ত হলেও, তখনো নাকি কলকাতা শহরের, বা পশ্চিমবঙ্গের, বাতাসে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্প ছিল না। অন্তত তেমনি দাবি করেন অনেক পক্ক কেশ বামপন্থীরা।  

সত্যিই কলকাতার দূরত্ব কি অযোধ্যার থেকে অনেক দূরে ছিল? আজও কি আছে? 

প্রশ্নটা ওঠা স্বাভাবিক, কারণ বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় প্রধান বিরোধী দল। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ২.২৯ কোটি ভোট, যা মোট ভোটের ৩৮.১৫%, পেয়ে ৭৭টি আসন জিতেছিল। একই ভোটে শূন্য হয়েছে তিন দশকের উপর নিরবচ্ছিন্ন ভাবে শাসন করা বামেরা।  

অভিযোগ করা হয় যে মোদী ক্ষমতায় আসার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গেও ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মতন সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ হয়েছে, বিজেপির পিতৃপ্রতীম সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) শাখা সংগঠন বৃদ্ধি পেয়েছে আর তার সাথেই বাৎসরিক উৎসবের মতন মুসলিম-বিরোধী হিংসার ঘটনাও পশ্চিমবঙ্গে একটি স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে। কিন্তু কী ভাবে? 

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের তিন দশকের উপর নিরবচ্ছিন্ন শাসনের পরেও যে ভাবে এই রাজ্যে, এমনকি তুলনামূলক ভাবে প্রগতিশীল হিসাবে পরিচিত কলকাতা শহরেও, চোখের সামনেই ইসলাম বিদ্বেষ বৃদ্ধি পাচ্ছে, খুব সহজে সাম্প্রদায়িক হিংসায় ইন্ধন দেওয়া যাচ্ছে, সেগুলোর পিছনেও কি মোদীর উত্থানই একমাত্র কারণ? 

অনেক বামপন্থীরা এর জন্যে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিযোগিতা মূলক সাম্প্রদায়িকতাকে দায়ী করেন। সেই অভিযোগের সারবত্তা থাকলেও, প্রশ্ন ওঠে যে যখন রাজ্যটির পত্তনই হয়েছিল সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে, সেখানে স্বাভাবিক ভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মধ্যে যে সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ থাকবে, অনেক সময় প্রকাশ্যে না থাকলেও, এটা কি অস্বাভাবিক? 

কী ভাবে মোদীর উত্থানের আগে, রাজ্যে বিজেপি-আরএসএস-র প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পাওয়ার আগে, পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের মধ্যে মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষ কে ছড়ানো হত? কী রকম প্রকোপ ছিল পশ্চিমবঙ্গে বা সামগ্রিক ভাবে বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে ইসলাম বিদ্বেষের? 

বাঙালি হিন্দু মননে ইসলাম বিদ্বেষ কী ভাবে ঢোকানো হয়?

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি কলেজ (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়), হেয়ার স্কুল (সাবেক হিন্দু স্কুল), বুদ্ধিজীবীদের প্রাণের কফি হাউস থেকে শুরু করে প্রেমিক আর সাঁতারুদের প্রিয় কলেজ স্কোয়ার, সবই কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলে। বলা চলে কলকাতার প্রগতিশীলতার আঁতুরঘর। আবার নানা বিপ্লব-বিদ্রোহেরও। যদিও সেই কলেজ স্ট্রিট অঞ্চল কে ঘিরে রয়েছে অনেক মুসলিম অঞ্চল, তবুও নয়ের দশকে যখন সেখানে ইস্কুলে পড়তেন অভিজিত মজুমদার, তখন তাঁর কোনো মুসলিম সহপাঠী ছিল না। তবে তার মানে এই নয় যে মজুমদার মুসলিমদের ব্যাপারে কিছুই জানতেন না।

‘মুসলমান বাচ্চারা ছোটবেলা থেকেই পশু জবাই দেখে, মহরমে রক্ত দেখে। ফলে তারা বড় হতে হতে ওদের মধ্যে দয়ামায়া তুলনামূলক ভাবে কম থাকে’

যেটা তিনি শুনেছিলেন সেটা মোটেই সদর্থক ছিল না। 

“সরাসরি ‘মুসলিমরা খারাপ’ এটা কিন্তু আগে সেভাবে শুনিনি। যেটা শুনেছি সেটা বহুবিবাহ আর তিন তালাক নিয়ে,” মজুমদার বললেন। এ ছাড়া তখন সচরাচর তাঁদের কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলের বাড়িতে বা মধ্যবিত্ত পরিমণ্ডলে মুসলিম নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা তিনি শোনেননি। তবে কিছুটা অপেক্ষা করে তিনি মনে করতে পারলেন, “পরিবারের ভেতরের আলোচনায় শুনেছি –– ‘মুসলমান বাচ্চারা ছোটবেলা থেকেই পশু জবাই দেখে, মহরমে রক্ত দেখে। ফলে তারা বড় হতে হতে ওদের মধ্যে দয়ামায়া তুলনামূলক ভাবে কম থাকে’”। 

সময়টা সেই নয়ের দশক। জয় শ্রী রাম স্লোগান তখন উত্তর ভারত কাঁপাচ্ছে। পরবর্তীতে বোম্বে আইআইটির অধ্যাপক হওয়া মজুমদার তখন শৈশবে। তখনই তিনি জানলেন যে মুসলিম পুরুষেরা নাকি মুসলিম নারীদের উপর ভীষণ অত্যাচার করে। যদিও তিনি কোনো মুসলিম দম্পতি কে তখন স্বচক্ষে দেখেননি, কিন্তু তিনি শোনেন যে মুসলিম মেয়েদের নাকি কোনো স্বাধীনতা নেই, তাই কোনো ভাবেই বাড়ির মেয়েকে মুসলিম ছেলের সাথে বিয়ে করতে দেওয়া যাবে না।

‘খবরদার, মুসলিম ছেলের সাথে প্রেম করিস না, বিয়ে করলে কিন্তু গলা কেটে ফেলে রেখে দেবে’

যা বর্তমানে ‘লাভ জেহাদের’ নামে বাজার গরম করছে, গত শতকে বাম-শাসনাধীন পশ্চিমবঙ্গের রাজধানীতেও সেই তত্ত্বেরই চর্চা হত। মুসলিম মেয়েদের স্বাধীনতা ও পুরুষতন্ত্রের শিকার হওয়া নিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে যে ধারণা গুলো বিরাজ করে চলেছে যুগ যুগ ধরে, তারই আঁচ পেলেন সাংবাদিকতার ছাত্রী ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী তাঁর বয়ঃসন্ধি কালে এসে। 

“যখন আমরা বয়ঃসন্ধি কালে এলাম, যখন একটা প্রেম-প্রেম ভাব, যে আমরা প্রেম করবো, হয়তো কোনো ছেলের আমাকে পছন্দ হচ্ছে, তখনও যেন একটা সতর্ক বাণী ছিল যে ‘খবরদার, মুসলিম ছেলের সাথে প্রেম করিস না, বিয়ে করলে কিন্তু গলা কেটে ফেলে রেখে দেবে’,” চক্রবর্তী জানান।  

চক্রবর্তীর মতনই এক ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে সুরভি ভট্টাচার্য (সিংহ) বড় হয়েছেন অবিভক্ত মধ্য প্রদেশের ভিলাই শহরে (বর্তমানে ছত্তিসগড়ে), যেখানে তাঁর বাবা কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা সেল এর ইস্পাত প্রকল্পে কাজ করতেন।  

ছোটবেলার থেকেই একটি প্রগতিশীল পরিমণ্ডলে বড় হওয়া ভট্টাচার্য দেখেছেন তাঁর বাবা কে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে ভিলাইয়ে তাঁদের কোয়ার্টারে চাঁদা চাইতে আসা করসেবকদের সাথে তর্ক করতে। কিন্তু তবুও ভট্টাচার্য তাঁর আশেপাশে কোনো মুসলিম পরিবার কে দেখেননি, যদিও সেল এর কোয়ার্টার বন্টনের ধর্মের ভিত্তিতে করা হয় না।  

এর কারণ ছিল অবশ্যই মুসলিমদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা। যার ফলে তারা কোনো দিন সাবর্ণ হিন্দুদের সমকক্ষ হতে পারেননি।  

আর এই আর্থ-সামাজিক ভাবে পিছিয়ে পড়ার কারণেই মুসলিমদের বাস করতে বাধ্য করা হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্যে নির্দিষ্ট করা অঞ্চলে, যেখানে তারা বেশির ভাগ সময় জনকল্যাণমূলক কর্মসূচিগুলোর আওতা থেকে বঞ্চিত হন। শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য, সব ব্যাপারেই তারা থাকেন পিছিয়ে। আর এই পিছিয়ে থাকা সম্প্রদায় কে উপলক্ষ করে গড়ে ওঠে নানা অপপ্রচার, যা সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মধ্যে গ্রহণযোগ্য করে তোলার ভিত্তি হিসাবে কাজ করে।  

বর্তমানে সাংবাদিকতা ও কর্পোরেট কমিউনিকেশনে পারদর্শী ভট্টাচার্যও মুসলিমদের সম্পর্কে প্রথম বিদ্বেষমূলক প্রচার শুনলেন তাঁর কলেজ জীবনে, নয়ের দশকের গোড়ার দিকে। তাঁর সহপাঠিনীদের বলতে শুনলেন যে তাঁরা যে কোনো ছেলের সাথে প্রেম করতে পারে কিন্তু মুসলিমদের সাথে না, কারণ ওরা খুবই হিংস্র এবং তাঁদের পরিবার কোনো মুসলিমের সাথে সম্পর্ক মানবে না।  

এর এক যুগ পরে, পেশাগত জীবনে এসে জীবনে প্রথম বার মুসলিমদের সংস্পর্শে আসেন ভট্টাচার্য।  

তবে ভিলাইতে যা হয় তা কলকাতায় হয় না বা পশ্চিমবঙ্গে হয় না বলেই দাবি করতেন বামফ্রন্টের নেতৃত্ব থেকে নিচুতলার কর্মীরা। কিন্তু সত্যিই কি তাই?? 

বর্তমানে বেঙ্গালুরুতে আইনের ছাত্রী দেবযানী মুখোপাধ্যায় বড় হয়েছেন কলকাতার এক বনেদি ব্রাহ্মণ পরিবারে। তাঁর জীবনে প্রথম দেখা মুসলিম হল তাঁরই বাবার কোনো এক সহকর্মী যিনি তাঁদের বাড়ি এসেছিলেন। খুব ছোট মুখোপাধ্যায় তখন মুসলিম খায় না মাথায় দেয় জানতেন না, কিন্তু যেটা তিনি তাঁর বাড়িতে দেখলেন সেটা তাঁকে আশ্চর্য করে দিল।  

“বাবার এই সহকর্মীর জন্যে আমার ঠাকুরমা চা আর জলখাবার বানিয়ে দিলেন। তাঁকে পরিবেশনও করা হলো। কিন্তু তিনি যখন চলে গেলেন তখন ঠাকুরমা আমাকে বললেন ওই সব এঁটো বাসন তুলে রান্নাঘরের কলের নিচে রাখতে। বাবার ওই সহকর্মীটি মুসলিম ছিলেন বলেই ঠাকুরমা তাঁর এঁটো বাসন ছুঁতে অস্বীকার করেন। আমাকে সেই শৈশবেও এই ঘটনাটি আশ্চর্য করে কারণ আমাদের বাড়িতে আসা অন্য অতিথিদের থেকে ইনার সাথে অন্যরকম ব্যবহার করলেন ঠাকুরমা,” বললেন মুখোপাধ্যায়।

আমি যেন আভিজাত্য বজায় রাখতে শিখি এবং যারা আমাদের ধর্মের নিরিখে নিচে তাদের সাথে কোনো মেলামেশা না করি

তবে চক্রবর্তী বা ভট্টাচার্যরা যদিও বয়ঃসন্ধিকালে বা যৌবনে হয় পরিবারের কাছে বা সহপাঠিনীদের কাছে মুসলিমদের থেকে সাবধানে থাকার কথা শুনেছেন, মুখোপাধ্যায় কে এই কথা শুনতে হয় আরও আগে –– আট কি নয় বছর বয়সেই।  

“আমাদের অঞ্চলে একটি গরিব মুসলিম পরিবারের ছেলে রাস্তায় খেলা করতো। আমরা সমবয়স্ক ছিলাম। তাই আমিও ওর সাথে খেলতাম বাইরে বেরিয়ে। একদিন আমার ঠাকুরদার চোখে ব্যাপারটা পড়ে। উনি আমাকে ডেকে বকাবকি করেন এই বলে যে আমি যেন ওর সাথে না মিশি কারণ ওরা আমাদের থেকে আলাদা। আমি ব্যাপারটা বুঝিনি তাই তাঁর বোঝানো সত্ত্বেও আমি খেলা থামাইনি ওই বাচ্চাটার সাথে। তাই পরের বার আমাকে ভীষণ ভাবে বকা হয় এই বলে যে আমি যেন আভিজাত্য বজায় রাখতে শিখি এবং যারা আমাদের ধর্মের নিরিখে নিচে তাদের সাথে কোনো মেলামেশা না করি,” মুখোপাধ্যায় জানালেন।  

যদিও প্রগতিশীলতার মুখোশধারী বলে সমালোচিত কলকাতার অনেকের কাছেই এই ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন বলে মনে হবে, কিন্তু ঘটনা হলো যে দিল্লী, বেঙ্গালুরু বা মুম্বাই শহরের মতন কলকাতাতেও শহরের মানচিত্রে যা অভিজাত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত অঞ্চল হিসাবে চিহ্নিত, সেখানে দূরবীন দিয়েও কোনো মুসলিমকে দেখতে পাওয়া যায় না।

বৈষম্য মূলক বসবাস

মুসলিমদের জন্যে নির্দিষ্ট করে দেওয়া ‘ঘেটো’ অঞ্চলের বাইরে কলকাতাতেও মুসলিম, তাও আবার বাঙালি মুসলিম, খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। উচ্চ ও মধ্যবিত্ত অঞ্চলে বাড়ি ভাড়া পাওয়া তো দূরের কথা টাকা দিয়ে বাড়ি কিনতেও পারেন না সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল অংশটি।  

ভারতের শহরাঞ্চলে জাতিগত ও সম্প্রদায়গত ভিত্তিতে যে বৈষম্য মূলক বসবাসের ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে এই বিষয়ে ২০১১ সালের জাতিগুলোর সামাজিক-অর্থনৈতিক সমীক্ষার (এসইসিসি) ফলাফল কে ভিত্তি করে করা একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমরা, যারা মোট জনসংখ্যার (২০১১ সালের আদমশুমারির হিসাবে) ১৪%, ও দলিত জাতির মানুষেরা, যারা জনসংখ্যার ১৭%, সমস্ত ধরণের সরকারি পরিষেবার থেকে বঞ্চিত হন।  

এই গবেষণা অনুসারে, দলিতদের তুলনায়, “মুসলিমরা গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরে তুলনামূলকভাবে বেশি বিচ্ছিন্ন”।

শহরাঞ্চলে বসবাসের ক্ষেত্রে মুসলিম ও দলিতদের সামাজিক বিচ্ছিন্নতা। সূত্র ও সত্ত্ব: ডেভেলপমেন্ট ডেটা ল্যাব

এই গবেষণায় আরও বলা হয়েছে যে ০% মুসলিম এলাকার তুলনায়, একই শহরের একটি ১০০% মুসলিম এলাকায় পাইপযুক্ত জলের পরিকাঠামো থাকার সম্ভাবনা ১০% কম। মুসলিমদের প্রায় ২৬% এমন এলাকায় বাস করে যেখানে ৮০% এর বেশি মুসলিম রয়েছে, তুলনায় ১৭% দলিতরা ৮০% দলিত অঞ্চলে বাস করে। 

একইভাবে, একটি এলাকার মুসলিম অংশ ৫০ শতাংশ বিন্দু বৃদ্ধি করা হলে একটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থাকার ২২% কম সম্ভাবনার সাথে যুক্ত। আর ৫০% এরও বেশি মুসলিম জনসংখ্যার এলাকাগুলি ভারতে বিশেষভাবে অনুন্নত।

শহরাঞ্চলে মুসলিম বসতিতে সরকারি মাধ্যমিক ইস্কুল থাকার সম্ভাবনা। সূত্র ও সত্ত্ব: ডেভেলপমেন্ট ডেটা ল্যাব

অধিকন্তু, ১০০% মুসলিম এলাকায় বসবাসকারী ১৭-১৮ বছর বয়সীদের একেবারে ০% মুসলিম এলাকার তুলনায় ২.১ বছরের কম শিক্ষা রয়েছে। 

বাম-দক্ষিণ নির্বিশেষে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো কিন্তু এই বৈষম্য মূলক বসবাস করার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোনো নির্দিষ্ট নীতি গ্রহণ করে না। আর বসবাসের ক্ষেত্রে এই বৈষম্য সামগ্রিক ভাবে বর্তমান ব্যবস্থায় সংখ্যালঘুদের আর্থ-সামাজিক বৈষম্যেরই একটি অংশ। আর এই বৈষম্য কে টিকিয়ে রাখে সব ধরণের প্রতিষ্ঠানই। অন্তত চক্রবর্তী তাই মনে করেন।

প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা

চক্রবর্তী মনে করেন যে তাঁর জীবনের প্রতিষ্ঠানগুলো নানা ভাবে, নানা স্তরে তাঁর এবং তাঁর মতন অনেকেরই মস্তিষ্কে ইসলাম বিদ্বেষের বীজ রোপন করেছে ও তাকে সযত্নে লালন পালন করেছে বছরের পর বছর।  

“এই যে ইসলাম বিদ্বেষ, এটা শুধুমাত্র গল্প নয়। একেবারে ছোটবেলার থেকে যে যে প্রতিষ্ঠানগুলোয় আমরা ঢুকি, সেটা প্রথমে বাড়ি, তারপর ইস্কুল, তারপর কলেজ, তারপর অফিস –– তো এই যাবতীয় জায়গাগুলোতে একটু-একটু করে, যেন রোজকার ওষুধের মতন করে গেলানো হয়। এবং এটা একদিন, একজন কেউ ইসলাম বিদ্বেষ ছড়ায় না, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষয়টা ঢুকে আছে,” জানান চক্রবর্তী। 

গত শতকের ছয়ের দশকে জন্ম অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী বিপুল রায়ের। রায় ছোটবেলার থেকে দেখেছেন বাড়িতে তাঁর ঠাকুরমার ধর্মীয় গোঁড়ামি। তবে তিনি শৈশবে কোনো মুসলিমকে তেমন চিনতেন না, বা তাঁর কোনো মুসলিম সহপাঠী বা বন্ধুও ছিল না, যদিও তাঁর বাবার বদলির চাকরির সূত্রে তিনি নানা জায়গা ঘোরার সুযোগ পান। পরবর্তীতে তিনি ‘নিয়াজি’ বলে তাঁর বাবার এক সহকর্মী কে চেনেন, যিনি তাঁর দেখা প্রথম মুসলিম।  

তবে রায়ের শৈশবেই তাঁকে ইসলাম নিয়ে আতঙ্কিত হতে হয়, যদিও তখনও দেশে বাড়িতে বাড়িতে টেলিভিশন হয়নি এবং সেখানে চোঙা ফুঁকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রচার করা হয়নি।  

“আমার মনে আছে আমার ঠাকুরমার এক ভাই আমাদের বাড়িতে আসতেন। শৈশবে তাঁকে কারুর সাথে মুসলিমদের খৎনা করার ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করতে শুনি। তিনি যে ভাবে বর্ণনা করেছিলেন তাতে আমার মনে হয়েছিল এটি একটি বড়ই নিষ্ঠুর ব্যাপার ও এই ঘটনা আমাকে আতঙ্কিত করে রেখেছিল বেশ কিছু দিন,” জানালেন রায়।  

ফলে ছোটবেলার থেকে একজন সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু যে ভাবে ইসলাম বিদ্বেষের শিকার হয়, এবং বৈষম্যমূলক বসবাসের ব্যবস্থার ফলে যেহেতু তারা দীর্ঘ দিন কোনো মুসলিমের সংস্পর্শে আসতে পারেন না, তাই এই ধারণাগুলো বদ্ধমূল হয় আর মূলস্রোতের সংবাদ মাধ্যমের ইসলাম বিদ্বেষী প্রচার, সরকারি দলের ইসলাম বিদ্বেষের উপর ভিত্তি করে ভোটে জেতা, প্রভৃতি সামাজিক বিভেদের ফাটলটাকে আরও চওড়া করে দেয়। 

আর এই ঘটনাটি কলকাতা সহ সারা পশ্চিমবঙ্গেও ঘটে চলেছে, এমনকি বাম আমলেও ঘটেছে। এর পিছনে বাম জমানায় বামফ্রন্টের মুখ্য শরিক ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) [সিপিআই (এম)] সহ অন্য শরিকদেরও দায় কম নয়।

বাম আমলের কথা

দীর্ঘ  তিন দশক শাসন কালে মুসলিম সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যেমন  বামফ্রন্ট সরকার ব্যর্থ হয়েছিল—যা সাচ্চার কমিটির রিপোর্টে প্রকাশ পায় ২০০৬ সালে—তেমনি তৃণমূল স্তর পর্যন্ত সাংস্কৃতিক কোনো আন্দোলন না হওয়ায়, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনগুলোকে শহুরে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেই আটকে রাখার ফলে ব্যাপক বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে সুপ্ত ইসলাম বিদ্বেষ কে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা যায়নি। বাম আমলে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি তার কারণ ছিল সরকারের এই বিষয়ে কড়া মনোভাব, জনগণের চেতনার মানের উন্নয়ন হওয়া নয়।  

তাঁর নিজের জীবনে প্রথমবার ইসলাম বিদ্বেষের সংস্পর্শে আসার ঘটনা বলতে গিয়ে একটি বৃহৎ সংবাদমাধ্যমের কপি এডিটর শুভদীপ গুপ্ত ফিরে গেলেন ১৯৮৯ সালে। তখন তিনি সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র।  

“আমাদের বাংলা শিক্ষক হিন্দু-মুসলিম সমস্যা এবং একটি গ্রামে ধরা কিছু সন্দেহভাজনদের উপর সংঘটিত নৃশংসতা সম্পর্কে কথা বলার সময় কিছু মন্তব্য করেছিলেন। তিনি কী বলছেন তা বুঝতে না পেরে তিনি এই মন্তব্য গুলি করেছিলেন এবং পরে দাবি করেছিলেন যে সেগুলি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল,” গুপ্ত জানান।  

গুপ্ত জানান যে সেই সময় বেশির ভাগ শিক্ষকই সিপিআই (এম)-প্রভাবাধীন অল-বেঙ্গল টিচার্স এসোসিয়েশন বা এবিটিএ-র সদস্য হওয়ায় এরকম ভাবে ক্লাসের মাঝে এক শিক্ষকের একটি উক্তি সত্যিই তাঁকে অবাক করেছিল। উদ্বাস্তু পরিবারের ছেলে গুপ্ত কলকাতার গাঙ্গুলি বাগানে বড় হয়েছিলেন এবং পড়াশুনা করেছিলেন সল্টলেকের একটি ইস্কুলে। তাঁরও কোনো মুসলিম সহপাঠী বা মুসলিম প্রতিবেশী স্বাভাবিক ভাবেই ছিল না।

“বামপন্থীদের মধ্যে ইসলাম বিদ্বেষ আরও প্রত্যক্ষ করা গেল ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার পরে। তখন অনেক বামপন্থীই মুসলিম-বিরোধী হিংসা কে সমর্থন করেছিলেন”

বাম আমলে এক শিক্ষকের মুখ ফস্কে বের হওয়া সাম্প্রদায়িক উক্তি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এরকম অনেক হত বলেই জানালেন সাংবাদিক অর্ক ভাদুড়ি, যাঁর জন্মই একটি বামপন্থী পরিবারে। নয়ের দশকের শেষের দিকের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করলেন ভাদুড়ি।  

“আমার কাকা একজন কট্টর বাম [সিপিআই (এম)] সমর্থক ছিলেন। তিনি বামপন্থী ইউনিয়নও করতেন। সেই সময়ে কার্গিল যুদ্ধ চলছে। তখনই কাকাকে বলতে শুনেছি যে পাকিস্তান যেহেতু মুসলিম দেশ তাই ওটিকে ‘গুঁড়িয়ে দেওয়া উচিত’। এ ছাড়াও ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচে পাকিস্তান হারলে বলতেন যে মুসলিমেরা (ভারতীয় মুসলিমেরা) নিশ্চয় খুব কষ্ট পেয়েছে। বামপন্থীদের মধ্যে ইসলাম বিদ্বেষ আরও প্রত্যক্ষ করা গেল ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার পরে। তখন অনেক বামপন্থীই মুসলিম-বিরোধী হিংসা কে সমর্থন করেছিলেন”, ভাদুড়ি জানান।

এটাই কি ভবিতব্য?

এই কারণেই বঙ্গ ভঙ্গের মাধ্যমে, হিন্দু মহাসভা ও আরএসএস-র সাথে মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যে পশ্চিমবঙ্গ জন্ম নিয়েছিল, জন্ম লগ্ন থেকে সেই রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের নানা কায়দায় যে ভাবে ইসলাম বিদ্বেষ দিয়ে প্রভাবিত করা হয়েছে তার লাভ আজ অনেক দশক ও প্রজন্মের পরে তুলছে বিজেপি। যে দলগুলোর দায়িত্ব ছিল বঙ্গীয় সমাজ থেকে ইসলাম বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িক চিন্তাধারাকে উৎখাত করা, তাদের নিজেদের লোকেরাই সেই চিন্তাকে যখন বহন করেছে, তখন বিজেপির এই বিস্তার কি সত্যিই খুব অবাক করে? 

Leave a comment
scroll to top