বিহারের জাতিশুমারি দিল্লির মসনদে আসীন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে তুমুল অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। ঘটনাচক্রে জাতিশুমারি না করানোর পক্ষেই এতদিন ইউনিয়ন সরকার অনমনীয় মনোভাব দেখিয়েছিল। কিন্তু বিহারের জাতিশুমারির ফলে এমন বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ্যে এসেছে যার ফলে মোদীর ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) অত্যন্ত সঙ্কটে পড়তে পারে।
১৯৩১ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে শেষবার জাতিশুমারি হয়। তারপর স্বাধীন ভারতবর্ষে এই প্রথম বিহারে জাতিশুমারি হয়। এই জাতিশুমারিতে দেখা যায়, বিহারের মোট ১৩.০৭ কোটি জনসংখ্যার মাত্র ১৫.৫% তথাকথিত উঁচু জাতের মানুষ—যারা ‘জেনারেল ক্যাটেগরি’-র আওতায় এতদিন ধরে ৫০% সংরক্ষণের সুবিধা নিতেন— যাদের উত্তর ভারতের রাজনীতিতে তথাকথিত ‘অগ্রসর শ্রেণী’ বলেও চিহ্নিত করা হত।
এই বর্ণ গোষ্ঠীর ৫০%-এর সাথে আর্থিকভাবে দুর্বল শ্রেণীর অধীনে অতিরিক্ত ১০% সংরক্ষণের সুযোগ পায়। যেখানে বিহারের মতন রাজ্যে মাত্র ১৫.৫% উচ্চ জাতির জনসংখ্যা রয়েছে, তাদের সংরক্ষণ ব্যবস্থায় এত বেশি সুযোগ পাওয়া দেখায় যে কী ভাবে ভারতের জটিল সংরক্ষণ ব্যবস্থা আসলে উচ্চ বর্ণগুলোকে সহযোগিতা করেছে এতদিন। তারা সরকারি চাকরি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একচেটিয়া অধিকার অর্জন করেছে এই সংরক্ষণ ব্যবস্থা কে ব্যবহার করে।
পক্ষান্তরে বিহারের জাতিশুমারির তথ্য অনুযায়ী, বিহারে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণী (ওবিসি) (২৭.১%) ও একেবারে অনগ্রসর জাতি (ইবিসি) (৩৬.০১%) রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ৬৩.১১%। এছাড়াও বিহারে মোট জনসংখ্যার মোট ১৯.৬৫% দলিত শ্রেণীভুক্ত মানুষ যারা প্রায়শই বিভিন্ন ধরনের জাতিবৈষম্য ও জাতিহিংসার শিকার হন। ২০০০ সালে বিহারের আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলি নিয়ে ঝাড়খন্ড রাজ্য তৈরি হওয়ার পর বিহারের আদিবাসীরা মোট জনসংখ্যার মাত্র ১.৬৮%।
কেন বিজেপির কাছে বিহারের জাতিশুমারি একটা চ্যালেঞ্জ?
মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের ডাকা সর্বদল বৈঠকে – জাতিশুমারির প্রস্তাব যেখানে পাশ হয় – বিজেপি অন্যতম শরিক হলেও গেরুয়া পার্টিটি বহুদিন ধরেই বেশ কয়েকটি কারণে জাতীয় স্তরে জাতিশুমারির বিরোধিতা করে আসছে। এই বিরোধিতার বেশ কিছু কারণ রয়েছে।
১) ‘জেনেরাল ক্যাটেগরি’-র হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা
সাধারণভাবে বিজেপি ও তার পৈতৃক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ কে (আরএসএস) উত্তর ভারতের উচ্চবর্ণের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে গণ্য করা হয়, যেখানে জাতপাত সমাজে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় ও সামাজিক বৈষম্যের অন্যতম প্রধান মাপকাঠি।
মোদীর কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার অনেক আগে থেকেই জাতপাতের বদলে আর্থিক সংস্থানের ভিত্তিতে সংরক্ষণের দাবি তুলে আসছে বিজেপি-আরএসএস। এই দাবিটি শুনতে মধুর লাগলেও আসলে এর মাধ্যমে সামাজিক শোষণের শিকার, জাতি বৈষম্যের শিকার জনগণের অধিকার কে সংকুচিত করার চেষ্টা করে উচ্চবর্ণের লোকেরা বলে অভিযোগ করেন দলিত অধিকার আন্দোলনের কর্মীরা।
উচ্চবর্ণের লোকেরা ও হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো প্রায়ই দাবি করে যে জাতি-ভিত্তিক সংরক্ষণের ফলে নাকি তাঁদের মেধার ভিত্তিতে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাঁধা আসছে। তাঁরা দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, শিল্প ও বাণিজ্য, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, প্রভৃতি ক্ষেত্রের শিখরে বসেও অভিযোগ করেন যে জাতি-ভিত্তিক সংরক্ষণের কারণেই এই সব ক্ষেত্রে আশানুরূপ উন্নতি হয়নি। তারা বারবার এই জাতি-ভিত্তিক সংরক্ষণ তুলে দেওয়ার পক্ষে ওকালতি করেছে ও উচ্চবর্ণ কে এই ব্যবস্থার শিকার হিসাবে তুলে ধরেছে।
তবে বিহারের জাতিশুমারিতে জাতপাত ব্যবস্থার আসল চিত্রটি পরিস্কার। এই জাতিশুমারি দেখিয়ে দিয়েছে দলিত ও ওবিসি অধিকার কর্মীরা যা অভিযোগ করেন তা যথাযথভাবেই সত্য। উচ্চবর্ণের গোষ্ঠীগুলি জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ যারা এতদিন ধরে রাষ্ট্রক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারি চাকরি ও সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৫০% সংরক্ষণের সুবিধা নিয়ে আসছে। এর ফলে ভারতীয় সংবিধান প্রণেতারা যে যুক্তিতে জাতপাত-ভিত্তিক সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন তারই উল্লঙ্ঘন করা হয়েছে।
বিহার, উত্তরপ্রদেশের মত রাজ্যে উচ্চবর্ণের গোষ্ঠী বিজেপির সবচেয়ে বড় ভোটব্যাঙ্ক। এই জাতিশুমারির ফলে তাদের ৫০% সংরক্ষণের যৌক্তিকতার প্রমাণ দিতে হবে। এই জাতিশুমারির তথ্য জনগণণায় অন্তর্ভুক্ত হলে তা উচ্চবর্ণের আধিপত্যে ইতি টানবে। ফলে সরকারি চাকরি ও শিক্ষা ব্যবস্থায় তাদের আধিপত্য চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করবে।
২০২২-এর ১৭ মার্চ রাজ্যসভায় ইউনিয়নের সরকারি চাকরিতে জাতিভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে ইউনিয়ন মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিংহ যে তথ্য দেন, তার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ভারতের সবচেয়ে বড় সরকারি চাকরিদাতা ভারতীয় রেল বাদে প্রায় ৫.১২ লক্ষ ইউনিয়ন সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে প্রায় ৯০,০০০ (১৭.৫৮%) দলিত সম্প্রদায়ের, প্রায় ৩৪,০০০ (৬.৬৪%) আদিবাসী, প্রায় ১.০৩ লক্ষ (২০.১২%) ওবিসি ও প্রায় ২.৮৩ লক্ষ (৫৫.২৭%) জেনারেল তালিকাভুক্ত।
বিহারের জাতিশুমারির তথ্য সামনে আসায় কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরিতে উচ্চবর্ণের একাধিপত্য ও দলিত-আদিবাসী-ওবিসিদের প্রান্তিক করে রাখার বিষয়টি আর ধোপে টিকবে না বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারণা। তাছাড়া উচ্চবর্ণের একাধিপত্য কমে গেলে আসন্ন নির্বাচনগুলিতে তার বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে, যা বিজেপির কাছে শিরে সংক্রান্তি হতে পারে।
ফলে এই ‘জেনারেল ক্যাটেগরি’-র আধিপত্য ধরে রাখতে ও নিজের পক্ষে এই উচ্চবর্ণের হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক কে বেঁধে রাখতে গেলে বিজেপির কাছে সর্বভারতীয় স্তরে জাতিশুমারির বিরোধিতা করা ছাড়া আর গতি নেই। যেহেতু বিজেপি ও আরএসএস কট্টর ভাবে উচ্চবর্ণের আধিপত্য কে রক্ষা করতে চায় তাই তার বিরুদ্ধে যায় এমন সব ধরণের প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধেই গেরুয়া শিবির ঝাঁপিয়ে পড়ে লড়বে বলে মনে হয়।
২) মন্ডল রাজনীতির প্রত্যাবর্তন
১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে এবং ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে, যখন জয়প্রকাশ নারায়ণের জনতা পার্টির প্রাক্তন সদস্যরা সরকারি চাকরি ও শিক্ষায় ওবিসি সম্প্রদায়ের জন্য বৃহত্তর প্রতিনিধিত্বের দাবি উত্থাপন করেছিলেন বিএম মণ্ডলের নেতৃত্বাধীন কমিশনের রিপোর্টের সুপারিশ অনুসরণ করে, আরএসএস তখন বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলিকে নিয়ে রাম জন্মভূমি আন্দোলন শুরু করেছিল, যা অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়েছিল ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে।
বিহারে লালু প্রসাদ যাদব এবং উত্তরপ্রদেশে মুলায়ম সিং যাদব, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র এবং অন্যান্য রাজ্যে আরও কয়েকজনের সাথে মন্ডল কমিশনের রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে ওবিসিদের রাজনৈতিক সংহতি শুরু করলেও, বিজেপি এই সম্প্রদায়কে দূরে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। হিন্দু ভোট ব্যাঙ্ককে সুসংহত করতে হিন্দুত্বের পতাকাতলে আরএসএস ওবিসি ও দলিতদের টেনে আনার চেষ্টা করেছিল।
একেই বলা হত মন্ডল বনাম করমণ্ডল রাজনীতি। তবে এই রাজনীতির শুরুর বছরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকলেও, ক্রমেই আরএসএস ও বিজেপির দিকে পাল্লা ভারী হতে থাকে এবং উগ্র হিন্দুত্বের তাস খেলে তারা ওবিসিদের কর্মসংস্থান আর শিক্ষার দাবির আন্দোলন থেকে দূরে সরিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়।
আরএসএস এর প্রতি—উচ্চবর্ণের জন্য তার অকপট ওকালতির কারণে—শুরুর দিকে বিরূপতা থাকা সত্ত্বেও দলিতরা আর ওবিসিরা বড় মাত্রায় অযোধ্যায় রাম মন্দির আন্দোলনের সময়ের থেকে গেরুয়া শিবিরে যোগ দেওয়া শুরু করেন। অবশেষে ২০১৪ সালে মোদীর সিংহাসনে আরোহণের পরে বিজেপি বিহার এবং উত্তরপ্রদেশে জেপি ও লোহিয়াপন্থীদের ওবিসি ভোটব্যাঙ্কগুলি ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছিল।
নিছক ইসলাম বিদ্বেষ দিয়ে চালিত হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি উত্তরপ্রদেশে অনায়েসে দলিত ও ওবিসিদের নিজস্ব রাজনৈতিক অস্তিত্ব কে গুঁড়িয়ে দেয়। বিহারেও সেই প্রচেষ্টা দীর্ঘদিন ধরে বিজেপি করছে। এর ফলে, ব্রাক্ষণত্ববাদ-বিরোধী দলিত আন্দোলনের একটা বড় অংশ নিজ আদর্শ ত্যাগ করে আরএসএস-র লেজুড় বাহিনীতে পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ তোলা হয়।
তবে বিহারের জাতিশুমারির রিপোর্ট প্রকাশের সাথে সাথে পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে চলেছে বলে মনে করা হচ্ছে, কারণ ওবিসি এবং ইবিসিরা সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক পশ্চাদপদতার কথা উল্লেখ করে সংরক্ষণের বৃহত্তর অংশের দাবি করতে পারে। এটি মন্ডল আন্দোলনের চেতনাকে আবার জাগ্রত করতে পারে এবং হিন্দুত্বের অভিযান কে আঘাত করতে পারে। এর ফলে, নির্বাচনে জয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে বিজেপির বহু ব্যবহৃত জাদুর কাঠির শক্তি ক্ষয় হওয়ারও তীব্র সম্ভাবনা আছে।
বিজেপি মণ্ডল রাজনীতির একটি নতুন উত্থানের অনুমতি দিতে পারে না, যা হিন্দিবলয়ে তাকে রাজনৈতিকভাবে রক্তাক্ত করবে এবং তথাকথিত ঐক্যবদ্ধ হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে বিভক্ত করবে। বিজেপির এখন উভয়সঙ্কট। তারা না পারছে প্রকাশ্যে ওবিসি এবং ইবিসিদের বিরোধিতা করতে, না পারছে নিজের অনুগত উচ্চবর্ণের ভোটব্যাঙ্কের বিরোধিতা করে রাজনৈতিক হারা-কিরি করতে। ফলে বিহারের জাতিশুমারির পরে, দলটি নিজেই একটি ত্রিশঙ্কু অবস্থায় রয়েছে।
আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে বিহারের জাতিশুমারির প্রভাব
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন এগিয়ে আসার সাথে সাথে, বেশ কয়েকটি বিরোধী দল তাদের পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা কে শিকেয় তুলে দিয়ে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স (INDIA) গঠনের জন্য হাত মিলিয়েছে, যা বিজেপির জন্য একটি গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ ব্লকটি বিরোধী ভোটের বিভাজন রোধ করতে পারে।
২০২৪-এর দিকে নজর রেখে, ভারতের বিরোধী দলগুলোর সদস্যরা, বিশেষ করে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (কংগ্রেস) নেতারা রাহুল গান্ধীর মত ওবিসি এবং ইবিসি-এর সঠিক সংখ্যা খুঁজে বের করার জন্য দেশব্যাপী জাতিশুমারির শেষ করার পক্ষে কথা বলছেন। গান্ধী ইতিমধ্যে জনসংখ্যার অনুপাতের ভিত্তিতে সংরক্ষণের আহ্বান জানিয়েছেন।
INDIA ব্লকের এই দাবি, যা তার বেশিরভাগ সদস্যের দ্বারা সমর্থিত, বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে ওবিসি ভোটকে প্রভাবিত করার সম্ভাবনা রাখে, যার ফলে বিজেপি আতঙ্কিত হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। যদি কংগ্রেস ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ এবং রাজস্থানের গুরুত্বপূর্ণ বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করতে সক্ষম হয় এবং এই প্রদেশগুলিতে জাতিশুমারি ঘোষণা করে, তাহলে এটি ভারতের অন্যান্য অংশে ওবিসি এবং ইবিসিদের মধ্যেও অনুরূপ আশা জাগাতে পারে। আর এর ফলে বিজেপির উপর চাপও বাড়তে থাকবে জাতিশুমারি করার জন্যে।
বিজেপি বুঝতে পেরেছে যে INDIA জোট যদি বিহারের জাতিশুমারির টেমপ্লেট অনুসরণ করে সারা দেশে জাতিশুমারির দাবি নিয়ে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচন এবং লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, তবে এটি গেরুয়া শিবিরের ওবিসি ভিত্তিকে ধ্বংস করতে পারে। হিন্দু ভোটের মেরুকরণ করার যে সমীকরণ বিজেপি এযাবৎ কাল ব্যবহার করেছে এর ফলে তাতেও বড় ধাক্কা লাগবে।
তাই, মোদী নিজেই গান্ধীর উপর তীব্র আক্রমণ শুরু করেছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন যে কংগ্রেস জনগণকে জাতের ভিত্তিতে বিভক্ত করছে। মোদী, যিনি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তাঁর নিজের জাতিকে ওবিসি হিসাবে তালিকাভুক্ত করেছিলেন, বিলক্ষণ জানেন যে জাতিশুমারির দাবি যদি বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে উত্থাপিত হয় তবে এটি তাঁর জন্য একটি বড় বিব্রতকর কারণ হবে।
ফলে নিজের ওবিসি পরিচয় নিয়ে নানা সময়ে ভোট চাওয়া মোদী এখন ওবিসি ও ইবিসি সম্প্রদায়গুলোর ন্যায় সঙ্গত দাবিকে খারিজ করছেন। জাতিশুমারির দাবিতে শোষিত ও পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়গুলোর আন্দোলনের অভিপ্রায় কে তিনি অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতে চান, কারণ এ ছাড়া তাঁর পক্ষে গদি বাঁচানো মুশকিল হতে পারে।
রাজ্যগুলোর কেন বিহারের জাতিশুমারির অনুকরণ করা উচিত?
নয় দশক ধরে ভারতে জাতিশুমারি হয়নি কারণ দলিত অধিকার কর্মীরা অভিযোগ করেছেন যে উচ্চ বর্ণের লোকেরা চিন্তিত ছিল যে জাতির তথ্য ক্ষমতার আলিন্দে তাদের আধিপত্য নষ্ট করবে। যদিও মন্ডল কমিশনের রিপোর্ট অনগ্রসর শ্রেণীর মধ্যে একটি নতুন জাগরণ এনেছে, কিন্তু ১৯৩১ সালের পরে প্রথমবার হওয়া একটি রাজ্যের জাতিশুমারি তাঁদের আরও বলিষ্ঠ করেছে।
অনগ্রসর শ্রেণীগুলোর মানুষেরা এযাবৎ কাল শুধু শুনেছিলেন যে তাঁরাই ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ আর উচ্চবর্ণের লোকেরা সংখ্যালঘু। কিন্তু বিহারের জাতিশুমারির আগে তাঁদের হাতে কোনো নির্দিষ্ট তথ্য ছিল না। ফলে গোটা দেশে যদি সব রাজ্যে জাতিশুমারির তথ্য বের হয় সেই ক্ষেত্রে সেই সকল রাজ্যের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে জাতি বৈষম্য দূর করতে ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে অবিজেপি সরকারগুলো প্রচেষ্টা করতে পারে।
ইউনিয়ন সরকার গররাজি থাকলেও, বিহারের জাতিশুমারির মতন নয়া দিল্লীকে এড়িয়ে গিয়ে রাজ্যগুলো নিজেদের জাতিশুমারি করতে পারে। এই জাতিশুমারির থেকে প্রাপ্য তথ্য শুধুমাত্র ভারতের নানা রাজ্যে সংরক্ষণের ধরণ পরিবর্তনের চাহিদা বাড়াতেই সাহায্য করবে না, বরং রাজ্যগুলিকে অনগ্রসর শ্রেণী, দলিত এবং আদিবাসীদের সামগ্রিক ক্ষমতায়নের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে সহায়তা করতে পারে।
ভারতের ৪২.৭% সাংসদ “জেনারেল ক্যাটেগরি”-র; মাত্র ২২% সাংসদ ওবিসি সম্প্রদায়ের। নিম্নকক্ষে ৫৪৩টি আসনের মধ্যে দলিতদের জন্যে সংরক্ষিত রয়েছে ৮৪টি আসন আর আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত রয়েছে ৪১টি আসন। রাজ্যগুলির জাতিশুমারি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বে সাহায্য করতে পারে, সংসদে তাঁদের জনসংখ্যার অনুপাতের হারে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে পারে। যা সুদূরপ্রসারী একটি পদক্ষেপ হবে।
বিজেপির তীব্র বিরোধিতার মুখোমুখি হয়ে, বিরোধীরা কী ভাবে দেশের অন্যান্য অংশে বিহারের জাতিশুমারির অনুকরণের দাবির ভিত্তিতে আন্দোলন করতে পারে এবং কী ভাবে এই আন্দোলনগুলো ওবিসিদের জন্য একটি নতুন সংরক্ষণ প্রকল্প আনতে পারে এবং সর্বোচ্চ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে পারে তা এখনো দেখা বাকি। তবে যতদিন না সর্বক্ষেত্রে, ভারতের অনগ্রসর শ্রেণীগুলো, দলিত, আদিবাসী ও সংখ্যালঘুরা দেশের সকল ক্ষেত্রে জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতিনিধিত্ব ও সংরক্ষণ না পাচ্ছেন ততদিন পর্যন্ত সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার দিকে এক পাও এগিয়ে যাওয়া যাবে না।