স্ট্রাসবার্গ ভিত্তিক ইউরোপীয় সংসদে দিনের শুরুতে মণিপুর জাতিগত হিংসাকে কেন্দ্র করে ভারতীয় বিষয়াবলী সম্পর্কিত একটি প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পরে, এবং ঠিক যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্যারিসে অবতরণ করছেন ঠিক তখনই ভারতের বিদেশ মন্ত্রক (MEA) বৃহস্পতিবার রাতে একটি বিবৃতি জারি করেছে। বিবৃতির মর্মবস্তু এই যে, ইউরোপ যেন তার নিজের চরকায় তেল দেয়। হাস্যকর মনে হলেও ব্যাপারটি যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে।
ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের বিবৃতি এই যে, “আমরা দেখেছি যে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট মণিপুরের উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা করেছে এবং একটি তথাকথিত জরুরি প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এই ধরনের হস্তক্ষেপ অগ্রহণযোগ্য, এবং এটি একটি ঔপনিবেশিক মানসিকতা প্রতিফলিত করে ,” এমইএ মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি বলেছেন গতকাল। তিনি আরও বলেছেন “বিচার বিভাগ সহ সমস্ত স্তরের ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মণিপুর-এর পরিস্থিতিকে ধরে রেখেছে এবং শান্তি ও সম্প্রীতি এবং আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টকে তার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তার সময়কে আরও উৎপাদনশীলভাবে ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।”
পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুরের পরিস্থিতি বর্ণনা করার একদিন পরে সর্বশেষ যে বিবৃতি এসেছে, সেখানে এই বছরের মে মাসে শুরু হওয়া সংঘর্ষের ঘটনাকে [যা বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবনহানি ঘটিয়েছিল এবং বিপুল পরিমাণ মানুষের জীবিকা ধ্বংস করেছিল] “পুরোপুরি ভারতের অভ্যন্তরীণ” বিষয় হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ইইউ রেজল্যুশন ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে ” দৃঢ়ভাবে আহ্বান জানিয়েছে” যাতে “জাতিগত ও ধর্মীয় সহিংসতা অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য এবং সমস্ত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার হয়” এবং সেইসাথে “সহিংসতা দেখার জন্য স্বাধীন তদন্তের অনুমতি দেওয়ার জন্য” রেজুলেশনের পাঠ্যটি সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ করেছে যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি “অসহনশীলতা ” “বর্তমান সহিংসতায় অবদান রেখেছে” এবং ” রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, বিভাজনমূলক নীতি (যা এলাকায় হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে উন্নীত করে)” সম্পর্কে উদ্বেগ রয়েছে। এই রেজল্যুশন আরও বলেছে যে রাজ্য সরকারের ইন্টারনেট পরিষেবা নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত ” রিপোর্টিংকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করেছিল” এবং এতে আরও বেশি করে “কর্তৃপক্ষের প্রতি অবিশ্বাস বেড়েছে।”
এই মাসে প্রধানমন্ত্রীর মার্কিন সফর চলাকালীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও এমনটাই অভিযোগ এনেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উপর। যদিও সেই অভিযোগও ভারত সরকারের পক্ষ থেকে একপ্রকার উড়িয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ভারতের অভ্যন্তরে ক্রমবর্দ্ধমান জাতিগত হিংসা এবং সংখ্যালঘুদের কেন্দ্র করে অসহিষ্ণুতা অন্য কথাই বলছে।
যদিও গত ৭ই জুলাই, মণিপুর হাইকোর্ট রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেয় যে রাজ্যে ইন্টারনেট লিজ লাইন (ILL) সংযোগের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার পরে সমস্ত অংশীদারেরা সরকার দ্বারা গঠিত একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির দ্বারা প্রস্তাবিত সুরক্ষাগুলি মেনে চলবে। যদিও সেই আদেশ ভারতের সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল।
সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করা সেই মামলার সর্বশেষ রিপোর্টে, রাজ্য সরকার আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য যে পদক্ষেপগুলি নিয়েছে তা তালিকাভুক্ত করেছে আদালত, যার মধ্যে রয়েছে ভারী নিরাপত্তা মোতায়েন এবং মামলার ভিত্তিতে ইন্টারনেট নিষেধাজ্ঞার শর্তসাপেক্ষ শিথিলকরণ। এমনটাই বিভিন্ন ভারতীয় মিডিয়া সূত্রে জানা গিয়েছে। এর আগে সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল যে ইন্টারনেট মণিপুরে উত্তেজনা বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করার মতো কোনও প্ল্যাটফর্ম নয়, যখন যুদ্ধরত জাতিগত গোষ্ঠীগুলিকে আদালতের কার্যক্রম চলাকালীন সংযম অনুশীলন করতে বলেছিল। আদালত এটাও স্পষ্ট করেছে যে মণিপুরে সহিংসতা বন্ধ করার জন্য এটি আইন-শৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে না, কারণ এটি কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের দায়িত্ব।
প্রসঙ্গত, কৃষক আন্দোলন চলাকালীন দেখা গিয়েছিল আন্তর্জাতিক মতামতকে একপ্রকার গ্রাহ্য না করেই সমস্যা কে নিজের আভ্যন্তরীন সমস্যা বলে গণ্য করেছিল ভারতের সরকার থেকে বিদ্বজ্জনেরা। মণিপুরে দীর্ঘদিন যাবৎ যে জাতিগত সংঘর্ষের যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারত সরকারের কাছে লজ্জাজনক। তাই একে আড়াল করার প্রচেষ্টাই চলছে কি? অন্ততঃ এমনটাই দাবি করছে বিরোধীরা। এখন তর্কের বিষয়, দিনকতক আগে ফ্রান্সে পুলিশী হিংসা এবং জাতিগত সংঘর্ষও এমনই এক পরিস্থিতি তৈরি করেছিল সেই দেশেও। ফ্রান্সের মেয়রেরাও ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিল। সেই বিষয়কে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিভাবে দেখছে? এটাও দেখার বিষয়।