Close

‘এরা’ বনাম ‘ওরা’, বিভাজনই বার্তা মোদীর

রাজ্যে এসে চার দফা সভা মোদীর। সেই সভাগুলি থেকেও বার বার উঠে এলো বিভাজনের কথা। সভা থেকে কী বললেন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী?

রাজ্যে এসে চার দফা সভা মোদীর। সেই সভাগুলি থেকেও বার বার উঠে এলো বিভাজনের কথা। সভা থেকে কী বললেন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী?

রামমন্দির ইস্যু ব্যাকফায়ার করেছে এমনটা স্বয়ং বিজেপিই মনে করছে। কিন্তু তবুও দেশের সর্বত্র প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নির্বাচনী সভায় কোথাও সাম্প্রদায়িক বা কোথাও জাতিগত বিভেদই উঠে আসছে বক্তব্যের মধ্যে। এর অন্যথা হলোনা বাংলাতেও। রবিবার নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণার পর নবম বারের জন্য রাজ্যে এলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। রবিবার রাজ্যের চার জায়গায় সভা করলেন নরেন্দ্র মোদী। সেখানেও কোথাও তফসিলি জাতি বনাম সংখ্যালঘু আবার কোথাও দেশবাসী বনাম ‘অনুপ্রবেশকারী’ বিভাজনেরই বার্তা দিলেন।

এইদিন তাঁর প্রথম সভা‌ ছিল উত্তর চব্বিশ পরগনার বারাকপুরে। সেখানে প্রার্থী অর্জুন সিংহের হয়ে প্রচার সারেন তিনি। এই সভায় তার প্রায় আধঘণ্টার বক্তব্যে বারবার ঘুরেফিরে এসেছে ধর্ম প্রসঙ্গ। আক্রমণ চালিয়েছেন সংরক্ষণের উপর। বলেছেন এরাজ্যে তিনি ‘ধর্মের ভিত্তিতে সংরক্ষণ’ করতে দেবেন না। সভামঞ্চ থেকে তিনি বলেন, “কর্নাটকে কংগ্রেস ওবিসিদের সংরক্ষণ সব মুসলমানদের দিয়ে দিয়েছে। বাংলাতেও আপনাদের সতর্ক থাকতে হবে। ভোটব্যাঙ্কের এই রাজনীতি সিএএ-র মতো আইনকে ‘ভিলেন’ বানিয়ে দিয়েছে।” মোদীর কথায় বাংলায় রাজ্য সরকার হিন্দুদের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে, এই অত্যাচার তিনি চলতে দেবেন না। এই নিয়ে হিন্দু ‘মসীহা’ নরেন্দ্র মোদীর বক্তব্য, “বাংলায় হিন্দুদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রাখতে চান তৃণমূল নেতৃত্ব। হিন্দুদের ভাসিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। এত বড় সাহস! আদিবাসী, দলিতদের সঙ্গে অন্যায় এই দেশ মেনে নেবে না।” সভা থেকে মোদীর পাঁচ গ্যারান্টি, ‘ধর্মের ভিত্তিতে সংরক্ষণ দেওয়া হবে না’, ‘তফসিলি জনজাতির সংরক্ষণ কেউ শেষ করতে পারবে না’, ‘রামনবমী পালন করতে, রামের পুজোয় কেউ বাধা দিতে পারবে না’, ‘রামমন্দিরে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত কেউ বদলাতে পারবে না’, ‘সিএএ কেউ বন্ধ করতে পারবে না’।

এরপর তিনি হুগলীর প্রার্থী লকেট চট্টোপাধ্যায়ের সমর্থনে সভা করেন চূঁচূড়ায়। এখানে যদিও মেরুকরণ ছাড়াও নানা ধরণের বিষয়ে বিরোধীদের কটাক্ষ করেন তিনি। এয়ধকি রাহুল গান্ধীর বয়স নিয়ে কটাক্ষ করতেও ছাড়লেন না। তিনি এই দিন বলেন, “কংগ্রেসের যে শাহজাদা আছেন, তাঁর বয়সের চেয়েও কম আসন পাবে কংগ্রেস।” এই দিন দুর্নীতি নিয়ে তিনি তৃণমূলকে কটাক্ষ করে বলেন, “বাংলার যুবদের ভবিষ্যৎ বেচে দিয়েছে। মা-বাবাদের স্বপ্ন বেচে দিয়েছে। এই সরকারে মন্ত্রীরা জেল খাটছেন। বাড়ি থেকে নোটের পাহাড় বেরোচ্ছে। আপনারা সাজা দেবেন না ওদের?” আবার সন্দেশখালি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “সন্দেশখালিতে কী হচ্ছে, সারা দেশ দেখছে। সব রকম চেষ্টা করছে তৃণমূল। কিন্তু আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি, কোনও অত্যাচারী বাঁচবে না।” প্রসঙ্গত এইদিন ফাঁস হয়েছে সন্দেশখালির দ্বিতীয় স্টিং ভিডিও। যদিও আগের এবং সদ্য ফাঁস হওয়া ভিডিও নিয়ে তাঁকে বাক্যব্যয় করতে শোনা যায়নি। চূঁচূড়ার এই সভা থেকে ৪০০ আসনে জিতে বিজেপির একচ্ছত্র ক্ষমতার বার্তা মোদীর।

চূঁচূড়ার পর তাঁর সভা হয় আরামবাগে। এখানে তিনি প্রার্থী সেখানেও নির্বাচনে মেরুকরণই হাতিয়ার। কিন্তু এখানে ‘বাইনারি’ তফসিলি জাতি বনাম সংখ্যালঘু। এই সভা থেকে তিনি বলেন, “কেন্দ্র সরকার যদি আপনাদের হিতে কোনও যোজনা তৈরি করে, এই তৃণমূল সরকার সেগুলি আটকে দেয়। মোদী বড় অভিযান চালান। ‘অ্যাসপিরেশনাল ডিস্ট্রিক্ট প্রোগ্রাম’। দেশের যে সব জেলায় তফসিলি জাতির মানুষ থাকেন, তাঁদের জন্য। বিরোধী জোটের নেতারা এঁদের সব থেকে পিছনে ফেলে দিয়েছিলেন। মোদী বলেন, এ সব চলবে না। এই জেলাগুলি পিছনে থাকবে না। বিকাশে সকলের আগে উঠে আসবে। ১১০টির বেশি জেলায় অনেক পরিশ্রম করা হয়েছে। ওই জেলাগুলিতে সব থেকে ভাল অফিসার পাঠিয়েছি। দিল্লিতে বসে সব পরখ করা হচ্ছে। এই জেলাগুলি এখন ওই রাজ্যের বাকি জেলা থেকে এগিয়ে গিয়েছে। শিক্ষা, জল, কল, সব কিছুই সুবিধা পাচ্ছেন তাঁরা। এখন ব্লক স্তরে হচ্ছে।”

এরপরই তাঁর বক্তব্য তৃণমূলের কাছে বাংলার চেয়ে ‘ভাইপো’ বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাই তফসিলি জাতির মানুষ কিছুই পাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, “কংগ্রেস, তৃণমূল, বাম সব এক। এরা এখন জনজাতি, তফসিলি জাতি, অনগ্রসর শ্রেণির সংরক্ষণ ছিনিয়ে ধর্মের ভিত্তিতে ভেদাভেদ করতে চায়। গবাদি পশুখাদ্য দুর্নীতিতে অভিযুক্ত এক নেতাই সব প্রকাশ করে ফেলেছেন। অসুস্থতার কারণে জেলের বাইরে এসেছেন। তিনি জানিয়েছেন, সংরক্ষণ মুসলমানদের দিয়ে দেওয়া হবে। কংগ্রেস খেলাতেও সংখ্যালঘুদের সংরক্ষণের কথা বলেছে। আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, বঞ্চিতদের যে অধিকার, মোদীজি তার চৌকিদার।”

এইদিন তিনি রথীন চক্রবর্তীর সমর্থনে শেষ সভাটি করেন হাওড়া জেলার সাঁকরাইলে। সাঁকরাইলে আবারও মেরুকরণের বার্তা তাঁর মুখে। এবার মেরুকরণ দেশবাসী বনাম ‘অনুপ্রবেশকারী’। সাঁকরাইলের সভা থেকে এইদিন তিনি বললেন, “গরিবদের অধিকার ছিনিয়ে নিচ্ছে তৃণমূল। তাদের ২০ মে সাজা দেবেন তো? তুলে ফেলে দেবেন তো? তৃণমূল আপনাদের হিত চায় না। ওরা শুধু অনুপ্রবেশকারীদের হিতসাধন করতে চায়। এরা ভারতের লোককে বহিরাগত বলে। অথচ অন্য দেশ থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীদের বাংলায় কব্জা করতে দেয়। এরা কি বহিরাগত নয়? এরা বাংলার জন্য বিপদ নয় কি?”

বিরোধীদের আবার ধর্মীয় মেরুকরণের ছাঁচে ফেলেও আক্রমণ করেন তিনি। তিনি বলেন, “কংগ্রেস এবং তৃণমূল বাংলার পরিচিতি সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে। অনেক এলাকায় এখানকার লোক অল্পসংখ্যক হয়ে গিয়েছে। তৃণমূলের বিধায়কেরা হিন্দুদের হুমকি দিচ্ছেন। বলছেন, এখানে হিন্দুর সংখ্যা কম। আমরা হিন্দুদের ভাগীরথীতে ডুবিয়ে দেব। তৃণমূল তাঁদেরও রক্ষা করে। তোষণের এই অমানবিক চেহারা কমই দেখা যায়।” এই সভা থেকেও নাম না করে তিনি খোঁচা দেন রাহুল গান্ধীকে, বলেন, “তোষণের রাজনীতিতে তৃণমূল এবং কংগ্রেস পাল্লা দিচ্ছে। কংগ্রেসের শাহজাদা দেশে সকলের সম্পত্তি পরখ করতে চান। আপনাদের সম্পত্তি, জমি সব খতিয়ে দেখতে চান। তার পর তা তাঁদের মধ্যে বিলি করতে চান, যাঁরা ইন্ডি-জোটের হয়ে ভোট জিহাদ করেন। আপনাদের সম্পত্তি ছিনিয়ে নিতে চান। বলছে ইনহেরিটেন্স কর আনতে চায়। কংগ্রেস তফসিলি জাতি, জনজাতি, অনগ্রসর শ্রেণির সংরক্ষণও মুসলিমদের দিতে চায়। এ সব লোককে সংসদে পাঠানো উচিত? তাঁদের জমানত জব্দ করা উচিত নয় কি?” এই চার আসনেই ভোট পঞ্চম দফায় অর্থাৎ আগামী ২০শে মে। হাওড়া থেকে তাই মোদীর চ্যালেঞ্জ, ২০শে মে শুধু সরকার নয়, বাংলার ভবিষ্যতের নির্বাচন।

ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর সাংবাদিকতার ছাত্রী ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, যিনি শ্রম, কৃষি ও রাজনীতি নিয়ে রিপোর্টিং করেন।

Leave a comment
scroll to top