মঙ্গলবার, ৭ই মার্চ গভীর রাতে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার নকশালবাড়ি থানার অন্তর্গত ব্যাঙ্গাইজোত এলাকায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) [সিপিআই (এম-এল)] দলের দ্বারা বসানো একটি কয়েক দশক পুরানো লেনিন মূর্তির উপর আক্রমণ করা হয় বলে অভিযোগ তুলেছে দলটির কর্মী ও সমর্থকেরা। লেনিন মূর্তি ভাঙার ঘটনায় অঞ্চলে তীব্র উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে এবং পথে নেমেছে দলমত নির্বিশেষে নানা বামপন্থী সংগঠন।
সিপিআই (এম-এল) দলের উত্তরবঙ্গ আঞ্চলিক কমিটির পক্ষে পূর্ণ ইস্ট পোস্ট কে জানান যে এই আক্রমণ অজ্ঞাত পরিচয়ের দুষ্কৃতীরা করেছে ঠিকই তবে এটার পিছনে একটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র আছে। পূর্ণ বলেন, “ওরা মূর্খের স্বর্গে বাস করে, ওরা জানে না যে লেনিনের মূর্তি ভেঙে লেনিনের আদর্শ কে মোছা যায় না”।
পূর্ণ জানান যে বহুদিন ধরে এই অঞ্চলে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলন ও ভারতের নকশালবাড়ি কৃষক আন্দোলনের নেতাদের প্রতিষ্ঠিত মূর্তিগুলোর উপর নানা ভাবে আক্রমণ নেমে এসেছে। এর আগে ২০০০ সালে নকশালবাড়ি কৃষক আন্দোলনের স্রষ্টা চারু মজুমদারের মূর্তিটি ভেঙে দেয় এক দল দুষ্কৃতী। পূর্ণ অভিযোগ করেন যে আগে এই জায়গাটা কে ঘিরে রাখা পাঁচিল ভেঙে দেওয়ার প্রচেষ্টা করা হয়েছে।
লেনিন মূর্তি ভাঙার ঘটনা নিয়ে অঞ্চলের মানুষের ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে বলেও পূর্ণ জানান। সিপিআই (এম-এল) দলের নেতা প্রয়াত মহাদেব মুখার্জী এই অঞ্চলে প্রথমে মজুমদারের ও পরে লেনিন ও স্তালিন এর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। সিপিআই (এম-এল) দলের তরফ থেকে রবীন পাত্র জানিয়েছেন যে ১৯৯০-দশকের শুরুতে যখন সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোতে লেনিনের মূর্তি ভেঙে দেওয়া হচ্ছিল, তখন প্রতিবাদ স্বরূপ নকশালবাড়ি আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত এই ব্যাঙ্গাইজোতে এই দুইটি মূর্তি মুখার্জী প্রতিষ্ঠা করেন।
এই ঘটনা নিয়ে সিপিআই (এম-এল) দলের সাধারণ সম্পাদক মানিক উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ও বলেছেন এই ঘটনা আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীর সাথে যুক্ত। তিনি এই ঘটনা কে “সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত” বলে অভিযোগ করেন। সিপিআই (এম-এল) দলের তরফ থেকে এই নিয়ে ধিক্কার সভা ও পোস্টারিং করা হলেও পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়নি।
অন্যদিকে সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন নামক গোষ্ঠীর রাজ্য নেতা অভিজিৎ মজুমদার এই লেনিন মূর্তি ভাঙার ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন। সিপিআই (মার্কসবাদী) দলের উত্তরবঙ্গের নেতৃত্ব এই মূর্তি ভাঙার ঘটনা কে ত্রিপুরা রাজ্যে নির্বাচন-পরবর্তী হিংসার ঘটনার সাথে তুলনা করেছেন এবং সিপিআই (এম-এল) বাদে বাকি বেশির ভাগ বাম দলেরই অভিযোগ যে নকশালবাড়িতে লেনিন মূর্তি ভাঙার পিছনে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও হিন্দুত্ববাদী শক্তির হাত আছে।
উল্লেখ্য যে নকশালবাড়ি সহ উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে, স্থানীয় রাজবংশী ও গোর্খা আদিবাসীদের সাথে পূর্ব বঙ্গের থেকে আগত বাঙালি উদ্বাস্তুদের দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে ও সুচারু ভাবে মুসলিম-বিদ্বেষী রাজনৈতিক প্রচার করে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর পুরোধা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) নিজের প্রভাব বৃদ্ধি করেছে ও সংগঠন বিস্তারিত করেছে।
নকশালবাড়ি বিধানসভা কেন্দ্র থেকে ধর্মীয় ও জাতিগত মেরুকরণের ফলে ২০২১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন বিজেপির আনন্দময় বর্মণ। এলাকার মানুষের মতে বিগত ২০ বছরে হুহু করে আরএসএস-পরিচালিত বিদ্যালয় ও নানা সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে, বিশেষ করে তৃণমূল কংগ্রেস শাসনকালে, এই অঞ্চলে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খুঁটি শক্ত হয়েছে। এই নিয়ে সিপিআই (এম-এল) বা অন্য কোনো বাম দলের মতামত পাওয়া যায়নি।
তবে অভিজিৎ বাবুর করা অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন বিজেপি বিধায়ক বর্মণ। ত্রিপুরায় ২০১৮ সালে নির্বাচনে জিতে লেনিন মূর্তি ভেঙে দেওয়ার ঘটনা ও কলকাতায় ২০১৯ সালে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার ঘটনাগুলো কে উল্লেখ না করে তিনি সংবাদ মাধ্যম কে জানিয়েছেন যে বিজেপি মূর্তি ভাঙার রাজনীতি করে না, এবং নকশালবাড়ি অঞ্চলে বামপন্থী বা অতি-বাম রাজনীতির কোনো প্রভাব আর নেই।
শাসক তৃণমূল কংগ্রেস এই ঘটনা নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেয়নি। তবে পুলিশ লেনিন মূর্তি ভাঙার ব্যাপারে তদন্ত শুরু করেছে বলে জানালেন নকশালবাড়ি থানার আইসি প্রদীপ ত্রিক্ষত্রী। ইস্ট পোস্ট কে ত্রিক্ষত্রী জানান যে অভিযোগ পেয়েই পুলিশ ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে, তবে এখনো কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি।