আপনারা পিএফ পেয়েছেন কখনো? চাকরি শেষে পেনশন ব্যবস্থা, মৃত্যুর পর বিধবা পেনশন ইত্যাদি এইসব বিষয় নিয়ে আপনারা কি জানেন? না জানলেও কোনো লজ্জা নেই, বেশিরভাগ মানুষই হয়তো জানেন না এখনও আমাদের দেশে। আমার বাবা আমাকে বোঝাচ্ছিলেন এইসব ব্যাপার নিয়ে যাতে নিজের চাকরি জীবনে সতর্ক থাকি। কিন্তু এই ব্যাপারে আমরা শহুরে চাকরিরত মানুষ যেভাবে বিষয়গুলো জানি, মানে নিজেদের পেনশন, পিএফ এর হিসেব করি, সরকারি চাকরি এবং আজকাল কর্পোরেটেও এই ধরনের যা ব্যবস্থা হয়েছে তা নিয়ে আমরা অবগত। কিন্তু যারা একেবারে লেবার? মানে অত চুক্তি পরতে পারেন না তাদের কি অবস্থা দাঁড়ায়?
আমাকে আমাদের এক পুরোনো কর্মী শাহনাওয়াজ (নাম পরিবর্তিত) ফোন করেছিলেন। হঠাৎ অনেকদিন পর ওনার সাথে যোগাযোগ হয়ে আমি স্বাভাবিক ভাবেই উচ্ছসিত এবং উদগ্রীব ওনার বর্তমান পরিস্থিতি জানার জন্য। উনি আমাদের মধ্যে প্রায় সবচেয়ে প্রবীন কর্মচারী ছিলেন। উত্তর প্রদেশের আজমগড় অঞ্চলের বাসিন্দা, অন্তত দশ বছর ধরে সৌদিতে ছিলেন। একই এজেন্সির কর্মী হিসেবে দুটি রেস্টুরেন্টে কাজ করলেন উনি দশ বছর, মাঝে ৩বার মাত্র ছুটিতে গেছিলেন। উনি আগেই কাজ ছাড়তে চেয়েছিলেন করোনা মহামারীর আগেই, কিন্তু কোম্পানি তখন করোনার নিয়মকানুনের গল্প শুনিয়ে ওনাকে দেশে ফিরতে না দিয়ে আরো দুই বছরের চুক্তি বাড়িয়ে নিয়েছিল। ওনার ইচ্ছা ছিল যেটুকু টাকা পাবেন চাকরি ছাড়ার পর, সেইটা দিয়ে নিজের গ্রামে ফিরে আবার ওনার বেনারসি শাড়ির তাঁতির কাজ শুরু করবেন।
শাহনাওয়াজ আমাদের কোম্পানির সাথে ৪বছর যুক্ত ছিলেন। তাঁর চুক্তি শেষ হওয়ার মাস চারেক আগেই উনি দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন। কিন্তু তাড়াতাড়ি চুক্তি শেষ করানোর জন্য তাঁর সেই মেয়াদের শেষের অঙ্কের কিছু টাকাও কাটা হয়। কিন্তু তা কত সেই হিসেব তিনি বোঝেননি। তাঁকে বোঝানো হয়নি। তিনি মাত্র হাজার পাঁচেক রিয়াল নাকি পেয়েছেন দশ বছরের কাজের জন্য ওনার এজেন্সির তরফ থেকে। ৩বার ছুটি গেছেন তাই সেই টাকা কেটে নেওয়া হয়েছে। এইবার ওনার সমস্ত হিসেব হয়েছে ওনার প্রথম মাইনে থেকে। প্রথম বেসিক মাইনে অত্যন্ত কম থাকবেই কারন কোম্পানিগুলো ভালোই বোঝে যে সমস্ত রকমের হিসেব বেসিকেই হবে, বাকি টাকা খাওয়ার জন্য আর ওভারটাইম, বোনাস হিসেবে হয়তো ধরাবে।
পাচঁ হাজার মতো আমি নিজেই দুবছরে পেয়েছিলাম। তাহলে এত বছরে উনি এত কম কি করে পেলেন? মানে আরেকটু তো পাওয়া উচিত ছিল। পদ অনুযায়ী আমার থেকে অনেক নীচে থাকলেও ওনার চল্লিশের ওপর বয়স, এবং তিনটি ছোট বাচ্চা গ্রামে। ভীষণ ভদ্র এবং শান্ত স্বভাবের ব্যাক্তি, আমি ওনার বিনয় দেখে সত্যিই অবাক হয়ে যেতাম। কত গ্রামের গল্প বলতেন, ঘর পরিবার নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন… শুধু একটাই ইচ্ছা ছিল যে দেশে ফিরে আবার তাঁতির কাজ করে বাচ্চাদের বড়ো হওয়ার সময়ে পাশে থাকবেন। এইবার উনি না পেলেন আশা অনুযায়ী টাকার হিসাব, না জমলো ওনার ব্যবসা। দেশের যা অবস্থা, ছোট ব্যবসায়ীদের একেবারেই টেকা সম্ভব নয় আর, উনি দুঃখ করে জানাতে থাকলেন আমাকে ফোনে। প্রায় বছরখানেক পর আমাকে ফেসবুকে খুঁজে আমার সাথে উনি যোগাযোগ করে ব্যাপারটা জানালেন, এবং এটাও জানালেন যে দেশে কাজ জমাতে না পেরে উনি আবার ঘর পরিবার সমস্ত কিছু ছেড়ে কুয়েত পাড়ি দেবেন এইবার। সেখানে কাজ পেয়েছেন একটা, এবং পৌঁছেই আমার জন্য একটা ফোন দেবেন! সে যাই করুন উনি, আমি কিছুতেই সমস্ত সরকারি এবং বেসরকারি হিসাব ও নিয়ম অনুযায়ী ওনার এত কম টাকার ব্যাপার বুঝলাম না। কিন্তু ওনার এই দুতরফেই দুর্ভাগ্যের কথা খুব ভালোভাবে বোঝা যায়, এই ধরনের শ্রমিকদের দুরবস্থার হিসেবে সরকার এবং মালিকদের তরফ থেকে কোনো অবাক করার মতো ভুল নেই।