আগের সপ্তাহে যা বলছিলাম, সেই নিয়ে যেন বলে শেষ করা যাচ্ছে না। গতবার সৌদির কত শ্রমিকদের ভীষনরকম শারীরিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে সেই নিয়ে চর্চা করেছিলাম। আজ এই নিয়ে আরো কিছু কারণ বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। এক দেশি ভাই, আবু সোহেল(নাম পরিবর্তিত) এক কেলেঙ্কারি আবিষ্কার করলো। হঠাৎ জানতে পারলো যে তার কাজের চুক্তি আকষ্মিকভাবে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই ব্যাপারে বুঝতে গেলে সৌদি আরবের এই চুক্তি ব্যবস্থা নিয়ে জেনে রাখলে ভালো। দুবাই, আবুধাবির মতো ব্যবস্থা সৌদি আরবে প্রচলিত নয়। এখানে যে কোন কর্মী, সে ব্লু কলার হোক কি হোয়াইট কলার, তার কাজ অথবা চাকরি নির্ভর করে তার কন্ট্র্যাক্টের ওপর। লেবার যেই শ্রেণীরই হোক অথবা সৌদি কোম্পানিতে চাকুরিরত কর্মচারী বা অফিসার যেই পদেই থাকুন না কেন, তাকে কন্ট্র্যাক্টের আওতায় থেকেই কাজ করতে হবে।
সেই চুক্তিতে নিরধারিত করে দেওয়া হয় যে সেই কর্মী কত বেতনে, কি কাজের জন্য নিযুক্ত হচ্ছেন। সেটা কতদিনের জন্য চুক্তি, কত ছুটি পাওয়া যাবে, কি কি সুবিধা পাওয়া যায়, সব লেখা থাকে তার মধ্যে। সমস্ত চুক্তি আগাগোড়া পড়ার পরেই তাই সই করতে হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী সেই কোম্পানি তাদের ইকামা, অর্থাৎ সৌদিতে বসবাসের সরকারি পরিচয়পত্র তৈরি করেন। এখন শ্রমিক রা সেই নিয়ে বেশ ওয়াকিবহাল, তাই তারা আর কোনো রকম ফাঁদে পরার সুযোগ করে দেন না। নাহলে, আমাদের সেই আনিস ভাই জানালো যে দশ বছর আগে যখন সে সৌদি এসেছিলো তখন সব কন্ট্র্যাক্ট নাকি আরবি তে লেখা হতো, আর শ্রমিকরা নিরুপায় হয়ে না বুঝেই সই করে দিতো। এখন ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয় বলে অনেক সুবিধা হয়েছে। তবুও এর মধ্যে অনেক মারপ্যাঁচ থেকে যায়, এদিক ওদিক অনেক ফাঁকফোকর থেকেই যায় যার কারনে শ্রমিকরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। সেইসব নিয়ে যদি শ্রম আদালত অথবা এখানকার দেবার কোর্টের দ্বারস্থ হন কেউ, তাতেও খুব একটা লাভ হয়না বলছি শুনেছি। আইনকানুন, বিচারব্যবস্থা নাকি সবকিছুই মুদির অথবা মালিকদের হাতে।
তা আমাদেরও সেই ব্যবস্থাই আছে। এর মধ্যে আমাদের আবু ফেঁসে গেল কিভাবে সেটা দেখা যাক। আমরা যেই কোমপানি তে নিযুক্ত, সেই কোম্পানি নিজেদের ভিসা অথবা ইকামা লাগানোর অধিকার নেই কিছু কারনের জন্য। তাই তারা নিজেদের অন্যান্য ফ্র্যাঞ্চাইজি অথবা লেবার এজেন্সির মাধ্যমে কর্মীদের ভিসার ব্যবস্থা করে। এবার যেই কর্মী কে পছন্দ হয়ে যায়, তাকে নিজেদের ইকামায় ট্রান্সফার করিয়ে নেয়। আমার কোম্পানি ইকামা ইশু করতে পারবে না কিন্তু ট্রান্সফার করতে পারবে। তাই এই ব্যবস্থা চালু করেছে, যেটার আওতায় আমাকেও ট্রান্সফার করিয়ে নিতে চেয়েছিলো।
এইবার আবুকে সেই ভাবে ট্রান্সফার করাতে গিয়ে দেখা গেছে যে তার কাজের দিন নতুন চুক্তি অনুযায়ী লাগানো হয়েছে, অর্থাৎ আগের কোম্পানির নামে আট মাসের কাজের হিসেব গায়েব করে দিয়ে নতুন চুক্তির এক বছর সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পুরোনো কাজের কোনো রেকর্ড নেই আর! সে এখন তার পুরনো কোম্পানির নতুন কর্মচারী যার নতুন এক বছরের চুক্তি, যার আগের আট মাসের কাজের হিসেব অনিশ্চিত হয়ে গেল। সেই আট মাসের যত পাওনা ছুটি, বেনেফিট, সেগুলোর কি হবে সেই নিয়ে সে ঝামেলা শুরু করেছিলো। কোম্পানির বড়ো হর্তাকর্তারা তাকে আশ্বস্ত করছে যে তারা সেই সবের ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করিয়ে দেবেন। কিন্তু লিখিতভাবে না পেলে যে সেইসমস্ত আশ্বস্তিকরণের কি পরিনতি হতে পারে তা ভালোই জানা আছে আমাদের। সোহেল আর এক বছর কোনো পদোন্নতির দাবি করতে পারবে না স্বাভাবিক ভাবে। সে তার নির্ধারিত সময়ে দেশে ফিরতে পারবে কিনা ঠিক নেই আর। পিএফের হিসেবের অনিশ্চয়তা তো ছেড়েই দিলাম।
আমরা সকলে মিলে যখন ওকে এই নিয়ে বোঝাতে গেলাম যে ওর এইভাবে বিনা যাচাই করে নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করা উচিত হয়নি তখন ও ওর সই করা চুক্তির ছবি বার করে দেখিয়ে দিল। স্পষ্ট বোঝা যায় যে সে যেই চুক্তি তে সই করেছিলো, সেটার মধ্যে তারিখ বদলে দিয়ে সরকারি খাতায় রেজিস্টার করা হয়েছে। আমি সেই চুক্তির ছবি দেখলাম, তার মধ্যে ওয়াটার মার্ক আছে “আনথরাইজ্ড কপি”। কোনো স্যাম্পল কপি ওকে দিয়ে সই করিয়ে টিপ সই নিয়ে নিজেদের মতো আলাদা কপি ছাপিয়ে নিয়েছে। সোহেল লেখাপড়া জানলেও চুক্তির সমস্ত টার্মস ভালো মতো পড়ার পরে ওয়াটার মার্ক টা আর খেয়াল করেনি…