কারুর পৌষ মাস তো কারুর সর্বনাশ। হাড় কাঁপানো শীত আসার আগে এই উক্তিটি এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি আমরা। রিয়াধের কুখ্যাত শীত নিয়ে অনেক আগে থেকেই পুরোনো বাসিন্দাদের কাছে নানা কাহিনী শুনেছিলাম। একজন একা থাকতেন নিজের জন্য আলাদা কামরা নিয়ে, উনি নাকি হিটার কিনতে বাধ্য হয়েছিলেন। জেড্ডা, দাম্মাম,দুবাইয়ের মতো সমুদ্র সৈকত গুলোর আবহাওয়া বেশ আরামদায়ক থাকে এই সময়ে, এবং অস্বাভাবিক হাওয়ার কারনে গরমকালেও গায়ে সেই গরমটা লাগেনা যেন। কিন্তু রিয়াধে আবহাওয়া শীত গ্রীষ্মের দুই ক্ষেত্রেই অতিমাত্রায় পৌঁছে যায়। জুলাই মাসে রিয়াধে বাস থেকে নেমে যেন শরীর খোলা অংশে ছ্যাঁকা লাগছিল। এখন সন্ধ্যার পরে গরম কাপড় ছাড়া বাইরে বেরোনো যাচ্ছে না।
এইবার শুরুর ওই উক্তি করার কারনে আসা যাক। শীতের সাথে সাথে যে কর্পোরেটও বরফের মতো ঠান্ডা আচরণ করবে আমাদের সাথে সেই নিয়ে প্রথম থেকেই কোনো সন্দেহ ছিল না। এই কারণে বলছি কারন এতদিনে আমার নিজের দেশে পৌঁছে যাওয়ার কথা। আমার কর্ম চুক্তি শেষ হয়ে দশ দিন হয়ে গেছে, এখনও আমার বাড়ি ফেরার পার্মিট এবং দুই বছরের গ্র্যাচুইটি হিসেব আসেনি। সচরাচর তাড়াতাড়ি আসেও না, আমার এক পিসেমশাই এককালে দাম্মামে ডাক্তারি করতেন, ওনার প্রায় দুই সপ্তাহ লেগেছিল সমস্ত কাজ শেষ হতে। এই ক্ষেত্রে মনে করিয়ে দেওয়া ভালো যে সৌদি তে যেকোনো বিদেশী কর্মচারী, সে যেই পোস্টেই থাকুন না কেন, ওনার চাকরি চুক্তির আওতায় থাকা বাধ্যতামূলক।
এই চুক্তি অনুযায়ী চাকরি হলে আমরা এটাকে রীতিমতো সরকারি চাকরি হিসেবেই মনে করেনিই, কারন চুক্তি অনুযায়ী যেমন নানা সুযোগ সুবিধা লাভ করা যায় তেমন চাকরি নিয়ে একধরনের নিশ্চয়তাও থাকে। আমরা আশ্বস্ত থাকি যে চুক্তি পর্ব অবধি অন্তত আমাদের এই চাকরি পাকা থাকবে, এবং একটা নিরধারিত সময়ে চুক্তি অনুযায়ী চাকরি ছেড়ে অন্য খোঁজ শুরু করার কথা ভাবতে পারবো অথবা বার্ষিক ছুটি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করে রাখতে পারবো। কিন্তু করপোরেট যেন সেইসব নিয়মের আর কোনো ধার ধারছে না, যেই হিসেবে কাজ শুরু হয়েছে। গতবার যেই ঘটনা উল্লেখ করেছিলাম সোহেলের দুরবস্থা নিয়ে, যেভাবে তার হঠাৎ চুক্তি বদলে মেয়াদ বেড়ে গেল তা অত্যন্ত দুশ্চিন্তাজনক।
আমার এবং আমার বাকি সাথীদের চুক্তি শেষ হতে কোম্পানি সঙ্গে সঙ্গে নতুন চারজন ফিলিপিনো কর্মী নিয়োগ করে ফেললো। এবং এক সপ্তাহের মধ্যে হঠাৎ তাদের দুজনকে ছাঁটাইও করে দিল। এরকম হঠকারী “হায়ার এন্ড ফায়ার” চিন্তাধারায় আজ যুবসমাজ বিপর্যস্ত। কোম্পানির যদি সেই স্টাফ পছন্দ নয়, তাহলে সঠিকভাবে ইন্টারভিউ কেন নিলো না যাতে আগে থেকেই তাদের ক্ষমতা বিচার করা যেত? এইভাবে হয়রানির কি প্রয়োজন ছিল? এখন সেই ছেলে দুটো নিরুপায় হয়ে কোম্পানির কোয়ার্টারে বসে আছে আমার সাথে বেকার হিসেবে, যতক্ষণ না তারা এই এক সপ্তাহের হিসাব নিয়ে নতুন কাজ যোগাড় করতে পারে। নিজের ঘর পরিবার, নিজের দেশ ছেড়ে দূর বিদেশে এহেন হয়রানির শিকার হওয়ার অনুভূতি লিখে বোঝানো যায় না।
এইসবের মধ্যে এইমাত্র আমার একটা সুখবর পেলাম, যে অনেক খোঁচানোর পর অবশেষে নাকি আমাদের ম্যানেজাররা আজ আমার অভিজ্ঞতাপত্র অথবা এক্সপিরিয়েন্স লেটার ছাপা হচ্ছে। এতদিনে! আমি প্রায় আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম যে এটা প্রাপ্তি হবে, কিন্তু অবশেষে যখন হচ্ছে তখন আশা রাখছি যে এইবার বাকি সমস্ত কাজ দ্রুত মিটিয়ে নেওয়া যাবে। সেটা ভাবতে গিয়ে খেয়াল হলো, আমার সমস্ত ইউরোপীয় ম্যানেজাররা আমায় বলেছেন যে আমি যেন অবশ্যই ফেরত আসি খুব তাড়াতাড়ি। আমি তখন চিন্তা করছি যেই কর্মীরা থেকে যাচ্ছে, তাদের কি পরিনতি হতে চলেছে। ইতিমধ্যেই এত রকমের কান্ড প্রত্যক্ষ করছি, এরপর আমাদের টিমটা বেরিয়ে গেলে কি ভীষণ অত্যাচার শুরু হতে চলেছে, সেটা আর দেখার মত অবস্থা থাকবে না আমার। সকলে যেন পালানোর পথ খুঁজছে, একটা সুযোগ হাত করার প্রচেষ্টায় আছে, যেভাবেই হোক, জেলখানা থেকে ছাড়া পেতেই হবে।