Close

সৌদির চিঠি: মুসলিম দেশে হিঁদুর বিজয়া (পর্ব ২৩)

সৌদিতে ইসলাম ছাড়া অন্য কোনও ধর্মের পার্বণ নিষিদ্ধ, এমটাই শোনা যায়। কিন্তু বাঙালিরা সেখানেও পুজোর ব্যবস্থা করেই নিয়েছে। লিখছেন পথিকৃৎ।

সৌদিতে ইসলাম ছাড়া অন্য কোনও ধর্মের পার্বণ নিষিদ্ধ, এমটাই শোনা যায়। কিন্তু বাঙালিরা সেখানেও পুজোর ব্যবস্থা করেই নিয়েছে। লিখছেন পথিকৃৎ।

আজ প্রথমবার এমন এক মহালয়া কাটাচ্ছি যেমন কোনোদিন আশা করিনি। সৌদি তে আসার সময়ে সবার থেকে অনেক কিছু শুনেছিলাম যে এখানে ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা পুজো নিষিদ্ধ। এমনকি দেখলাম যে অনেক ইসলামী পরব আমাদের ভারতীয়দের মতো অত জাঁকজমকের সাথে পালন করা হয়না। তাই দূর্গাপূজার কোনো গল্পের আশা ছেড়েই রেখেছিলাম। কিন্তু এখানে কলকাতার বাঙালি সমাজের সাথে যোগাযোগ হওয়ার পর জানতে পারছি, সবাই সবার মতো ঠিক ব্যবস্থা করেই নিয়েছেন। বাঙালি পৃথিবীর যেখানেই থাকুক না কেন, দূর্গাপুজো করতে থেমে থাকবে না!


সেই অর্থে পুজো পার্বণ হচ্ছে না এখানে, কিন্তু প্রতি বছর এক বিজয়া সম্মেলনী হয় রিয়াধ শহরে। একদমই ছোট্ট আয়োজন, হাতে গোনা কয়েক হিন্দু বাঙালির ঘরোয়া ব্যাপার, যা সবার ছুটি দেখে এই বছর নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আয়োজন করা হয়েছে। একসাথে বিজয়া এবং দিপাবলী দুটোই হয়ে যায় আর কি। এমনিতেই কলকাতার বাঙালি এক দুর্লভ জাতি এই দেশে, তাই আর অত কিছু আয়োজন করা সম্ভব হয়নি, উদ্যোগও ওঠেনি। এইটুকুই যে হচ্ছে, সেটাই অনেক বড়ো ব্যাপার যেন। খুব আনন্দ লাগছে এই ভেবে যে আমাকেও নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, আমার কোম্পানির সিনিয়র সায়ন্তনদা, যার কথা এর আগে পর্ব পনেরোয় বলেছিলাম, ওনার সৌজন্যে এই বাঙালি দলটির সাথে আমার পরিচয় হয়েছে।

আমরা দুজন নিজেরা বিশ্বাসে নাস্তিক হলেও, দুর্গাপূজোটা যেন ব্যাতিক্রম। নিজে ধর্মীয় রীতি নীতি না মানলেও, পরিবার বন্ধু জনদের সূত্রে এমন এক টান থেকেই যায় যেটা অনেক ছোট বয়স থেকেই আমাদের মধ্যে যেন চারা রোপণ করে দিয়ে লালনপালন করানো হয়। সেই চারা কে তো অত সহজে একবারে টেনে হিঁচড়ে ছেঁড়া যাবে না, অতএব ভালো ছেলের মতো আজকের দিনে নতুন জামা গায়ে দিয়ে সবাইকে সকাল সকাল মহালয়ার শুভেচ্ছা জানিয়ে দিলাম। সবার আগে আমার মাসতুতো বোন আমাকে মহালয়ার শুভেচ্ছা জানালো। ও নাকি তখন টাইগার হিল্সে বসে কাঞ্চনজঙ্ঘায় সুর্যোদয় দেখতে দেখতে মহালয়া শুনছে! এরকম সংবাদ শোনার পর কোন বাঙালি আর স্থির থাকতে পারে! আমার যেন আলাদাই হিংসা চেপে ধরলো, মনে হলো আমাকেও এবার এরকম কিছু একটা দিতে হবে তাই আমিও জানিয়ে দিলাম যে আমি সৌদি আরবের মাঝখানে মরুভূমির শহরে বসে কলকাতার টাইমের সাথে মিলিয়ে মাঝরাতে মহালয়া শুনছি। ঘরে থাকতে জীবনেও অত ভোরে উঠে শুনিনি যদিও, কিন্তু এ যেন আলাদা এক “পিয়ার প্রেশার”!


কখনোই অঞ্জলি দেওয়া, মহালয়ার রেডিও চালানো, সরস্বতী পূজার জন্য বই দেওয়া, এইসব নিয়ে তেমন মাতামাতি আমার ছিল না। কিন্তু এখন নিজের ঘরের থেকে, নিজের সমাজ সংস্কৃতির থেকে এতদিন এত দূরে থেকে এইসব পিছুটান যেন প্রতিনিয়ত বাড়তেই থাকছে। বড়ো হওয়ার পর কলকাতায় থাকতে দূর্গাপূজা নিয়ে সমস্ত উৎসাহ যেন হারিয়ে ফেলেছিলাম, কিন্তু আজ যখন দেখছি আমার দাদা মহালয়ার ভোরে ব্যাঙ্গালোর থেকে কলকাতার ফ্লাইটে উঠছে, তখন হঠাৎ করে যেন বুকটা ধক করে উঠলো। মনে পড়ে গেল দুবাইয়ের সেই নদিয়া জেলার ম্যানেজারের কথা, যিনি নাকি চোদ্দ বছর কলকাতার দূর্গাপুজো দেখেননি! ছুটিতে গেছেন অবশ্যই, কিন্তু দূর্গাপুজো আর দেখা হয়ে ওঠেনি।


রিয়াধে যেই সমস্ত হিন্দু বাঙালি থাকেন, তারা প্রায় প্রত্যেকেই বেশ উঁচু পোস্টে আছেন এবং সেই কারনে নিজেদের পুরো পরিবার নিয়ে বিজনেস ভিসায় থাকার সুবিধা পান, অথবা কোম্পানির তরফ থেকে ভালোই ছুটি পেয়ে যান। তাই তারা তাদের সুবিধা অনুযায়ী দূর্গাপূজার সময়ে পরিবার সমেত দুবাই অথবা বাহরাইন পৌঁছে যান। সেখানে দূর্গাপূজার অনুমতি আছে, ভালোই পুজো হয়। দুবাই তে যেখানে আগে দুটো পুজো হতো, এখন নাকি ১৫-১৬টা হয়। বাহরাইনের ছোট্টো দ্বীপ টাও এখন দারুণ ছুটি কাটানোর জায়গা হয়ে গেছে, দূর্গাপূজার উইকেন্ডে প্রবাসী বাঙালিরা সেখানে অনায়াসে গিয়ে অঞ্জলী দিয়ে আসেন। বাদ পড়ে যাই যেন আমরা। আমাদের পরিস্থিতি এখন কলকাতার মতোই অনেকটা হয়েছে। দূর্গাপূজার সময়ে পুজোটা কে কার্নিভাল করে তোলার জন্য যারা লেগে থাকেন, সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন এই সময়টির জন্য যখন একটু দুপয়সা কামানো যাবে কয়েকটা বেলুন বেচে, একটা রোলের দোকান দিয়ে, কোনো পুজোয় ঢাক বাজিয়ে, আজকাল কলকাতার ভদ্রসমাজ উঠেপড়ে লেগেছে তাদের নিয়ে লেখালেখি, সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করার জন্য।

একটু সহানুভূতিশীল পোস্ট আজকাল দারুণ চলে বাজারে তাই পুজোর থেকে বেশি এইসবই দেখি। আর তখন মনে হয় এইসব তো যেন এখন আমাকে নিয়েই লেখা হচ্ছে, মধ্যবিত্ত বাঙালি যেখানে পরিবার নিয়ে ঘুরতে বেরোচ্ছে, তখন আমি বাকি শ্রমিকদের সাথে তাদের উৎসবে আরো রোশনাই জোগানোর জন্য লেগে আছি! এখন যেন আর সেইসব পোস্টগুলো আদিখ্যেতা মনে হচ্ছে, যখন দেখছি বাকি শ্রমিকদের চোখে মুখে পুজো নিয়ে আমার মতো কোনো উৎসাহ নেই, বরং এক চির হতাশার ওপর আরেকটু বেশি কাজ করার দৃঢ়তার পারদ চড়েছে শুধু।

Leave a comment
scroll to top