Close

সৌদির চিঠি: ঘরে ফিরবো কবে? (পর্ব ২৪)

কাজের চোটে পাঁচ বছরে ঘরে ফেরা হয়নি। বাইরে কেমন কাটছে পুজোর মরশুম? সৌদি থেকে প্রবাসের চিঠিতে লিখছেন পথিকৃৎ সরকার।

কাজের চোটে পাঁচ বছরে ঘরে ফেরা হয়নি। বাইরে কেমন কাটছে পুজোর মরশুম? সৌদি থেকে প্রবাসের চিঠিতে লিখছেন পথিকৃৎ সরকার।

সৌদির চিঠি পর্ব ২৩

এই বছরেও দূর্গাপুজো হয়ে লক্ষ্মী পুজো এসে গেল কিন্তু আমার ঘরে ফেরা হলো না! গত পাঁচ বছর ধরে আমি কলকাতার বাইরেই দূর্গাপুজো কাটাচ্ছি শুধুমাত্র প্যান্ডেমিকের বছর টা ছাড়া, তবে আগে দিল্লিতে থাকতে দিল্লির পুজো গুলো ঘুরে দেখতে পারতাম। কিন্তু এখন সৌদি আরবে সবরকম মূর্তিপূজা নিষিদ্ধ বলে এখানে দূর্গাপুজো স্বাভাবিকভাবেই দেখতে পারছি না। পাশে বাহরাইন আর দুবাই থেকে অনেক প্রবাসী বাঙালি সেখানকার পুজোর ছবি ভিডিও পাঠাচ্ছেন। এই প্রথমবার পুজো থেকে এত দূরে থেকে, আর সম্পূর্ণ এক বিপরীত গোষ্ঠীর মধ্যে বসবাস করে যেন এক আলাদা আঙ্গিকে পুজো উপলব্ধি করতে পারছি।


আগেই এক পর্বে বলেছিলাম পারিপার্শ্বিকভাবে সাধারণ শ্রমিকরা কিভাবে দূর্গাপুজো অথবা এমন কোনো বড়ো অনুষ্ঠান উদযাপন করেন। আমরা মানে কলকাতার মধ্যবিত্ত বাঙালির থেকে কতটা আলাদা ভাবে পুজো কাটান সেই শ্রমিক শ্রেণী। আজ বলবো হিন্দু ধর্ম ব্যতীত বাকি জনগোষ্ঠীরা কিভাবে এইসব উৎসব অনুভব করেন। বাংলাদেশিরা খুব উৎসাহের সাথে নিজেদের গ্রামের পুজো গুলোর গল্প করেন এবং তারা কিভাবে কত বাড়িতে ভোগ খেতে যান। বাংলাদেশের পুজো গুলোর বেশিরভাগ ফান্ড নাকি মুসলমানদের থেকেই আসে এবং বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে অনেক অনুদান দেওয়া হয়। বিশাল জাঁকজমকপূর্ণ ব্যাপার, কলকাতার সাথে পাল্লা দিয়ে ঢাকা এগিয়ে যাচ্ছে নাকি দূর্গাপুজোর ক্ষেত্রে, পুরষ্কারপ্রাপ্তিও হয় প্রচুর।

এই বিষয়ে অনেকেরই বিরুপ ধারনা পোষণ করেন। অনেকেই মনে করেন যে হিন্দু উৎসব গুলো অপচয়ের এক উপলক্ষ মাত্র। এই ক্ষেত্রে আমি আমার নানা দেশের মুসলমান ও খ্রিস্টান বন্ধুদের সাথে একমত হতে বাধ্য হয়ে পড়ি। আমার সেই লেবাননের বন্ধুকে যখন আমাদের বিজয়া সম্মেলনীর আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম, সে আমায় বলেছিল যে তার এই ধরনের এত ঢাকঢোল পিটিয়ে উৎসব নাকি পছন্দ নয়। ভাবলাম একবার ওর দেশে হওয়া ওর সেই পছন্দের ক্রাউডফান্ডিং এর দ্বারা রেভ পার্টি গুলোর ব্যাপারে জিগ্যেস করি, কিন্তু ছেড়ে দিলাম!

সেই ছেলে আজ বলছে আমার জন্য “মুজাদ্দারা” বানিয়ে আনবে। মুজাদ্দারা হচ্ছে ইরাক এবং লেবাননের এক অতি জনপ্রিয় খিচুড়ি জাতীয় খাদ্য। আমি ভাবছি কাকতালীয়ভাবে লক্ষ্মী পুজোর দিনেই ওর হঠাৎ খিচুড়ি বানানোর ইচ্ছা হলো! আমার তো ভাগ্য খুলে গেল মনে হচ্ছে! লক্ষ্মী পুজোর দিন আমার পরিবারগন দেশ থেকে ঘরে লুচি ভাজা আর অঞ্জলির ছবি পাঠাচ্ছে, আর আমি লেবাননের খিচুড়ি খাচ্ছি। যদ্দেশে যদাচার শুনেছিলাম, এখানে আমি নানা আঞ্চলিক বিরিয়ানি আর খিচুড়ি খেয়ে বেড়াচ্ছি! কলকাতার কথা মনে পড়লে আমাদের নতুন বাংলাদেশী কলিগ রাশিদ(নাম পরিবর্তিত) দুর্দান্ত গায়ক, হঠাৎ করে কখনো ইচ্ছে মতো কোনো বাউল গান অথবা উস্তাদ রাহাত ফাতেহ আলি খানের গান গেয়ে ওঠে কিচেনের মধ্যে!

তবুও এবার একটা কথা ভেবেই একটু আনন্দ পাচ্ছি, যে এইবার আমার বাকি সমস্ত বন্ধু আর ভাইবোন তেমন কেউ পুজোয় ঘরে ফেরার কথা জিগ্যেস করলো না। কারন এইবার দেখা যাচ্ছে সকলেই বাইরে, কলকাতায় আর কেউ বাকি নেই! চাকরি আর পড়াশোনার আশায় কলকাতা ছাড়তে বাধ্য হওয়া আমার মতো আমার সমস্ত বন্ধুবান্ধব যেন আর শহরটিকে মনে করতেও চাইছে না। দূর্গাপুজোই হোক কি আলুর চপ রসগোল্লা হোক, কোনো কিছুই আর চাকরি এবং বাকি সমস্ত সুযোগ হারিয়ে ফেলার অভিমান ছাপিয়ে যেতে পারছে না। শহরটার প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা যেন এই নতুন অভিমানের সাথে পেরে উঠছে না।

Leave a comment
scroll to top