সৌদির চিঠি; জুম্মায় এক অভাবনীয় কান্ড ঘটে গেল! পর্ব-৩
আরও একজন পালিয়ে গেল! মে মাসের শেষ সপ্তাহে, একদিন ডিউটি গিয়ে দেখছি আসানসোলের একটা ছেলে সাদিক (নাম পরিবর্তিত) আসেনি। কাজ ভালো লাগছিলো না, সিনিয়র শেফদের ঝামেলা ও আর পোহাতে পারছিলোনা, তাই পলায়ন।
আমরা এই নিয়ে আলোচনা করতে বসে ওর বোকামি নিয়ে গালাগালি না করে পারলাম না। সবাই ভাবছিলাম যে কোম্পানি যেখানে যখন যাকে ইচ্ছা তাড়িয়ে দিচ্ছে, সেখানে যদি ও পালিয়ে না গিয়ে কোম্পানির হাতেই ফায়ার হতো তাহলে বরং বেশি লাভ হতো।
কোম্পানি ফায়ার করলে কিছু অন্তত পারিশ্রমিক হিসেব মেটাতে বাধ্য, এবং সেই কর্মীর এজেন্সি তাকে সঙ্গে সঙ্গে অন্য আরেক জায়গায় কাজে লাগিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু কর্মী নিজে যদি না জানিয়ে পালায়, তাহলে হিসেব তো দূর, বাকি মাইনে টাও তো পাবে না। এরকম বোকামি করার কি কারন থাকতে পারে?
এমন কি চাপ সৃষ্টি হয়েছিল ওর ওপর যে ওকে এভাবে পালাতেই হলো? সাদিক ওর আগের কোম্পানিতেও ঝামেলা করেই বেরিয়ে এসেছিল। ওরা ৫-৬ জন ভারতীয় কর্মী সৌদির রাজধানী রিয়াধ শহরে আগে যেই রেস্টুরেন্টে কাজ করত সেখানে মাইনে সময় মত না পাওয়ার অভিযোগে কাজে হরতাল ডেকেছিল। সেই কারণে কোম্পানি এতটুকু বিচলিত না হয়ে ওদের এজেন্সি কে জানিয়ে দিল যেন ওদের ফেরত নিয়ে নেয়, কোম্পানি ওদের কোনও সাহায্য করবে না।
এজেন্সি নিজের সুযোগ বুঝে নিয়ে সাদিক দের নির্দেশ করে ওরা যেন রিয়াদ থেকে সব বাক্স-প্যাঁটড়া গুছিয়ে শিগগিরই জেড্ডা পাড়ি দেয়, নতুন জায়গা, অর্থাৎ আমাদের এই কোম্পানি তে যোগ দিতে। আর ঠিক যেমন আশা ছিল, নিজেদের খরচেই তা করতে হবে, এজেন্সি কোনোরকম সাহায্য করবে না। হয় নিজের যেটুকু জমেছিল তা নিয়ে যাত্রা করো, না হলে রিয়াধের রাস্তায় বুঝে নাও। দুই সন্তানের বাপ সাদিক প্রায় ৬ বছর হতে চললো মিডল ইস্টে কর্মরত, ওই একই উদ্দেশ্য নিয়ে – “আরেকটু বেশি আয় হবে..”।
এই সাদিক আমাকে ওর সব পুরোনো অভিজ্ঞতা শোনাতো। এর আগে প্রায় এক বছর, ২০২২ সাল টা রিয়াধে কাজ করেছিল, তার আগে, কোভিডের আগে দুবাইতে প্রায় দুবছর নির্মাণ কাজে নিযুক্ত ছিল। ইলেকট্রিক্যাল ওয়ায়েরিং-এর কাজ থেকে শুরু করে সিমেন্টের বস্তা তোলা, সবই মোটামুটি করতে হতো। সেইখানে ভারি কাজ থাকলেও এখানকার মত ঝামেলা নাকি ছিল না, অপ্রয়োজনে ওভারটাইম করতে হতো না, করলেও হিসেব পাওয়া যেত। মাইনে অনেক কম যদিও, কিন্তু পুষিয়ে নেওয়া যেত। সেখানকার নানা ঘটনা শোনা তো আমায়। একটা উপদেশ দিয়ে গেছিলো আমায় সাদিক – ছুটি যেতে বাধা দিলে কয়েকদিন সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থেকো, পারলে একটা মোটা দেখে দড়ি কিনে এনো! দুদিনে ছুটি অ্যাপ্রুভ হয়ে যাবে।
এই মারাত্মক কথার পেছনে সাদিকের দুবাইয়ের এক অত্যন্ত দুঃখজনক অভিজ্ঞতা আছে। ওদের সাথে এক মিস্তিরি কাজ করতেন, তিনি অনেকদিন ধরে দেশে যাওয়ার ছুটির অনুরোধ করছিলেন, কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছিল না। শেষে, একদিন নিরুপায় হয়ে আর কোনো আশা না পেয়ে চরম পথটাই বেছে নিলেন। যথারীতি হইচই পড়ে গিয়েছিল, কোম্পানি বাধ্য হয়েছিলো তাঁর পরিবার কে ক্ষতিপূরণ দিতে। তাই এই উপায় টা অনেক শ্রমিক শিখে নিয়ে তারা মনে করলেন এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত পথ। এবং সত্যিই নাকি এটা দারুণ কাজ করে দালাল এবং ম্যানেজার দের জন্য। ভাবতেও হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়… এইরকম এক বলিদান দিয়ে যেতে হলো সেই নাম না জানা শ্রমিক বন্ধু কে…
যখন এটা লিখছি, মানে এই সপ্তাহেই ২ তারিখ সন্ধেবেলা এমন এক ঘটনা চাক্ষুষ করলাম, মনটা খারাপ হয়ে গেল। ওদিকে দেশে বালাশ্বরে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনাটা এত দূরে থেকেও আমাদের ঝাঁকিয়ে দিল, তেমনি এখানে আমার স্টাফের সাথে কিছু কিছু ঘটনাও যেন নাড়িয়ে দেয়। আমার কিচেনে এক নেপালি ক্লিনার অমল আমার একটা কাজে একটু সাহায্য করছিল, আমারই রিকোয়েস্টে। ম্যানেজার এসে ওকে টানতে টানতে নিয়ে গেল বাথরুম সাফ করাতে, আর চেঁচাতে থাকলো যে ও এক ক্লিনার, শেফের কাজ করছে কোন সাহসে! চুপ করে অপমান টা হজম করে নিল চেন্নাইতে ৩বছর সিনিয়র কুক হিসেবে কাজ করা অমল। আমারই বয়সী, ওর হাতের কাজ আমার থেকে একশো গুণ ভালো হলেও আরো হাজার হাজার শ্রমিকদের মতো দালাল আর কোম্পানিদের তাচ্ছিল্য, অবহেলা এবং অসভ্যতার শিকার হিসেবে মুখ বুজে রাখলো স্রেফ ওই একটাই কথা ভেবে – “আরেকটু বেশি কামাতে পারবো”…
সৌদির চিঠি, ঘরের থেকে এত দূরে দেশের দুঃসংবাদ এলে শান্ত হয়ে বসে থাকা কঠিন,পর্ব-৫