কথায় আছে, বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। সে ধর্মীয় ছোঁয়াবিহীন বইমেলা বা পয়লা বৈশাখ হোক কিংবা পুরোদস্তুর ধর্মীয় উৎসব যেমন কালীপূজা, দুর্গাপূজা, ঈদ, বড়দিন, প্রভৃতি। বছরের আর কোন উৎসবের সময়ে সাধারণ বাঙালি বা প্রশাসনকে এরকম তটস্থ থাকতে হয়না। আর কোন পার্বণের সময়ে বছর-বছর আচার পালনের নামে এরকম তান্ডবের খবরও আসেনা। ব্যতিক্রম এই একটি – রাম নবমী। ২০১৬ সালের পর থেকে বাংলার মাটিতে এই উৎপাতের আগমন। মূলত একটি বহিরাগত দল ও তাদের বাঙালি শাগরেদদের হাত ধরে ফি বছর দাঙ্গা বাধানোর অপচেষ্টা।
পুলিশ প্রশাসন তাদের কাজ করুক। কিন্তু আসল দায়িত্ব বাংলার সাধারণ মানুষকে নিতে হবে। দাঙ্গাবাজ ও তাদের মদতদাতাদের চিহ্নিত করে জনবিচ্ছিন্ন করতে হবে। এবং সেটা করতে হলে কোনরকম লুকোচুরি নয়, স্পষ্ট কথা স্পষ্ট করেই বলতে হবে।
মনে রাখবেন ২০১৭-র আগেও রিষড়াও ছিল, শিবপুরও ছিল। সেখানকার বিবিধ ধর্মালম্বী মানুষজনও ছিল। সেখানকার মন্দির-মসজিদগুলোও একইভাবে ছিল। যে যার মতন মন্দিরে গেছে, যে যার মতন মসজিদে গেছে। কোথাও দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরী হয়নি। কিন্তু লক্ষ্য করে দেখবেন পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করল ২০১৬র পর থেকে।
২০১৭ থেকে ‘ওরা’ এল।
বাইরে থেকে অর্থ এল। খানিক লোকবল এল। আর এল ‘বিষ’। এই বিষ গলায় ঢালা হয়না। ঢালা হয় মগজে। সহজ নিশানা কিশোর, তরুণ ও যুবকেরা। মিছিলগুলিতে সবচেয়ে উন্মত্ত আচরণ করা অংশটির সিংহভাগ দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা শ্রেণীভুক্ত, যাদের মগজধোলাই করা অপেক্ষাকৃতভাবে সহজ কাজ।
উদাহরণ, সুমিত সাউ নামক যে তরুণটি গ্রেফতার হয়েছে। পিস্তল হাতে নাচাটা যে রামের প্রতি ভক্তি প্রদর্শনের একটি পদ্ধতি হতে পারে এ কথা কোন ধর্মপ্রাণ মানুষ দু:স্বপ্নেও ভাবতে পারবেন? পারবেন না। গরিব ঘরের সন্তান সুমিতকে এই বুদ্ধি তাহলে কে দিল? জীবিকা নির্বাহ করবার জন্য ট্রাকের খালাসির কাজ করা এই তরুণটির ভবিষ্যত কী? যারা তার হাতে পিস্তলটি তুলে দিয়েছিল, রাম নবমীর মিছিলে তাকে পিস্তল হাতে উদ্দাম নেত্য করতে বলেছিল, মগজে ভরে দিয়েছিল বিদ্বেষ বিষ, তারা কেউ সুমিতের পরিবারের আর খোঁজ নেবেন? যদি আদালতে তার সাজা হয়, মেয়াদ শেষে তার সামাজিক পুনর্বাসনের দায়িত্ব নেবেন? উপার্জনের ব্যবস্থা করে দেবেন? কোনোটাই করবেন না। কারণ তারা ইতিমধ্যেই আরেক সুমিতের খোঁজে লেগে পড়েছেন। এবং তিক্ত হলেও সত্যি এটাই যে তারা সেটা পেয়েও যাবেন।
এছাড়াও যে দিকটি নিয়ে আলোচনা না করলেই নয় তা হল ক’দিন ধরে শিবপুর ও রিষড়ায় যা চলল তার পিছনে ফ্যাসিবাদী রাজনীতির ঈন্ধন, যুবসমাজের মস্তিষ্ক প্রক্ষালণ, অশান্তি সৃষ্টির নির্দিষ্ট ছক, বিপুল অর্থ খরচ ইত্যাদি সবই আছে। এবং রয়েছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ আরো একটি কারণ যেটা নিয়ে আলোচনা প্রায় হচ্ছেই না।
জনবিন্যাস। নির্দিষ্ট করে বললে, ভাষিক জনবিন্যাসের বদল।
‘জন’ মানে শুধু একপাল মানুষ নয়। ‘জন’ মানে যৌথ সমষ্টিগত ইতিহাস, ‘জন’ মানে সমষ্টির সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক যাপন। এই ‘জন’ ব্যাপারটা গড়ে ওঠে বহু শতকের ওঠাপড়ার মধ্য দিয়ে। নানা বাঁক, নানা দিকবদলের ফলাফল এই ‘জন’। এবং নিশ্চিতভাবে বলা চলে যে এই সমস্ত কিছুর দৃঢ় ভিত্তিটি হল ভাষা। একটি জনগোষ্ঠীতে কি করে পরপর অতীশ দীপংকর, চৈতন্যদেব, বিদ্যাসাগর জন্মায় তার আংশিক ব্যাখা নিশ্চিতভাবে সেই জনগোষ্ঠীর ভাষার বিবর্তনের ইতিহাসে পাওয়া সম্ভব। ভাষার সঙ্গে সঙ্গেই বিবর্তিত হয় সেই ‘জন’, বিবর্তিত হয় তার সামাজিক রাজনৈতিক দর্শন। আদিম থেকে সভ্যতার দিকে এই যাত্রায় কিছু জাতি এগিয়ে যায়, কিছু পড়ে থাকে বহু পিছনে। যখন সেই বহু পিছিয়ে থাকা ‘জন’রা স্রেফ সংখ্যার জোরে এগিয়ে থাকা জাতিদের ওপর প্রভুত্ব ফলানোর জায়গায় চলে যায়, তখনই ঘটে এহেন ধারাবাহিক দুর্বিপাক।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)