এ যেন কেচ্ছার উৎসব! ২০১২ সালে প্রকাশিত দীপক ঘোষের “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যেমন দেখেছি”বইটি আবার ঝড় তুলেছে প্রকাশের ১১ বছর পর। পশ্চিমবঙ্গের প্রধান বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, লোকসভার বিরোধী দলনেতা কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরী থেকে শুরু করে বাম কর্মী সমর্থকরা ব্যাপক ভাবে এই বইটির প্রচার চালাচ্ছেন। দীর্ঘদিন ধরে বইটি নতুন করে ছাপা না হওয়ায় বাজার থেকে উধাও হলেও, পিডিএফ কপি ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত গতিতে।
এর আগে বেশ কয়েকবার দীপক ঘোষের বইটি আলোচনায় এসেছে। কিন্তু সম্প্রতি সাগরদীঘির উপনির্বাচনে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের বিপর্যয়ের পরে একটি সাংবাদিক সম্মেলনে তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীকে তার মেয়ের আত্মহত্যা সহ বেশ কিছু বিষয়ে ব্যক্তিগত আক্রমণের করলে কংগ্রেস নেতা কৌস্তভ বাগচীও দীপক ঘোষের বইটি নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে বসে যান। যার প্রতিক্রিয়াতে আবার পুলিশ পাঠিয়ে গ্রেফতার করা হয় কৌস্তভকে। ফলত আরো একবার ছড়িয়ে পড়ে বইটির কথা।
মমতা ব্যানার্জির বেশ কিছু একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য ছাড়াও দীপক ঘোষের বইয়ে অনেক জায়গা জুড়ে বিভিন্ন অভিযোগ এবং তথ্য আছে, যেমন-
১৫ পাতায় শাহরুখ খানের বিরুদ্ধে রাজ্যসরকার এবং কলকাতা পৌরসভার কোটি কোটি টাকার কর ফাঁকির অভিযোগ আনা হয়েছে।
১৯ পাতায় প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর বিরুদ্ধে বিধান নগরে অবৈধ ভাবে জমি বন্টনের অভিযোগ আনা হয়েছে।ঘোষ দাবি করেছেন জ্যোতি বসু বেঁচে থাকলে তাকে জেলে থাকতে হত।
২৬ পাতায় প্রবাসী শিল্পপতি প্রসূন মুখার্জির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ এনেছেন ঘোষ।
৩১ পাতায় তিনি বলেছেন বাম আমলের দুর্নীতিগ্রস্ত আমলারা তাদের দুর্নীতির টাকা তৃণমূল কংগ্রেসে বিনিয়োগ করেছিলেন, তার ফলে মমতা তাদের প্রার্থী তালিকায় ঠাঁই দেন, বাদ দিতে পারেন নি।
৩২ পাতায় কংগ্রেস, তৃণমূল এবং সিপিএম বাদে অন্য বাম দলের বিধায়কদের “তৃণমূলের একমাত্র উদীয়মান নেতা” শুভেন্দু অধিকারীকে নেতা নির্বাচিত করার আবেদন জানানো হয়েছে।
৩৬ পাতায় ঘোষ দাবি করেছেন ৯৮ সালের নির্বাচনে তাঁর “বিশেষ অনুরোধেই” মমতা ব্যানার্জি প্রার্থী তালিকা থেকে তাঁর নাম বাদ দিয়ে, আরামবাগ আসনটি বিজেপির জন্য ছেড়ে দেন।
দীপক ঘোষের বইয়ে বলা হয়েছে “তেহেলকা কেলেঙ্কারি”র সময় মমতা ব্যানার্জি নিজের রেল দুর্নীতি ঢাকতে বাজপেয়ী সরকার থেকে পদত্যাগ করেন।
এ ছাড়াও আছে সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় মমতার ব্যানার্জির বিরুদ্ধে খেয়ে দেয়ে অনশনের অভিযোগ।
মমতা ব্যানার্জির নিজস্ব বিবৃতির উপর ভিত্তি করে ঘোষ দেখিয়েছেন যে ১৯৮৪ সালে সিপিএম নেতা সোমনাথ মুখার্জিকে হারিয়ে মমতা যেবার সাংসদ হলেন, সেবার নির্বাচনে দাঁড়াবার বয়স তার ছিলো না। মমতা নির্বাচন কমিশনকে মিথ্যা তথ্য দিয়েছিলেন।
১৯ পাতায় দীপক ঘোষ লিখেছেন ২ বছর কংগ্রেসে কাটিয়েই তার বোঝা হয়ে গেছিলো যে “কংগ্রেস নেতারা প্রায় সবাই তরমুজ”। অর্থাৎ বাইরে সবুজ(কংগ্রেস) ভিতরে লাল(সিপিএম)।তাই মমতা ব্যানার্জির সিপিএম বিরোধী লড়াইয়ের কারণে তিনি মমতার সাথে ছিলেন। কিন্তু যেহেতু ২০১১ সালে সেই কাজ সমাপ্ত হয়, তাই ‘স্বামী বিবেকানন্দের সেই শ্বাশ্বত বাণী ” সত্যের জন্য সব কিছুকে ত্যাগ করা চলে, কিন্তু কোনো কিছুর জন্যেই সত্যকে ত্যাগ করা চলেনা” – মনে প্রাণে বিশ্বাস করেই’ তিনি মমতা ব্যানার্জির কাছ থেকে সরে এসেছেন।
যদিও ৩১ পাতায় তিনি তার নির্দিষ্ট বিরোধের কথা জানিয়ে দিয়েছেন। ঘোষ লিখেছেন “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাকে চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকের মত ঝেড়ে ফেললেন। প্রথমে তিনি ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ডায়মন্ড হারবার আসনটি থেকে আমার নাম ঘোষণা করেন এবং তার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঐদিন সন্ধ্যেতে বলেন যে প্রার্থী তালিকায় প্রার্থীর নামটা “ছাপার ভুল” হয়েছে, আসলে প্রার্থীর নাম দীপক “ঘোষ” নয়, দীপক “হালদার”, তিনি একজন যুব নেতা।
মমতা ব্যানার্জির একান্ত ব্যক্তিগত তথ্যগুলো বাদ দিলেও বইটিতে এমন কিছু তথ্য আছে যা ভারতের রাজনীতি বা ইতিহাসের ছাত্রদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারতো। যদিও দীপক ঘোষ অসংখ্য দাবি করলেও বা দাবির পক্ষে বইটিতে গাদাগুচ্ছের নথি হাজির করলেও, নথিগুলো আবশ্যিক ভাবে দীপক ঘোষের অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ করেনা বা কার্যকারণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে না। অবশ্য যেসকল পাঠক তথ্য প্রমানের যাচাই পদ্ধতি নিয়ে অবগত নয়, তারা গোটা বই জুড়ে ফটো কপির বাহুল্য দেখে চমকে যাবেন সেটাই স্বাভাবিক।
বর্তমানে টানা তিন দফা সরকার চালানো মমতা ব্যানার্জির বিরুদ্ধে অভিযোগের অভাব নেই। কৃষিনীতি, শিল্পনীতি, শিক্ষা, দুর্নীতি, বেকারত্ব ইত্যাদি বাস্তব ইস্যুর অভাব নেই রাজ্যে। বেশ কিছু ইস্যু নিয়ে আন্দোলন গড়ারও চেষ্টা চালিয়েছে বিরোধীরা। তবে ব্যাপক সাফল্য এসেছে সে কথা বলা যাবেনা, অন্তত ভোটের নিরিখে। প্রশ্ন জাগে তবে কি এবার দীপক ঘোষের বইয়ে লেখা ব্যাক্তিগত কেচ্ছা নিয়েই আবর্তিত হবে বাংলার রাজনীতি?
মার্কসের ব্যক্তির থেকে সামাজিক কাঠামোকে বা ব্যক্তির থেকে তার চিন্তাকে বা তার সামাজিক অবদানকে গুরুত্ব দেওয়ার দর্শন, দীর্ঘদিনের বাম প্রভাবের মধ্যে দিয়ে বাংলায় একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল। ব্যক্তি কুৎসার ঘটনা ঘটলেও তা ছিলো বিচ্ছিন্ন। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের দিন সকালের খবরের কাগজের ভিতরে যাদবপুর লোক সভা কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী কবীর সুমনের কেচ্ছার বিবরণ সহ একটি বেনামি লিফলেট বিতরণ করা হয়। তাতে কবীর সুমনের বিপুল ভোটে জিততে কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু এবার সরাসরি রাজনৈতিক পদাধিকারীদের সাংবাদিক সম্মেলন করে কেচ্ছা যুদ্ধ অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ।
দীর্ঘ দিন ব্যক্তিগত আক্রমনকে নিচু নজরে দেখা হত বাঙালি সমাজে।এই রাজনৈতিক সংস্কৃতিটাও কি ধ্বংসের মুখে? নির্বাচনের সময় প্রার্থীর ছবি দেওয়া বিশাল কাট আউট যেমন বামপন্থীরা খুব সম্প্রতি গ্রহণ করেছে, তেমনি দীপক ঘোষের বইয়ে মমতার ব্যক্তিগত কেচ্ছা নিয়ে অতিরিক্ত মাতামাতি বাংলার রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলের ইঙ্গিত কীনা সেটাই দেখার।