গৃহস্থ বাড়ির বয়ঃজ্যেষ্ঠ মানুষেরা চিরকালই লাগামহীন বেহিসাবি খরচ করা নিয়ে বাড়ির কনিষ্ঠদের সাবধান করে দিয়ে থাকেন। সাধ্যের চেয়েও বেশি খরচ করার তাগিদ থাকলে যে দেনার অঙ্ক বেড়ে যায় আর তাতে যে সর্বনাশ হয় পরিবারের সে কথা প্রাচ্যের এই বয়ঃজ্যেষ্ঠ মানুষগুলো চিরকালই বলে থাকেন। যাঁরা এই উপদেশ অবহেলা করে, তাঁদের আর্থিক সর্বনাশ হয়, বনেদিয়ানা ধুলায় মিশে যায়। এহেন উপদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃদ্ধ রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন নিজের বয়ঃজ্যেষ্ঠদের থেকে শোনেননি তেমনটা নয়, তবে তিনি তা অবহেলা করেছেন এবং তার ফলে মার্কিন মুলুকের ঘটি-বাটি বিক্রি করার মতন পরিস্থিতি হয়েছে সেটা আজ স্পষ্ট হয়েছে কারণ যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের রুশ-বিরোধী যুদ্ধে অর্থের যোগান দিতে ব্যর্থ হচ্ছে নিজ আর্থিক সঙ্কটের কারণে।
সংবাদে প্রকাশ যে যদি মার্কিন কংগ্রেস অতিরিক্ত অর্থের মঞ্জুরি না দেয়, তাহলে এই মাসের—ডিসেম্বর ২০২৩—শেষে ইউক্রেনের রুশ-বিরোধী যুদ্ধ চালানোর জন্যে আরও অর্থ দিতে অপারগ হবে যুক্তরাষ্ট্র। ইউক্রেন যুদ্ধে মার্কিন আর্থিক মদদ একটা বড় ভূমিকা পালন করেছে এবং মার্কিন কংগ্রেসে রিপাবলিকানদের তীব্র বিরোধিতার কারণে বাইডেন আরও অর্থের সংস্থান করতে ব্যর্থ হচ্ছেন।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যখন রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে একটি বিশেষ সামরিক অভিযানের ঘোষণা করেন সেই সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রে রাষ্ট্রীয় ও পশ্চিমাদের মদদে জাঁকিয়ে বসা ফ্যাসিবাদী শক্তিকে উচ্ছেদ ও নির্মূল করার জন্যে, তখন ফ্যাসিবাদী শক্তিকে রক্ষার স্বার্থে ও রাশিয়ার উপর আঘাত হানার জন্যে যুক্তরাষ্ট্র ও সমগ্র পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনের নয়া-নাৎসি শক্তির পক্ষে দাঁড়ায়।
গত ১৯ মাসে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৪০০০ কোটি মার্কিন ডলার ইউক্রেন কে সামরিক সহায়তা খাতে দান করেছে। কিন্তু এত অর্থ আর সামরিক সরঞ্জাম পেয়েও রুশ সামরিক শক্তির সামনে দাঁড়াতে অক্ষম ইউক্রেনের নয়া-নাৎসি বাহিনীর ফৌজ। ফলে বারবার নিজের সরকার কে বাঁচাতে আর এই যুদ্ধ কে দীর্ঘায়িত করার জন্যে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির জেলেনস্কি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের কাছে অর্থ দাবি করে চলেছেন। আর ইউক্রেনের রুশ-বিরোধী যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে নিজেদের মস্কোর বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধ চালানোর স্বার্থে পশ্চিমারাও এই অর্থের যোগান দিয়ে এসেছে। কিন্তু এত খরচের পরেও হাতে রয়েছে পেন্সিল!
জেলেনস্কির ক্রমাগত দাবি সত্ত্বেও ইউক্রেনের রুশ-বিরোধী যুদ্ধে বেশি লগ্নি করার পথে বেশ কয়েকটি বড় বাঁধার সম্মুখীন হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আর এই বাঁধাগুলোর ফলেই ক্রমেই অসম্ভব হয়ে উঠছে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ইউক্রেনের রুশ-বিরোধী যুদ্ধের মতন একটি লোকসানজনক ব্যবসা কে টিকিয়ে রাখা।
প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইউক্রেনের রুশ-বিরোধী যুদ্ধ কে আর্থিক মদদ দেওয়ার ক্ষেত্রে সব চেয়ে বড় বাঁধা হল ঘরোয়া অর্থনীতির ভাঁড়ের মা ভবানী দশা। বেশ কয়েক দফায় মার্কিন কংগ্রেসে বাইডেনের ডেমোক্র্যাটরা ও বিরোধী রিপাবলিকানরা দেশের আর্থিক অনটন নিয়ে গোঁতাগুঁতি করেছেন। বেশ কয়েক দফায় মার্কিন কংগ্রেসের থেকে ঋণ নেওয়ার উর্দ্ধসীমা বাড়াবার জন্যে রীতিমতো সবার হাতেপায়ে পড়তে হয়েছে বাইডেনের আধিকারিকদের। আর এই ঋণ নেওয়া হচ্ছে মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ থেকে, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক খরচ মেটানোর জন্যে – যার মধ্যে ইউক্রেনের রুশ-বিরোধী যুদ্ধও পড়ে। কিন্তু এই অর্থ ফেডারেল রিজার্ভ কোথা থেকে জোগাড় করছে?
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ এই অর্থের যোগান দিচ্ছে ডলার এর নোট ছাপিয়ে, কৃত্রিম ভাবে অর্থ বৃদ্ধি করে যা কিন্তু যে কোনো সময়ে বিস্ফোরিত হয়ে একটি বড় আর্থিক সঙ্কটের, ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতির জন্ম দিতে পারে। যেহেতু আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ডলারের আধিপত্য রয়েছে তাই নিজ দেশে মুদ্রাস্ফীতি কে কৃত্রিম ভাবে দাবিয়ে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু যুদ্ধের পর যুদ্ধ চালানোর জন্যে কী ভাবে আর কতদিন পর্যন্ত এই অবশ্যম্ভাবি সঙ্কট কে ঠেকা দিয়ে রাখতে পারবে ডেমোক্র্যাটদের সরকার সেই প্রশ্ন মার্কিন মুলুকের ভিতরেও উঠছে।
দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তিগুলো ভেবেছিল যে ইউক্রেনের রুশ-বিরোধী যুদ্ধ কে আর্থিক সহায়তা দিয়ে আর মস্কোর উপর নিষেধাজ্ঞার পাহাড় চাপিয়ে রুশ অর্থনীতিকে ধ্বংস করে ফেলা যাবে। সে আশা গুড়ে বালি হয়েছে। রুশ অর্থনীতি পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে তরতর করে বৃদ্ধি পেয়েছে দক্ষিণ গোলার্ধের সাথে বাণিজ্য সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে। সেই তুলনায় মার্কিন ও পশ্চিমা অর্থনীতি কিন্তু সঙ্কটে ফেঁসেছে, বৃহৎ পশ্চিমা লগ্নি পুঁজির প্রতিষ্ঠানগুলো দেউলিয়া হওয়া শুরু হয়েছে। ফলে কতদিন ধরে ইউক্রেনকে কোটি কোটি ডলার দিয়ে নিজের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি করতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র সেই নিয়ে সে দেশের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যেই বিরোধ তীব্র হয়েছে।
তৃতীয়ত, একদিকে যখন জেলেনস্কি ইউক্রেনের রুশ-বিরোধী যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র কে কোনো রকমের সন্তোষজনক ফলাফল দিতে ব্যর্থ হয়েই চলেছিলেন, বিশেষ করে তাঁর দামামা বাজিয়ে ঘোষণা করা পাল্টা-আক্রমনাত্মক অভিযান ফ্লপ করে ও তাঁর মুখ পুড়ে যায়, তখনই অন্যদিকে, ইজরায়েলের দখলদারির বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের আক্রমণের কারণে পশ্চিমা বিশ্ব নড়েচড়ে বসে। তড়িঘড়ি যুক্তরাষ্ট্র জায়নবাদী শক্তিকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দেয়। ঠিক একই ভাবে পশ্চিমা বিশ্বও ইজরায়েলের পক্ষে দাঁড়ায় ও ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ডে গণহত্যা চালাতে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকার কে মদদ দেয়। এর ফলে মার্কিন কোষাগারে বাড়তি যে চাপ পড়ে, তবুও যুক্তরাষ্ট্রের দলমত নির্বিশেষে সমস্ত রাজনীতিবিদেরা ইজরায়েলের জন্যে ১৪,৫০০ কোটি মার্কিন ডলার অনুমোদন করে। স্বাভাবিক ভাবেই সেটাও ডলার ছাপিয়েই ফেডারেল রিজার্ভ কে দিতে হবে।
এই তিনটি কারণে, ও বিশেষ করে ইজরায়েলের বাড়তি বোঝা নিজের ঘাড়ে নেওয়ার ফলে চাপে পড়েছেন বাইডেন। ইউক্রেনের রুশ-বিরোধী যুদ্ধ কে আর্থিক সহযোগিতা সহ জাতীয় সুরক্ষার নানা খাতে বাড়তি ১০,৫০০ কোটি মার্কিন ডলার খরচের অনুমোদন চেয়েছিল তাঁর সরকার, কিন্তু রিপাবলিকান কংগ্রেস সদস্যরা এই ভাবে ইউক্রেনের রুশ-বিরোধী যুদ্ধ খাতে মার্কিন কোষাগার থেকে অর্থ অপচয় করার ফলাফল নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন ও এই উপরোক্ত অর্থের মধ্যে প্রায় ৬,১০০ কোটি মার্কিন ডলার এর অনুমোদন আটকে রেখেছেন।
ফলে, এই মাসের শেষ পর্যন্ত যদি না আর্থিক বিষয়ে, বিশেষ করে বিদেশে যুদ্ধে অর্থ লগ্নি করার বিষয়ে, ইউক্রেনের রুশ-বিরোধী যুদ্ধ চালানোর জন্যে কোটি কোটি ডলার খয়রাতি দেওয়ার ক্ষেত্রে মার্কিন কংগ্রেসে যদি কোনো ঐক্যমত না তৈরি হয়, তাহলে ইজরায়েল যদিও জরুরী ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের থেকে আর্থিক সহযোগিতা পাবে, চাপে পড়বে কিয়েভ ও জেলেনস্কির সরকার। এই অর্থের উপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ রাখার স্বার্থে জেলেনস্কি ইউক্রেনে মুক্ত ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে দিচ্ছেন না। এখন এই অর্থের প্রবাহ বন্ধ হওয়ার ফলে জেলেনস্কির রাজনৈতিক প্রতিপত্তি যেমন ধাক্কা খাবে, তেমনি রুশ সামরিক অভিযানের ফলে ভঙ্গুর হওয়া পশ্চিমা সামরিক শক্তির দেউলিয়াপনা আরও প্রকট হবে। ফলে, শেষ বিচারে দেখতে গেলে আর্থিক-সামরিক-ভূ-রাজনৈতিক ভাবেই, রাশিয়ার সাথে ছায়া যুদ্ধে ঘটিবাটি বিক্রি হবে যুক্তরাষ্ট্রের। কারণ বা বাইডেন নিষেধ মানেননি।