Close

কোন পথে ভারতের বিদেশনীতি?

বর্তমান ভারতের বিদেশনীতি এক অদ্ভুত সন্ধিক্ষণের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এযাবৎকাল পর্যন্ত যে ভাবে পশ্চিমা শক্তিগুলোর দিকে ভারত ঝুঁকে ছিল, তার থেকে বেরিয়ে অনেক স্বাধীন ভূ-রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছে ভারত।

বর্তমান ভারতের বিদেশনীতি এক অদ্ভুত সন্ধিক্ষণের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এযাবৎকাল পর্যন্ত যে ভাবে পশ্চিমা শক্তিগুলোর দিকে ভারত ঝুঁকে ছিল, তার থেকে বেরিয়ে অনেক স্বাধীন ভূ-রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছে ভারত।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিদেশনীতির কম বেশি সমালোচনা প্রায় সব বিরোধীরাই করে থাকে আর তাঁর দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) আবার এই বিদেশনীতিকেই ভারতের এযাবৎকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিদেশনীতি বলে প্রচার করে থাকে। তবে যে ভাবে পশ্চিমা-ঘেঁষা, মার্কিন-ইজরায়েল জোট সঙ্গী, ও কট্টর ভাবে চীন-বিরোধী একটা ইমেজ নিয়ে মোদী সরকার গঠন হয়েছিল আজ থেকে প্রায় নয় বছর আগে, তার তুলনায় ভারতের বিদেশনীতি এই বিগত দিনগুলোতে ধীরে ধীরে আরও পরিণত হয়েছে, এবং চিরন্তন ভারতের যে জোট নিরপেক্ষ থাকার প্রবণতা, মোদী আমলে, বিশেষ করে বর্তমান বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের আমলে, আশঙ্কা মতন তার পরিবর্তন হয়নি।

সম্প্রতি ১লা ও ২রা মার্চ ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লীতে অবস্থিত রাষ্ট্রপতি ভবনে ভারতের অধ্যক্ষতায় অনুষ্ঠিত হল জি২০ গোষ্ঠীর বিদেশমন্ত্রীদের বৈঠক। রাশিয়া, চীন, ভারত সহ এই বৈঠকে যোগ দেন যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের বিদেশমন্ত্রীরা। 

এই বৈঠকের উদ্বোধনের সময়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী তাঁর ভাষণে বলেন, বিশ্বে বহুপাক্ষিকতাবাদ আজ চরম সঙ্কটগ্রস্ত। তিনি বিশ্বের অসাম্যের জন্যে ও নানাবিধ সঙ্কটের জন্যে পশ্চিমা দেশগুলো কে নাম না করে দায়ী করেন। মোদী বলেন যে যদিও বিদেশমন্ত্রীদের নিজ নিজ দেশের বিদেশনীতি অনুসারে মেরুকরণ হয়ে গেছে, তবুও তিনি আশা রাখেন যে গান্ধী ও বুদ্ধের দেশে তাঁরা মতভেদের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মতৈক্যের ভিত্তি খোঁজার চেষ্টা করবেন। 

কিন্তু মোদীর অনুরোধে কাজ হয়নি। ইউক্রেনে চলমান রাশিয়ার বিশেষ সামরিক অভিযান কে কেন্দ্র করে এমনিতেই বিশ্ব জুড়ে একটি বিশাল মেরুকরণ হয়েছে। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইউরোপ, ব্রিটেন, ক্যানাডা, অস্ট্রেলিয়ার মতন দেশগুলো রয়েছে, অন্যদিকে রাশিয়ার পক্ষে ও এই বিষয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে চীন, ভারত, সহ এশিয়া ও আফ্রিকার বেশির ভাগ দেশগুলো। ফলে জি২০ গোষ্ঠীর বিদেশমন্ত্রীদের বৈঠক রীতিমত কুস্তির আখড়ায় পরিণত হয়।

রাশিয়া নিয়ে, ইউক্রেন নিয়ে যেমন ভারতের নিরপেক্ষতা পশ্চিমা বিশ্বের কাছে কটু মনে হয়েছে, তেমনি চীন নিয়েও ভারতের বিদেশনীতিতে একটি সূক্ষ্ম পরিবর্তন এই জি২০ ও তার পরে কোয়াড এর বৈঠকে দেখা গেছে, যা অনেককে অবাক করে দিতে পারে। 

২০২০ সাল থেকে সীমান্ত সংঘর্ষ নিয়ে ভারত ও চীনের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি ঘটে। কিন্তু তবুও মোদী সরকার চীনের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক কে শেষ করেননি। বরং ২০২১-২২ সালেই ভারতের সাথে চীনের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য রেকর্ড মাত্রা ছুঁয়ে যায়।

জি২০ বৈঠকে চীনের নবনিযুক্ত বিদেশমন্ত্রী কিন গাং এর সঙ্গে বৈঠক হয় জয়শঙ্করের। ভারতের বিদেশমন্ত্রী বলেন যে তিনি কিন কে জানিয়েছেন ভারত-চীন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এখন একটি “অস্বাভাবিক স্তরে” আছে এবং সীমান্ত বিবাদের মীমাংসা হলেই এই দ্বন্দ্ব নিরসন হবে। তবে চীনা বিদেশমন্ত্রী ভারতের সাথে আরও আলোচনা করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। ভারত সাবধানে পা ফেললেও, এই দুই শক্তি কে এক জায়গায় আনতে প্রচেষ্টা শুরু করেছেন ল্যাভরভ, যার স্বীকারোক্তি তিনি রাইসিনা ডায়লগস এ করেন। 

ভারতের বিদেশনীতি চিরকাল চীন বিরোধিতা কে কেন্দ্রে রাখে। যদিও মোদী সরকারের আমলে তার হেরফের হয়নি, কিন্তু ভারত বর্তমানে মার্কিন-নেতৃত্বাধীন চীন-বিরোধী যুদ্ধ অক্ষ কোয়াডের সদস্য। যদিও ভারত সরকার কখনোই কোয়াড কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া বা জাপানের মতন “চীন-বিরোধী” হিসাবে চিহ্নিত করে প্রচার করেনি, বরং সর্বদা এটি কে একটি ‘ভারত-প্রশান্ত’ মহাসাগর অঞ্চলের সুরক্ষা ব্যবস্থা বলে এসেছে, এই গোষ্ঠীতে ভারতের সদস্য হিসাবে থাকা ভারত ও চীনের মধ্যে সম্পর্ক কে ভাল করার ক্ষেত্রে একটি অন্তরায়। 

ভারতের বিদেশনীতি বর্তমানে এই সত্যটিকে স্বীকার করে। তাই, সম্ভবত সমস্ত কোয়াড সদস্য দেশের বিপরীতে হেঁটে ভারত চীনের বিরুদ্ধে কোনো কথা, বা তাইওয়ান স্ট্রেটের উত্তেজনা নিয়ে কোনো কথা কোয়াড-এর প্রস্তাবে বলেনি। এর সাথেই ভারত কিন্তু কোয়াড নিয়ে বেশি উচ্ছাস আগের মতন প্রকাশ করেনি, বরং সন্তর্পণে পা ফেলেছে। 

ইউক্রেনের ঘটনা শিখিয়েছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বদা যুদ্ধের উস্কানি দিলেও সঙ্কটের সময় কারুর সাহায্যে আসবে না। অন্যদিকে ভারতের পুরাতন বন্ধু রাশিয়া সোভিয়েত আমলে, ১৯৭১ সালে, মার্কিন নৌবহর কে রুখতে ভারত কে সরাসরি সহযোগিতা করেছিল। ভারতের সব চেয়ে বড় অস্ত্রের যোগানকারী হল রাশিয়া, এবং বর্তমানে রাশিয়াই ভারতের সর্ববৃহৎ জ্বালানি তেলের যোগানদার। 

আবার রাশিয়া আর চীন বর্তমানে একযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন একমেরুর বিশ্বের জায়গায় বহু মেরুর বিশ্ব দাবি করছে। ভারতও বারবার সেই দাবি করছে, বিশ্বের বুকে কূটনৈতিক ভারসাম্য চাইছে। আর তার ফলে চীনের সাথে বিবাদ জিইয়ে রাখলে ভারতের  দীর্ঘকালীন কোনো লাভ হবে না। আর ভারত ও চীনের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে পারে একমাত্র রাশিয়া, যার সাথে দুই পক্ষেরই সম্পর্ক ভাল আছে। আর এইবার রাইসিনা ডায়ালগস চলাকালীন ল্যাভরভ সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন। 

একবিংশ শতাব্দীতে পুরানো বিবাদ কে মিটিয়ে যৌথ ভাবে উন্নয়ন, সুরক্ষা ও প্রগতির দিকে এগিয়ে যাওয়া ভারত ও চীনের জন্যে জরুরী। বিশ্ব জুড়ে যে নয়া  বহুপাক্ষিক ব্যবস্থার কথা বলা হচ্ছে, ভারত, চীন, রাশিয়া বা অন্যান্য উদীয়মান শক্তিগুলো, একসাথে যোগ না দিলে তার বাস্তবায়ন হবে না। ভারতের বিদেশনীতি কে নিজের ভূরাজনৈতিক স্বার্থেই পুরানো দৃষ্টিভঙ্গী ত্যাগ করতে হবে। মোদী আমলে এই পরিবর্তন কতটা হয় সেটাই দেখার। 

ইস্ট পোস্ট বাংলার সম্পাদকীয় কলামে এই পত্রিকার সম্পাদকীয় মতামত প্রকাশিত হয়।

Leave a comment
scroll to top