বিশ্বে ২০২০ সালের করোনা অতিমারীর পরে অর্জন করা নতুন সম্পদের প্রায় এক তৃতীয়াংশই দখল করেছে শীর্ষ ১% ধনী ব্যক্তিরা। নতুন এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে অক্সফাম। সোমবার, ১৬ই জানুয়ারি সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (WEF) বার্ষিক বৈঠকের সাথে মিল রেখে “Survival of the Richest” (অতিধনীদের অব্যাহত অস্তিত্ব) নামক এই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়।
এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে গোটা বিশ্বে অর্জন করা ২৬ লক্ষ কোটি মার্কিন ডলারের ৬৩%, বা দুই-তৃতীয়াংশই, রয়েছে বিশ্বের শীর্ষ ১% ধনকুবেরদের দখলে। অন্যদিকে, একই সময়ে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার বাকি ৯৯% মানুষের অর্জিত সম্পদের পরিমাণ হল ১৬ লক্ষ কোটি মার্কিন ডলার, অর্থাৎ ৩৭%, যার তুলনায় ওই ১% ধনীর অর্জিত সম্পদের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ।
প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে যে পৃথিবীর বিলিয়নেয়ার সম্পদ প্রতিদিন ২.৭ লক্ষ কোটি মার্কিন ডলার করে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যেখানে কমপক্ষে ১৭০ কোটি শ্রমজীবী মানুষ বর্তমানে এমন সব দেশে বাস করছেন যেখানে মুদ্রাস্ফীতি অনায়সে মজুরিকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বলা হয়েছে বিশ্বের ১০% জনসংখ্যা, প্রায় ৮২ কোটি মানুষ, ক্ষুদিত হয়ে জীবন কাটাচ্ছেন। নারীরা বিশ্বের এই অভুক্ত জনসংখ্যার ৬০% বলেও জানিয়েছে সংস্থাটির প্রতিবেদন।
একই সময়ে, বিশ্বের বিলিয়নেয়ার ধনকুবেরদের অর্ধেক এমন দেশে বাস করে যেখানে তাদের সরাসরি বংশধরদের জন্য কোন উত্তরাধিকার ট্যাক্স নেই। অক্সফাম বলছে, এই ধনকুবেররা তাদের উত্তরাধিকারীদের কাছে ৫ লক্ষ কোটি ডলার রেখে যাওয়ার পথে রয়েছে, যা আফ্রিকার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) থেকেও বেশি।
প্রতিবেদনটিতে দেখানো হয়েছে যে ২০২২-এ ধনকুবেরদের সম্পদের পরিমাণ খাদ্য পণ্য ও জ্বালানির মুনাফা বৃদ্ধির কারণে বেড়েছে হুহু করে। বলা হয়েছে ৯৫টি খাদ্য ও জ্বালানি কোম্পানি ২০২২ সালে দ্বিগুন মুনাফা আয় করে। তাদের মোট মুনাফার পরিমাণ হল ৩০,৬০০ কোটি মার্কিন ডলার, যার থেকে তারা ২৫,৭০০ কোটি ডলার অতি-ধনী শেয়ার হোল্ডারদের ভাগ দিয়েছে।
ওয়ালমার্টের অর্ধেকের উপর শেয়ারের মালিক ওয়াল্টন পরিবার ২০২১ এর তুলনায় ৮৫০ কোটি ডলার বেশি আয় করেছে। ভারতের শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত বিশ্বের দ্বিতীয় ধনী ব্যক্তি গৌতম আদানির সম্পদ ২০২২ সালে প্রায় ৪,২০০ কোটি মার্কিন ডলার বৃদ্ধি পেয়েছে।
বৃহৎ কর্পোরেট ও ধনকুবেরদের বিশ্বের নয়া-উদারনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় গত চার দশক ধরে যে ভাবে কর ছাড় দেওয়া হচ্ছে বেশির ভাগ দেশে তার তীব্র সমালোচনা করেছে অক্সফামের এই প্রতিবেদন।
অক্সফাম ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক গ্যাব্রিয়েলা বুচার বলেন, “অতিধনী ও বৃহৎ কর্পোরেশনগুলোর উপর কর চাপানো বর্তমানে অধিগ্রহণ করা সঙ্কটের থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একমাত্র দরজা। এখনই সময় হয়েছে যে আমরা এই মিথটা কে ভেঙে দিই যে অতিধনীদের কর ছাড় দেওয়া হলে তাদের সম্পদ কোনো ভাবে “গড়িয়ে” বাকি সমাজের কাছে পৌঁছোয়। চল্লিশ বছরের অতি-ধনীদের কর ছাড় দেওয়া দেখিয়েছে যে একটা উদীয়মান ঢেউ সব জাহাজ কে ওঠায় না, শুধুমাত্র প্রমোদতরীগুলোকেই ভাসিয়ে দেয়।”
অক্সফামের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের ধনী ও অতি-ধনীদের সম্পদের উপর ৫% কর আরোপ করলে বছরে ১.৭ লক্ষ কোটি মার্কিন ডলার সংগ্রহ করা যাবে, যা বিশ্বের ২০০ কোটি মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনতে যথেষ্ট।
বুচার বলেন, “সাধারণ মানুষ যখন খাদ্যের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য ত্যাগ স্বীকার করছে, তখন অতি-ধনীরা তাদের স্বপ্নকেও ছাড়িয়ে গেছে। মাত্র দুই বছরের মধ্যে, এই দশকটি বিলিয়নেয়ারদের জন্য এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সেরা দশক হতে চলেছে।”
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে বিশ্বের ৭৫% সরকারই ব্যয় সংকোচের পথে হাঁটছে ও তার ফলে তারা রাষ্ট্রীয় খরচে কোপ মারছে, এবং এর ফলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে তারা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে প্রায় ৭.৮ লক্ষ কোটি ডলার বরাদ্দ কমাবে, যার প্রকোপ পড়বে দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষদের উপরে।
সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক সভা, বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করার জন্য ব্যবসায়ী এবং রাজনৈতিক নেতাদের একত্রিত করে।সোমবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত অনুষ্ঠিতব্য এই শীর্ষ সম্মেলনে ৫২ জন রাষ্ট্রপ্রধান এবং প্রায় ৬০০ জন সিইও অংশগ্রহণ করবেন।