Close

বায়রন রসায়ন, নওশাদ ফ্যাক্টর – কোন অঙ্কে সাগরদীঘি জয়?

সাগরদীঘি উপনির্বাচনে বিপুলভাবে জয়লাভ করল বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী বায়রণ। নওশাদ ও অন্যান্য প্রভাব কতটা কাজ করল এই উপনির্বাচনে ?

সাগরদীঘি উপনির্বাচনে বিপুলভাবে জয়লাভ করল বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী বায়রণ। নওশাদ ও অন্যান্য প্রভাব কতটা কাজ করল এই উপনির্বাচনে ?

photo credit - WBPCC facebook page

প্রকৃতপক্ষে দুইজন বিরোধী বিধায়ক পেতে চলেছে রাজ্য বিধানসভা। গত বিধানসভা নির্বাচনে ৭৭টি আসন পেয়ে ভারতীয় জনতা পার্টি বিরোধী আসনে বসলেও (যদিও পরবর্তীতে অনেকেই শাসক দলে যোগ দিয়েছেন), তারা দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারে শাসক দল। সেই হিসেবে নওশাদ সিদ্দিকী ছিলেন রাজ্যের একমাত্র বিরোধী বিধায়ক। দীর্ঘ ৪০দিন পর শর্তাধীন জামিনে নওশাদ জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার দিনেই জানা গেল সাগরদীঘি উপনির্বাচন জিতে বিধানসভায় আসতে চলেছেন আরো এক বিরোধী বিধায়ক বায়রন বিশ্বাস। 

বামেদের ঝুলি এখনো শূন্য হলেও, বামেদের সমর্থনে এই দুই জনই প্রথম বার ভোটে লড়ে জিতেছেন। দুজনেই সংখ্যালঘু। একজন ধর্মগুরু পরিবারের অন্যজন পুঁজিপতি। এই নিয়ে বামেদের মধ্যে কোনো মতাদর্শ গত বিরোধ আছে কিনা জিজ্ঞাসা করা হলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলকাতার এক সিপিআইএম নেতা বলেন “এই নিয়ে ভিতরে অনেক রকম বিতর্ক আছে, আমি সে সব বলতে চাই না। তবে আইএসএফ তাদের রাজনৈতিক কার্যকলাপে ধর্মকে স্থান দেয়নি” যদিও কংগ্রেস প্রার্থী বায়রনকে নিয়ে তার বক্তব্য “তৃণমূল জানে দু দিন পর ঘুরে সে তৃণমূলেই আসবে।”

সিপিআই নেতা প্রবীর দেব বলেন “আইএসএফ কে ধর্মগুরু হিসেবে ব্যাখা করিনা কখনো, কংগ্রেস কখনো বিজেপির সাথে এলায়েন্স করেনি। আমরা সেকুলার পার্টি বলে মনে করি কংগ্রেসকে। জোট হয়েছে আমাদের দুই দিকে দুইজন প্রার্থী জিতেছে। এতে অসুবিধা কী আছে?”

বাম আমলে মুর্শিদাবাদ জেলাকে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধির রঞ্জন চৌধুরীর গড় হিসেবে মনে করা হত। তৃণমূল জমানার শুরুতেই প্রথমে সেই গড়ে ফাটল, পরবর্তীতে গড়টিই ধূলিসাৎ হয়ে যায়। গত বিধানসভায় মুর্শিদাবাদে একটিও আসনে কোনো বিরোধী প্রার্থী জেতেনি। সেই জেলাতেই সাগরদিঘী উপনির্বাচনে কোন রসায়নে জয় লাভ করলো কংগ্রেসের বায়রন ?

সাগরদিঘী উপনির্বাচনে এবারে ৮৭,৬৬৭টি ভোট, মোট ভোটের ৪৭.৩৫% পেয়েছেন বায়রন বিশ্বাস।  তৃণমূল প্রার্থী দেবাশিষ ব্যানার্জি ৬৪,৬৮১টি ভোট, মোট ভোটের  ৩৪.৯৪% পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছে। বিজেপি প্রার্থী দিলীপ সাহা ২৫,৮১৫টি ভোট , অর্থাৎ ১৩.৯৪ % ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন। তৃণমূল প্রার্থীর থেকে ২২৯৬৮ ভোটের ব্যবধানে জিত বায়রনের।

মাত্র দুই বছর আগে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রেই বিজয়ী তৃণমূল প্রার্থী সুব্রত সাহা পেয়েছিলেন ৯৪,৮৮০-টি ভোট যা মোট ভোটের ৫০.৯৫%। দ্বিতীয় হয়েছিলেন বিজেপি প্রার্থী খাতুন মাফুজা, পেয়েছিলেন ৪৪,৬৯২টি ভোট, যা মোট ভোটের ২৪.০৮,%। বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী শেখ এম হাসানুজ্জামান ৩৬,০৫৫টি ভোট, মোট ভোটের ১৯.৪৫% পেয়ে হয়েছিলেন তৃতীয়। 

গত বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় সাগরদীঘি কেন্দ্রের এবারের উপনির্বাচনে ৩০,১৯৯টি ভোট কমেছে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলের। ১৮,৮৭৭টি ভোট কমেছে কেন্দ্রীয় সরকারে শাসক দল বিজেপির। ৫১,৬১২টি ভোট বাড়িয়েছে বাম-কং জোট। দেখা যাচ্ছে তৃনমুল এবং বিজেপির যত সংখ্যক ভোট কমেছে, তার যোগ ফলের থেকে ২৫৩৬টি ভোট বেশী পেয়েছে বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী বায়রন।  

 উত্তর মুর্শিদাবাদের বিজেপির জেলা সহ সভাপতি মিলন ঘোষ ইস্ট পোস্ট বাংলাকে বলেন “এই যে শাসক দল, তার শাসন ব্যাবস্থা থেকে মানুষ মুক্তি পেতে চাইছে। বিজেপি হয়ত বিরোধী দল কিন্তু মানুষ বিকল্প হিসেবে কংগ্রেসকে বেছে নিয়েছে। বিজেপির যেরকম সংগঠন থাকার কথা তার থেকে বিশেষ কিছু উন্নতি হবে বা আগের বারের থেকে ভালো কিছু হবে, এরকম হয়ত মানুষ আশা করেনি।” তিনি আরো বলেন “আমরা মানুষের সাথে সাক্ষাৎকারে দেখেছি, এখানে তৃণমূলের ব্লক সভাপতি হলেন দেবাশীষ বাবু, তাকেই আবার প্রাথী! এটা এখানকার মানুষ ঠিক ভাবে মেনে নেয়নি। অনুরূপ ভাবে বিজেপির যে লড়াই দেওয়ার কথা, বিজেপি চেষ্টা করেছে, কিন্তু (বিজেপি) মানুষের মন পরিবর্তন করতে পারেনি, মানুষের মনের ভেতর ঢুকতেও পারেনি।..” 

২০২১ সালের নির্বাচনে বিজেপি সাগরদীঘিতে মুসলিম প্রার্থী খাতুন মাফুজাকে দাঁড় করিয়ে যা ভোট পেয়েছিলো, ২০২৩ সালে উপ নির্বাচনে হিন্দু প্রার্থী দাঁড় করিয়ে তার থেকে ১৮৭৭৭টি ভোট কম পেয়ে তৃতীয় হয়েছে। এই প্রসঙ্গে বিজেপি নেতা বলেন ” সাগরদীঘিতে ৩৪-৩৬% হিন্দু ভোটার বাকি ৬৪% মত মুসলিম ভোটার। আমরা ওখানকার মাইনরিটির কাছ থেকে যা শুনতে পেয়েছি তা হল যদি একজন মাইনরিটি দাঁড়াত,  তাহলে হয়তো অন্য ভাবে ভোটটা হত। কিন্তু শাসক দল এবং বিজেপি মাইনরিটি প্রার্থী না দেওয়ায় ভোটটা একদিকে পোলারাইজড হয়ে গেছে।”

সিপিআইএম এর জেলা সভাপতি জামির মোল্লা মনে করেন রুজি রুটির বাস্তব সমস্যা এবং ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতিকে মানুষ প্রত্যাখ্যান করার জন্যেই বায়রন জয়ী হয়েছেন। জামির মোল্লা আমাদের বলেন  “পেটের জ্বালা বড় জ্বালা, এর নীতি মানুষ মারা নীতি, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, দূর্নীতি, বিভাজনের রাজনীতি। তৃণমূল আর বিজেপি যে এক, এটা তাদের কাজে প্রমানিত হচ্ছে। সংখ্যালঘুদের উন্নয়নের জন্য যে ভুরি ভুরি প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিলো, সেই প্রতিশ্রুতি এরা রক্ষা করতে পারছে না।আদিবাসী এলাকার ভোট বিজেপির কাছে গিয়েছিল। রাম নিয়ে ওরা রাজনীতি করে, রামের প্রতীক তির ধনুক, এগুলো বোঝানো হয়েছিলো। কিন্তু মানুষ আর ফাঁদে পা দেয়নি। মানুষ বুঝেছে এরা বিভাজনের রাজনীতি করে আমাদের ঠকাচ্ছে।”

মূর্শিদাবাদের সাংবাদিক মীর রাকেশ রৌশানের পর্যবেক্ষণে অনেক গুলো উপাদান বায়রনের জয়ে কাজ করেছে। মীর আমাদের বলেন “বাম কংগ্রেসের রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরেও, সাগরদিঘী থেকে ফারাক্কা পর্যন্ত ওদের (বায়রন) একটা প্রভাব আছে। ওদের প্রচুর ইন্সটিটিউশন চলে, এগুলো বায়রন বিশ্বাস দেখে। ভোটের আগে নওশাদকে যা করলো, তারও কিছুটা প্রভাব পড়েছে… সিপিআইএম কংগ্রেস উচ্চপর্যায়ে জোট করলেও দেখা যায় নিচের তলায় কোথাও জোট মানে, কোথাও মানে না। এবার নিচের তলায় বাম কংগ্রেসের জোট হয়ে গেছে। সিপিআইএম এবং কংগ্রেসের মধ্যে মুর্শিদাবাদে এই মুহূর্তে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। যেটা আগে ছিলো, সেই দ্বন্দ্ব মিটে গেছে। এটা একটা এডভান্টেজের জায়গা।… চাকরির ক্ষেত্রে এবং পঞ্চায়েতের স্তরে যে সমস্ত দুর্নীতি হয়েছে তাতে মানুষ বিধ্বস্ত। মানুষ একটা প্রতিবাদ তৈরি করেছিলো। আমি লক্ষ্য করলাম বহরমপুরে পৌরপিতা নারুগোপালকে মানুষ এলাকায় ঢুকতে দেয়নি। ফলত ওতপ্রতভাবে সাধারণ মানুষ সাড়া দিয়েছেন। এই পক্ষ ঐ পক্ষের বাইরেও তো একটা নিরপেক্ষ সাইড থাকে। এই নিরপেক্ষ সাইডের পুরোটাই কিন্তু জোটের পক্ষে গেছে।… মূলত এর আগে যা দেখেছি সিপিআইএমরা ভোটটা দিয়ে দেয়, তবে কংগ্রেসরা দেয়না।” 

যদিও সিপিআই নেতা প্রবীর দেব কংগ্রেসের ভোট বামে না যাওয়া বা কমিটেড ভোটের তত্ত্ব মানতে নারাজ। তিনি আমাদের বলেন “কংগ্রেসের ভোট বামে যায়না, বামের ভোট কংগ্রেসে যায়, এই তথ্য তোমরা কোথা থেকে পাও? নিশ্চয়ই  এরকম কিছু আছে, কংগ্রেসের কিছু ভোট যেমন লেফটে পড়েনা, তেমনি লেফটেরও কিছু ভোট কংগ্রেসে পড়েনা।মানুষ মানুষের মত করে ভোট দেয়। কংগ্রেসের ভোট বা লেফটের ভোট সেই দিন চলে গেছে। মুষ্টিমেয় কমিটেড যারা আছে, তারা বাদে ভোট মানুষ সাধারণ ভাবে দেয়।”

বায়রন বিশ্বাসের জয়কে রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুমন সেনগুপ্ত এই ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন

“তৃণমূলের দীর্ঘদিনের দুর্নীতি মানুষ দেখতে পাচ্ছে। পাশাপাশি আইএসেফের নওশাদ সিদ্দিকীকে বেশ কিছু বাজে কেস দিয়ে জেলে রেখে দেওয়া, এটাও মানুষ ভালো ভাবে মেনে নেয়নি। আগের বারে নো ভোটটু বিজেপির কারণে হয়তো তৃণমূলকে বেছে নিয়েছিলো। কিন্তু এবার বিজেপির ভয়টা একটু কেটে গেছে। তাই তৃণমূল কে আর ভোট দিতে চায়নি। বিজেপিও সেই ভাবে মেরুকরণ করতে পারেনি।”

আগামী বছর হতে চলেছে লোকসভা নির্বাচন। সাগরদীঘিতে বায়রনের জয়ের কতটা প্রভাব ফেলতে চলেছে সেই নির্বাচনে?

সুমন সেনগুপ্ত বলেন-

 “তবে এটা দেখে লোকসভা ভোটে কি হবে বলা সম্ভব নয়। তখন বিজেপিও মেরুকরণ করবে, তৃণমূলও মেরুকরণ করবে। তবে এটা একটা ইঙ্গিত দেয় যে বিকল্প পেলে মানুষ বিকল্পকে ভোট দেবে।”

অন্যদিকে মীর বলেন সাগরদীঘির মতো “সিপিআইএম কংগ্রেস জোট যদি হয় তবে মুর্শিদাবাদে প্রত্যেক বিধানসভায় জিতবে ওরা। প্রত্যেকটাতেই।”

বায়রনের জয়ের ব্যাপারে মতামত জানতে চেয়ে মুর্শিদাবাদের তৃণমূল কংগ্রেসের জেলা সভাপতি এবং সাংসদ খলিলুর রহমানকে ইস্ট পোস্ট বাংলার তরফে ফোন করা হলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।

লেখক

  • সৌম্য মন্ডল

    সৌম্য মন্ডল একজন আর্থ-সামাজিক এবং ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তিনি ইস্ট পোস্ট বাংলায় মুখ্য সম্পাদক হিসাবে কর্মরত। মূলত উদীয়মান বহু-মেরুর বিশ্বের নানা ঘটনাবলীর তিনি বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করেন।

    View all posts

সৌম্য মন্ডল একজন আর্থ-সামাজিক এবং ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তিনি ইস্ট পোস্ট বাংলায় মুখ্য সম্পাদক হিসাবে কর্মরত। মূলত উদীয়মান বহু-মেরুর বিশ্বের নানা ঘটনাবলীর তিনি বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করেন।

Leave a comment
scroll to top