গোটা দুনিয়াকে অবাক করে ১০ই মার্চ মধ্যপ্রাচ্যের যুযুধান দুই দেশ সৌদি-ইরান হাত মিলিয়েছে চীনের মধ্যস্ততায়। কিন্তু সৌদি-ইরান শুধু নয় ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন এবং সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধরত পক্ষগুলোর মধ্যেও সমস্যা মেটানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে চীন। সৌদি-ইরান সমঝোতা এই প্রক্রিয়ার প্রথম এবং বড় সাফল্য মাত্র – এমনই দাবি করেছেন পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর মিডিল ইস্টার্ন স্টাডিস এর ডিরেক্টর ঊ বিংবিং।
১৩ই মার্চ ভারতের সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়্যারে ঊ বিংবিং এর একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। এই সাক্ষাৎকারে সৌদি-ইরান সমঝোতার গুরুত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে বিংবিং বলেন, এটা একটা বড় অর্জন। আমরা প্যালেস্টাইন এবং ইজরায়েলিদের একে অপরের সাথে আলোচনায় বসার জন্য কিছু ফোরামেরও আয়োজন করেছি। COVID-19 এর আগে, এটি বেইজিং-এ অনুষ্ঠিত হয়েছিলো; এর পরে, এটি অনলাইনে হয়েছিলো। আমরা সিরিয়ার সংঘাতে শান্তি প্রচেষ্টার জন্যও চাপ দিয়েছি। তাই আমি মনে করি এটাই প্রথম বড় অর্জন।
মধ্যপ্রাচ্য দুনিয়ার সবচেয়ে সংঘর্ষপূর্ণ অঞ্চলগুলোর মধ্যে অন্যতম। আরব-ইজরায়েল, শিয়া-সুন্নি, আরব-ইরান, মুসলিম-ইহুদি, অভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধ সহ বিভিন্ন দ্বন্দ্বে দীর্ণ মধ্যপ্রাচ্য। আধিপত্য বজায় রাখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তেল,গ্যাস সমৃদ্ধ এই অঞ্চলটিতে বার বার “ভাগ করো শাসন করো” নীতি প্রয়োগ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কখনো গুপ্তচর মারফৎ বা কখনো সরাসরি সামরিক অভিযানের মধ্যে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নিজের কার্যসিদ্ধি করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রসঙ্গত ইজরায়েল এবং সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র বলে পরিচিত। অন্যদিকে ইরান এবং সিরিয়ার উপর ব্যাপক ভাবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা চাপানো হয়েছে।
ইরান-সৌদি আরব নিজেদের মধ্যে ছায়া যুদ্ধে লিপ্ত, যাকে বিশেষজ্ঞদের অনেকে মধ্যপ্রাচ্যের শীতল যুদ্ধও বলে থাকে। সিরিয়া এবং ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ সহ, বাহরাইন,লেবানন, কাতার, এবং ইরাকে সৌদি-ইরান তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত। এছাড়াও নাইজেরিয়া, পাকিস্তান,আফগানিস্তান এবং পূর্ব আফ্রিকার মতো অন্যান্য অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় সৌদি-ইরান লিপ্ত। সেই ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যে দুই প্রধান প্রতিপক্ষ সৌদি-ইরান সমঝোতা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য বলিষ্ঠ পদক্ষেপ।প্রসঙ্গত গত বছর নভেম্বর মাসের শুরুতে সৌদি আরবে ইরান সামরিক হামলা করতে পারে বলে সাবধান করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিকারিকেরা, টাইমস অব ইজরায়েল খবর করেছিল।
কেন ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন বা সিরিয়ার আগে সৌদি-ইরানের ক্ষেত্রে সাফল্য পাওয়া গেল তার ব্যাখ্যায় বিংবিং বলেন, উদাহরণস্বরুপ সিরিয়ার ক্ষেত্রে অনেক পক্ষ জড়িত। শুধু সিরিয়ার সরকার আর বিদ্রোহীরাই নয়, প্রতিবেশী দেশ আর বৃহৎ শক্তিগুলোও জড়িত। একই ভাবে ইজরায়েল-প্যালেস্তাইনের ক্ষেত্রেও অনেকগুলো পক্ষ জড়িত। এমনকি প্যালেস্তাইনের জনগণের মধ্যেও অনেক উপদল রয়েছে। তাই এই সমস্যা গুলো অনেক জটিল। কিন্তু সৌদি-ইরান মাত্র দুটি পক্ষ হওয়ায়, এই দ্বিপাক্ষিক ইস্যুতে অনেক পক্ষ অংশগ্রহণ করেনি, তাই এ ক্ষেত্রে ভালো ফল পাওয়া গেছে।
প্রসঙ্গত ইজরায়েল প্যালেস্তাইনের দ্বন্দ্বে মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ শিয়া-সুন্নি, আরব-ইরান ভুলে প্যালেস্তাইনের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। ১৯৪৮ সালে ইজরায়েলের প্রতিষ্ঠার সময় থেকে বার বার সংঘর্ষে জড়িয়েছে আরব-ইজরায়েল। মার্কিন মিত্র আরব দেশগুলোও দীর্ঘদিন ইজরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু সম্প্রতি মার্কিন মধ্যস্ততায় প্যালেস্তাইন প্রশ্নে অনড় থেকেও সৌদি, আমিরাতের মত কিছু মার্কিন ঘনিষ্ঠ দেশ ইজরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করছিলো। কিন্তু ইজরায়েলের সাথে তিক্ত শত্রুতার সম্পর্ক রয়ে গেছে ইরানের। ফলত সৌদি-ইরানের এই সমঝোতা ভালোভাবে নেয়নি ইজরায়েলের রাজনীতিবিদরা। টাইমস অফ ইজরায়েল জানাচ্ছে বিরোধী দলনেতা ইয়ার ল্যাপিড বলেছেন যে এটি “ইজরায়েল সরকারের পররাষ্ট্রনীতির পক্ষে বিপদজনক এবং পররাষ্ট্রনীতির সম্পূর্ণ ব্যর্থতাকে দেখায়”
মার্কিনিরা মধ্যপ্রাচ্যে চীনের এই শান্তি প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানানোর বদলে মার্কিন প্রভাবাধীন এলাকায় প্রতিপক্ষ চীনের কূটনৈতিক জয় হিসেবে দেখছে। মার্কিন সংবাদ সংস্থা সিএনএন লিখেছে,শুক্রবারের ঘোষণাটি (সৌদি-ইরান সমঝোতা) উপসাগরীয় অঞ্চলে চীনের জন্য একটি কূটনৈতিক বিজয় যা দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবের অংশ হিসাবে বিবেচিত হয়েছে।
আরেক মার্কিন সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমস মত প্রকাশ করেছে যে সৌদি-ইরান সমঝোতায় চীনের মধ্যস্থতা মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অপাঙক্তেয় করে দিয়েছে। তারা লিখেছে বেইজিং এর মধ্যস্ততায় ইরান এবং সৌদি আরবের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করার স্বার্থে যে বৈঠক হয়েছিলো, তা আপাত ভাবে এটাই সঙ্কেত দিচ্ছে যে ওয়াশিংটনকে অপাঙক্তেয় করে প্রচলিত কূটনৈতিক সম্পর্কগুলি পুনর্গঠন করার চেষ্টা করা হবে।
বিংবিং নিরাপত্তা সম্পর্কে চীনের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করে বলেন “আমরা ব্যাপক নিরাপত্তা এবং সহযোগিতামূলক নিরাপত্তার কথা প্রচার করি। আপনি প্রতিযোগিতার পরিবর্তে সহযোগিতার মাধ্যমে প্রকৃত নিরাপত্তা অর্জন করতে পারেন।” বিংবিং আরো বলেন “আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি স্থাপিত হয় স্থানীয় দেশের চাহিদা, পারস্পরিক সম্মান এবং পারস্পরিক সুবিধার উপর ভিত্তি করে।”
চীনের এই “বিদেশনীতি” এবং “নিরাপত্তা” সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের “সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ”, “শাসন পরিবর্তন”, “নিষেধাজ্ঞা” ইত্যাদির পাল্টা এক বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি হাজির করে। সৌদি-ইরান সমঝোতা যদি অগ্রসর হয় তবে তা ইয়েমেন, সিরিয়া সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছায়া যুদ্ধ বন্ধ করবে।ইরানের বিরুদ্ধে সৌদিকে দলে টানার মার্কিন-ইজরায়েল পরিকল্পনার উপরেও এই সমঝোতা এক বড় ধাক্কা।
এই সমঝোতা হয়তো আগামী দিনে মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক সন্ত্রাস, অস্ত্র প্রতিযোগিতাত ইতি টানবে, হয়তো বন্ধুহীন ইজরায়েলকেও সমঝোতায় আসতে বাধ্য করবে। তবুও পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী গুপ্তচর বাজেট(৮৯৮০ কোটি ডলার,২০২২ আর্থিক বর্ষে) বরাদ্দ করা দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে নতুন সমীকরণ মেনে নেবে নাকি নতুন কোনো পরিকল্পনা হাজির করিবে সেটাই দেখার।