গত শুক্রবার ২২শে সেপ্টেম্বর কানাডার পার্লামেন্টে ভ্লাদিমির জেলেনেস্কির ভাষণের পর, উঠে দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে ৯৮ বছরের ইয়ারোস্লাভ হুনকা-কে সংবর্ধনা জানায় দলমত নির্বিশেষে সমগ্র পার্লামেন্ট। স্পিকার নিজে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেন।
হুনকার বয়ানেই জানা যায় যে তিনি হিটলারের কুখ্যাত অপারেশন বার্বারোসার সময় ওয়াফেন এসএস বাহিনীর ইউক্রেন গালিশিয়া বিভাগে যোগ দেন। একটি ব্লগে নাৎসি বাহিনীর একাধিক ছবিতে নিজেকে চিহ্নিতও করেছেন সগর্বে।
কেলেঙ্কারি!
জেলেনেস্কির ভাষণের পরেই হাউস অফ কমন্সের স্পিকার অ্যান্থনি রোথা নিজের জেলার একজন কানাডিয়ান-ইউক্রেনিয়ান যুদ্ধ নায়ক হিসেবে বর্ষীয়ান নাৎসি হুনকার পরিচয় করিয়ে দেন।
স্পিকার বলেন “আজ আমাদের এখানে চেম্বারে আছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একজন ইউক্রেনীয়-কানাডিয়ান প্রবীণ যিনি রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন এবং আজ তার ৯৮ বছর বয়সেও সৈন্যদের সমর্থন অব্যাহত রেখেছেন।”
এর পর ব্যাপক করতালির মাধ্যমে সাংসদরা উঠে দাঁড়িয়ে হুনকাকে অভিবাদন জানান। স্পিকার আরো বলেন “তিনি একজন ইউক্রেনীয় নায়ক, একজন কানাডিয়ান নায়ক, এবং আমরা তাঁরসমস্ত সেবার জন্য তাঁকেধন্যবাদ জানাই। আপনাকে ধন্যবাদ।”
প্রতিক্রিয়া
রবিবার কানাডার ইহুদিদের সংগঠন “দ্য ফ্রেন্ডস অফ সাইমন উইসেনথাল সেন্টার ফর হলোকাস্ট স্টাডিজ” একজন নাৎসিকে পার্লামেন্টে সংবর্ধনা দেওয়ার প্রতিবাদে ক্ষোভ প্রকাশ করে ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানানোর পর ব্যাপারটি সামনে আসে। এরপর কানাডার বাইরে এবং ভিতরে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দেয়।
হুনকা সম্পর্কে সংগঠনটি তার বিবৃতিতে লেখে “”নিরপরাধ বেসামরিকদের গণহত্যার জন্য (হুনকা) দায়ী ছিলেন এমন এক স্তরের বর্বরতা এবং বিদ্বেষ যা কল্পনাতীত।”
বিবৃতিতে আরো বলা হয় “প্রত্যেক হলোকাস্ট থেকে বেঁচে যাওয়া এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রবীণ, যারা নাৎসিদের সাথে লড়াই করেছিল তাদের কাছে ক্ষমা চাওয়া, এবং এই ব্যক্তি কীভাবে কানাডিয়ান পার্লামেন্টের পবিত্র হলগুলিতে প্রবেশ করেছিল এবং হাউসের স্পিকারের কাছ থেকে স্বীকৃতি পেয়েছে তার একটি ব্যাখ্যা দিতে হবে।”
রাশিয়া ছাড়াও পোল্যান্ড, ইজরায়েলের মত মিত্র দেশও কানাডার কাছে ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানায়। প্রসঙ্গত রুশ প্রশাসন বার বার ইউক্রেনে নাৎসি আধিপত্যের অভিযোগ করে এসেছে, অন্যদিকে বার বার এই অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে ন্যাটো ভুক্ত দেশ গুলো। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম প্রচার করে এসেছে নাৎসিবাদের অভিযোগটি রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের অপপ্রচারমাত্র।
সংসদের ভিতরে ও বাইরে তিব্র ক্ষোভের মুখে অবশ্য ক্ষমা চেয়েছেন স্পিকার এবং প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। যদিও ট্রুডো রুশ প্রপাগাণ্ডা নিয়ে সাবধান করে দেন।
ওয়াফেন এসএস
১৯৪৩ সালের এপ্রিল মাসে জার্মানি অধিকৃত ইউক্রেনে ইউক্রেনীয় উগ্র-দক্ষিণপন্থী যুবকদের নিয়ে গঠিত হয় “১৪ তম ওয়াফেন গ্রেনাডিয়ার ডিভিশন অফ দ্য এসএস (১নং গ্যালিসিয়ান)” ইতিহাসে যা কুখ্যাত ” গ্যালিসিয়ান ডিভিশন” নামে পরিচিত। এই ডিভিশনে ২৫ হাজার ইউক্রেনীয় যুবক যোগ দেয় বলে জানা যায়।
ওয়াফেন এসএস কে বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পরে নুরেনবার্গ বিচারের সময় একটি “অপরাধী সংগঠন” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই নাৎসি বাহিনীটি ব্যাপক ভাবে ইহুদি, পোলিশ, কমিউনিস্ট গণহত্যা, গ্রাম ধ্বংসের অভিযুক্ত হয়।
ইউক্রেনের নাৎসিবাদ
ইউক্রেনের ইউরোপ লাগোয়া পশ্চিম দিক কৃষি ভিত্তিক এবং দক্ষিণপন্থী নাৎসিদের ঘাঁটি বলে পরিচিত। অন্য দিকে রাশিয়া ঘেঁষাপূর্বদিক শিল্প সমৃদ্ধ, এই অঞ্চলে বামপন্থীরা শক্তিশালী। প্রথমে জমিদার এবং তার পরে কুলাকদের বিরুদ্ধে কমিউনিস্টদের মূলত স্তালিনের আমলে ঘটা হিংসা ইউক্রেনের বাম বিরোধিতা এবং উগ্রদক্ষিণপন্থার প্রতি ঝোঁকের অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়। সম্পত্তি এবং সামাজিক প্রতিপত্তি হারানো এই অভিজাতরাই শ্বেতাঙ্গবাদী উগ্র জাতীয়তাবাদের অন্যতম ভিত্তি।
২০১৪ সালে ইউক্রেনে ভিক্টর ইউয়ানুকোভিচের নির্বাচিত সরকারকে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত করার পেছনে অন্যতম ভূমিকায় ছিলো আজভ ব্যাটেলিয়ন। এই অভ্যুত্থান “”ময়দান বিপ্লব”” নামে পরিচিত। ইউক্রেনের বর্তমান শাসকেরা ২০০৮ থেকেই সেই দেশে নিষিদ্ধ কুখ্যাত ইউক্রো নাৎসিবাদের জনক স্টিফেন বান্দেরার মূর্তিস্থাপন, বান্দেরার ছবি নিয়ে মিছিল করে আসছে। অ্যাজভব্যাটেলিয়ন প্রকাশ্যেই নিজেদের উগ্র জাতীয়তাবাদী শেতাঙ্গবাদী মতাদর্শ প্রচার করে, নাৎসিদের স্বস্তিকা চিহ্ন ব্যবহার করে।
“ময়দান বিপ্লবের” পর একদিকে ইউক্রেনে কমিউনিস্ট পার্টি সহ বিভিন্ন বিরোধী দলের সাথে, রুশ ভাষাও নিষিদ্ধ হয়, অন্যদিকে অ্যাজভব্যাটেলিয়নকে ইউক্রেনের সরকারি বাহিনী ন্যাশেনাল গার্ডের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন ২০১৪ সালে ইউক্রেনে নাৎসিদের অভ্যুত্থান, ২০১৪ সালে ওডেসায় শ্রমিক ভবনে সরকারি হিসাবে ৪৮ জন বামপন্থীকে পুড়িয়ে হত্যা, রুশ, গ্রীক বা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলাই ইউক্রেনে ২০১৪ থেকে ২০২২ পর্যন্ত দক্ষিণ বনাম বাম গৃহযুদ্ধ এবং ২০২২ এর ফেব্রুয়ারী থেকে রুশ ইউক্রেন যুদ্ধের ভিত্তিভূমি তৈরি করেছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের শুরু পর্যন্ত সরকারি হিসেবে পূর্ব ইউক্রেইনে নাৎসিদের পরিচালিত গণহত্যায় নারী,পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে ১৩ হাজার মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ।
২০২২ সালের ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুতে আফ্রিকান, ভারতীয়, ইরানি সহ বিদেশীদের বিরুদ্ধে বর্ণবিদ্বেষী আচরণের অভিযোগ ওঠে ইউক্রেনীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে। অ্যাজভ ব্যাটেলিয়ানের অফিশিয়াল ট্যুইটার একাউন্ট থেকে একটি ভিডিও শেয়ার করা হয়, যেখানে চেচেনিয়ার মুসলিম যোদ্ধাদের জন্য গুলিতে শুয়োরের চর্বি মাখাতে দেখা যায়, এবং ইসলামবিদ্বেষমূলক মন্তব্য করতেও শোনা যায়।
“লিবারাল” “মুক্ত” পশ্চিমারা এবং নাৎসিবাদ
কানাডার ঘটনাই প্রথম নয়। এর আগে বহুবার উদারতা মুক্ত চিন্তার প্রতিক পশ্চিমা দেশ গুলো নাৎসিদের সংবর্ধনা দিয়েছে। গত নারী দিবসে হোয়াইট হাউসে “সাহসিনী নারী” বা “উইমেন অফ কারেজ” পুরস্কার দেওয়া হয় ইউক্রেনের নাৎসি নেত্রী বলে পরিচিত ইউলিয়া পাইভস্কায়াকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয় এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজয়ের পর এই নাৎসিরা আশ্রয় নেয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েতেরই মিত্র পশ্চিমা ধনতান্ত্রিক দেশ গুলোতে। নাৎসিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা পশ্চিমা লিবারাল দেশ গুলোতে একদিকে যেমন প্রবল নাৎসি বিরোধী জনমত ছিলো, তেমনি সমাজতান্ত্রিক শিবিরে অন্তর্ঘাত ঘটানোর জন্য, নতুন করে সাম্যবাদের বিস্তার মোকাবিলার জন্য দরকার ছিলো নাৎসিদের।
সোভিয়েত ব্লকের প্রশাসনের হাত থেকে রক্ষা করতে চিহ্নিত নাৎসিদের আশ্রয় দেয় পশ্চিমারা। অন্যদিকে ঠান্ডা যুদ্ধের প্রেক্ষিতে সোভিয়েত ব্লকের ভিতর কট্টর কমিউনিস্ট- বিরোধী শক্তি হিসেবে নাৎসিদের লালন পালন করা হয় বলে অভিযোগ।
ইউক্রেনের উগ্র জাতীয়তাবাদবা নাৎসিবাদের জনক বান্দেরাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আশ্রয় দেয় পশ্চিম জার্মানি। ১৯৫৯ সালে সোভিয়েতের গুপ্ত ঘাতকের হামলায় বান্দেরার মৃত্যু হয় বলে অভিযোগ।
১৯৮৬ সালে “কমিশন অন এককোয়েরি অন ওয়ার ক্রিমিনাল অফ কানাডা” তার রিপোর্ট পেশ করে। যদিও এই কমিশন সোভিয়েত ইউনিয়নের মত নাৎসি বাহিনীতে যোগ দেওয়া প্রত্যেককে নাৎসি যুদ্ধাপরাধী হিসেবে দেখতে রাজি হয়নি। তাদের দাবি ছিলো স্তালিন এবং বলশেভিকদের অত্যাচার প্রতিরোধ করার জন্যেও তারা নাৎসি বাহিনীতে যোগ দিয়ে থাকতে পারে।
এই যুক্তিতেই পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যম ইউক্রেনের বর্তমান শাসকদের নাৎসি যোগ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে বার বার। পশ্চিমা মিডিয়া যুক্তি দিয়েছে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি জেলেনেস্কি নিজেই একজন ইহুদি হয়ে কী ভাবে নাৎসি হতে পারেন?
ইউক্রেনে বিরোধীরা দাবি করেন কোনো নাৎসি সরাসরি ক্ষমতায় বসলে লিবারাল, মুক্ত চিন্তার প্রচারক বলে দাবি করা ন্যাটো ভুক্ত দেশ গুলোর সরাসরি ক্যু এর মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা সরকারকে সমর্থন জানাতে সমস্যা হবে, নিজের দেশেই প্রশ্নের মুখে পড়বে শাসকরা। সেই কারণেই রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ কমেডিয়ান জেলেনেস্কিকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছে। ক্ষমতার রাশ আসলে নাৎসিবাদেরই হাতে।
যদিও ইউক্রেইন এর নাৎসি বাহিনী কে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে “স্বাধীনতা সংগ্রামী” হিসাবে পশ্চিমারা দেখায়, কিন্তু ঐতিহাসিক তথ্য দেখায় যে ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লবের পরে জারতন্ত্রের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পেয়ে প্রথম স্বাধীন সত্ত্বা পায় ইউক্রেন ও সোভিয়েত ইউনিয়নে একটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসাবে যোগ দেয় দেশটি।
জাতিসংঘের নাৎসি বিরোধী প্রস্তাব
জাতিসংঘে ২০১৪ সালের ২১শে নভেম্বর “নাৎসিবাদকে গৌরবান্বিত করার” বিরোধী রুশ প্রস্তাবের পক্ষে পড়ে ১৫৫টি ভোট। ইউরোপিয় ইউনিয়ন ভুক্ত দেশ গুলো ভোট দানে বিরত থাকে। অন্যদিকে প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট পড়ে মাত্র তিনটি, এই দেশগুলি হল ইউক্রেন, কানাডা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
২০২২ সালে আবার নাৎসিবাদকে মহিমান্বিত করার বিরুদ্ধে জাতিসংঘে উত্থাপিত রুশ প্রস্তাবের পক্ষে ১২০টি এবং বিপক্ষে ৫০টি ভোটে পড়ে। প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেওয়া রাষ্ট্র গুলোর যুক্তি ছিলো তারা আসলে নাৎসিবাদের বিরোধিতা করলেও, এই প্রস্তাব আসলে রুশ আগ্রাসনের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য আনা হয়েছে, তাই তারা প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে।
শুধু নাৎসিবাদ নয়, ২০১৮ সালে ওয়াশিংটন পোস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সৌদি যুবরাজ মহম্মদ বিন সলমন বলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধেই সৌদি আরব বিশ্বজুড়ে ঠান্ডা যুদ্ধের সময় ওয়াহাবিবাদের পৃষপোষকতা শুরু করে।
ঠান্ডা যুদ্ধের প্রেক্ষিতে পৃথিবী জুড়ে উগ্র দক্ষিণপন্থার প্রচার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয়দের বিদেশনীতির অঙ্গ হয়ে যায়, তা আজও সোভিয়েতের পতনের তিন দশক পরেও অব্যাহত। সুতরাং কানাডার পার্লামেন্টের কেলেঙ্কারিটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং পশ্চিমাদের চেপে রাখা গোপন বিদেশ নীতির প্রকাশ্য প্রতিফলন।