স্বরূপনগর কলেজের পর এবার বারাসাত গভর্নমেন্ট কলেজের পড়ুয়াদের তরফ থেকে এসেছে ব়্যাগিং-এর অভিযোগ। কিন্তু ব়্যাগিং করছে কারা? জানলে অবাক হতে হয় যে যাদবপুর ব়্যাগিং কাণ্ডে সবচেয়ে সরব তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি)-র বিরুদ্ধেই এবার ব়্যাগিং-এর অভিযোগ এনেছে পড়ুয়াদের একাংশ।
ঘটনাটি কী ঘটেছে?
আজ ২৮শে আগস্ট, টিএমসিপি-র প্রতিষ্ঠা দিবস। যথারীতি কলেজে কলেজে ইউনিয়নের প্রস্তুতি চলছিল জোর কদমে। কিন্তু বিপত্তি হল আগের দিন রাতেই। পড়ুয়াদের অভিযোগ, কলেজের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ চ্যাটে ভাস্বরীত মল্লিক নামের এক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র প্রথম বর্ষের পড়ুয়াদের হুমকি দিচ্ছে।
টিএমসিপি-র হুমকিটা ঠিক কী রকম?
পড়ুয়াদের থেকে প্রাপ্ত হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজের ছবি থেকে জানা যাচ্ছে পড়ুয়াদের বলা হয়েছে, “আমাদের হাতে এই গ্রুপের ২৮৬ জনের লিস্ট পুরো রেডী, সমস্ত ডিটেইল্স সমেত।” কিন্তু এই ডিটেইল্স নিয়ে কী করা হবে? সেই প্রসঙ্গে ভাস্বরীত আরও লিখেছে, “এই ২৮৬ জনের মধ্যে যারা আমাদের সাথে যাবে তারা আমাদের ৩৬৪ দিন ২৪ ঘন্টা যেকোনো সময় যেকোনো ভাবে পাশে পাবে আর যারা যাবে না, বিভিন্ন অজুহাতে, অছিলা দেখাবে তাদের সমস্যায় ফেলতেও আমাদের ১ মিনিট সময় লাগবে না। তাদের সমস্যায় পাশে থাকা তো দূরে থাক!”
কী সমস্যার সৃষ্টি এই ভাস্বরীত করতে পারে সেই প্রসঙ্গে কলেজের পড়ুয়াদের তরফ থেকে আর একটি স্ক্রিনশট পাওয়া গিয়েছে যেখানে উল্লেখ করা হচ্ছে যে “কলেজের ফাইনাল ভেরিফিকেশন হয়নি সেটা কিন্তু মাথায় রাখতে হবে।” পড়ুয়াদের বক্তব্য, এই রেজিস্ট্রেশন এবং ভেরিফিকেশনের বিষয়টি ‘ইউনিয়নের হাতে থাকে’ তাই তারা এটি স্থগিত করতে পারে বলে তারা ভয় পাচ্ছে।
ছাত্ররা কী বলছে?
এই চ্যাটের স্ক্রিনশট ভাইরাল হয়ে যায় গতকালই। এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে পোস্ট করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নেহা চক্রবর্তী, যেখানে নেহা লিখেছেন, “আগামীকাল রাজ্যের শাসক দলের ছাত্র সংগঠন AKA তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবস। যেকোনও রাজনৈতিক দলই চায় তাদের সভায় বা অনুষ্ঠানে বেশ জমায়েত হোক মানুষ , এই দলও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু আমার এলাকা সহ বেশ কয়েকটি এলাকার কলেজে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের কিছু উঠতি নেতারা কলেজে আসা পড়ুয়াদের আমন্ত্রণের বদলে রীতিমত ভয় দেখিয়ে রেখেছে যে কাল যদি তারা রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত না হয় তাহলে তাদের ভেরিফিকেশন সহ সমস্ত অফিসিয়াল কাজ আটকে দেবে। এমনকি এটাও বলছে ” আমাদের কাছে সকলের নাম আর ডিটেলস আছে , যদি না আসিস তারপর দেখে নিচ্ছি।” স্বভাবতই নতুন আসা কলেজের অর্ধেকের বেশি পড়ুয়া তাদের অনিচ্ছা থাকা সত্বেও এই হুমকির ভয় পেয়ে কাল উপস্থিত হবে সভায়। এই যদি “ছাত্র পরিষদের” রাজনীতির নমুনা হয় এরা ভবিষ্যতে কোথায় যাবে সেটাই দেখার।”
ইতিমধ্যেই নেহার সাথে কথা হয়েছে ইস্ট পোস্ট বাংলার। নেহা আমাদের জানিয়েছে, “আমি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। স্টেট ইউনিভার্সিটির আওতাভুক্ত যে কলেজগুলি আছে তার মধ্যে বারাসাত গভর্নমেন্ট কলেজেও পড়ছে। এই কলেজে আমার কিছু ছোট ছোট ভাইবোনেরা আছে যাদের প্রত্যেক বছর এভাবে থ্রেট করা হয়। এই বছরেও টিএমসিপি-র ফাউন্ডেশন ডে কে কেন্দ্র করে ওদের এমনই একটি গ্রুপে ঢোকানো হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে ‘যারা যারা যাবি না, তাদের দেখে নেওয়া হবে’। তাদের আরও বলা হয়েছে যে তাদের কলেজ ভেরিফিকেশন আটকে দেওয়া হবে। ছাত্র ছাত্রীরা খুব ভয়ে আছে, তারা সরাসরি বাইরে এসে অভিযোগ করতে পারছে না এই কারণেই।”
এই পোস্টের সূত্র ধরে আর একটি পোস্ট করে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইরফান সাদিক়। ইরফানের সাথে ইস্ট পোস্ট বাংলার কথা হয়েছে। ইরফান আমাদের জানিয়েছে,”আমার কিছু জুনিয়র ভাইবোনেরা যারা বারাসাত গভর্নমেন্ট কলেজে পড়ে, তারা আমায় এই ঘটনার বিষয়ে জানিয়েছে। আমাকে তারা স্ক্রিনশট পাঠিয়েছে। আমি পোস্ট করেছি। কিন্তু তার পর থেকেই ওই কলেজ ইউনিয়নের ছেলেরা আমার কমেন্ট সেকশনে এসে আমায় হুমকি দিতে থাকে এবং একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে আমার পোস্টের লিঙ্ক দিয়ে পোস্ট রিপোর্ট করার আহ্বান জানায়। তার পর যদিও কমেন্ট গুলো মুছে দেওয়া হয় কিন্তু আমি সেগুলোর ছবি তুলে রেখেছি।”
ইস্ট পোস্ট বাংলার সাথে বারাসাত কলেজে কিছু ছাত্র ছাত্রীদের যোগাযোগ হয়েছে। তাদের মধ্যেই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ছাত্র বলেছে, “পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভুক্ত কলেজগুলির এ বহু দিনের সমস্যা। আমাদের কলেজ বারাসাত গভর্নমেন্ট কলেজ। সেখানকার তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (টিএমসিপি) ইউনিয়ন প্রতি বছর ২১শে জুলাই বা ২৮শে আগস্ট এভাবে ছাত্র ছাত্রীদের ভয় দেখায়। তারা হুমকি দেয় যে যদি ছাত্ররা ইউনিয়নের সাথে কর্মসূচিতে না যায় তবে, ‘ভেরিফিকেশন আটকে দেবো’ বা ‘স্কলারশিপের ফর্ম আটকে দেবো’ অথবা ‘অ্যাডমিট কার্ড দেওয়া হবে না’ ইত্যাদি।” এই ছাত্র আরও সংযোজন করেছেন যে, “যদি কোনও ছাত্র এই কথা বাইরে বার করে বা কোনাও ভাবে প্রিন্সিপালকে জানানোর মনোভাব দেখায় তবে তাদের উপর চলে শারীরিক অত্যাচার। গত বছর আমারই এক বন্ধুকে এই বিষয়ে একটি ফেসবুক পোস্ট করার জন্য শারীরিক নিগ্রহ করেছিল।”
বারাসাত গভর্নমেন্ট কলেজের অন্য একজন ছাত্রীর সাথে কথা হয় ইস্ট পোস্ট বাংলার, তিনি আমাদের জানিয়েছেন, “আমাদের কলেজে একমাত্র তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি)-র ইউনিয়ন রয়েছে। গতবছর আমাদের সাথে এমন হয়েছিল। এবার এইবছর যারা নতুন ভর্তি হয়েছে তাদের সাথে এমন হচ্ছে। তাদের ভেরিফিকেশন হয়নি রেজিস্ট্রেশন হয়নি, যথারীতি ক্লাসও শুরু হয়নি, কিন্তু তাদের কলেজে ডাকা হচ্ছে। কারা ডাকছে? ইউনিয়ন। কিসের জন্য ডাকছে ছাত্ররা জানে না। তাদের ইন্ট্রো নেবে, তারা ফ্রেসার্স। এসব বলে তাদের জোর করে বড় বড় সেমিনার রুমে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলা হচ্ছে আজ যাওয়ার জন্য নাহলে রেজিস্ট্রেশন ও ভেরিফিকেশন আটকে দেওয়া হবে। এছাড়াও একটা ভিডিওতে দেখা গিয়েছিল যে একটা মোটা লাঠি নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অর্থাৎ কাউকে বেরোতেও দেবে না। মানে কারও ভেতরে কাজ হয়ে গেলে যে সে বেড়িয়ে আসবে তাও সম্ভব নয়।”
এছাড়াও এই ছাত্রী বলেছে, “গতবছর বেশ কয়েকজন ছাত্রকে মারা হয়। তারা এই অত্যাচারের খবর বাইরে এনেছিল বলে। আমার পাশের বাড়ির একটি মেয়েকেও ভীষণ ধমকিয়েছে। ওদের সেমেস্টারের একজন ছেলেকে এমনভাবে মেরেছে যে রক্ত বেরোচ্ছিল। কিন্তু ওর বাড়ির লোক শাসক দলের ভয়ে কোনও আইনী পদক্ষেপ নেয়নি। আরও দুইচারজন ছেলেকে চড় থাপ্পর মেরে মুচলেকা লিখিয়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।”
ছাত্র ছাত্রীদের বক্তব্য এই ভয়ানক ঘটনাগুলো বহু বছর ধরে কলেজে কলেজে হয়ে আসছে, স্রেফ ভয়ে কেউ গলা তুলতে পারছে না। এছাড়াও এটা কোনও ‘এলিট’ ইউনিভার্সিটি নয় বলেই প্রচলিত মিডিয়ার কান অবধি কথা পৌছাচ্ছে না বলে ছাত্রদের বক্তব্য। বারাসাত কলেজে এই ব়্যাগিং-এর ঘটনা ভাইরাল হওয়ার পর আশ্চর্যজনক ভাবে হুমকি দিচ্ছিলেন যে ভাস্বৃত, তার প্রোফাইলটি ডিলিট হয়ে যায়। হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটের সূত্র ধরে ভাস্বৃতর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোন সাড়া দেননি। এই ঘটনার বিষয়ে রাজ্য টিএমসিপি-র সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্যকে ইস্ট পোস্ট বাংলার তরফ থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাফ জানিয়ে দেন যে তার হাতে এই পরিমাণ সময় নেই যে তিনি মিডিয়ার সাথে কথা বলবেন।